Ajker Patrika

লোকচক্ষুর আড়ালে সিলেটের এক সমৃদ্ধ জাদুঘর

শাকিলা আক্তার
Thumbnail image

সদর(সিলেট): সিলেটের জকিগঞ্জে ১৮৩৬ সালে মানুষ বেচা–কেনা হতো। এ কোনো কল্পকাহিনি নয়। বিক্রির দলিল পর্যন্ত আছে। আর এই দলিলটি সংরক্ষিত আছে সিলেটের ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরে। সিলেটের দরগা গেটে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের পঞ্চম তলায় অবস্থিত এ জাদুঘরে রয়েছে এমন আরও অনেক মূল্যবান দলিল, স্মারক ও নিদর্শন। রয়েছে লাখো বছরের পুরোনো গাছের জীবাশ্ম (পাথর), সোনার জরি খচিত মসলিন শাড়ি, দুই মণ ওজনের হাতির দাঁত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহান সৈনিক সূর্য কুমার সেনকে (মাস্টার দা) ধরিয়ে দিতে ঘোষিত পুরস্কারের বিজ্ঞাপনসহ অনেক কিছু।

ছবি: শাকিলা আক্তারসিলেট নগরীর ভেতরেই এমন একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর রয়েছে, যার তথ্য অনেকের কাছেই অজানা। জাদুঘরটিতে রয়েছে তেরো শতকের কালো পাথরের তৈরি তৈজসপত্র, শিলালিপি, তাম্রলিপি, ১৮৮৩ সালের হস্তচালিত ছাপার মেশিন, ফারসি কাবিন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত রকেট লঞ্চারের ক্যাপসুলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম, জুলিয়াস সিজারের সময়ের মুদ্রাসহ বহু মূল্যবান নিদর্শন। অজস্র মূল্যবান নিদর্শন থাকলেও জাদুঘরটি অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। এ নিয়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেও নেই কোনো প্রচার কার্যক্রম।

ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নিদর্শন। ছবি: শাকিলা আক্তারকোনো একটি অঞ্চল বা জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ ও তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এক অবিকল্প মাধ্যম জাদুঘর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানের বিস্তারের ক্ষেত্রেও জাদুঘরের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘরের যাত্রা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। নামটিও সবার জানা—আলেক্সান্দ্রিয়া। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সেই জাদুঘর নিয়ে গল্প–গাথাও কম নেই। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সময়টি আরও অনেক পরের। এখনো বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে বহু জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। সিলেটের এই ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরও অনুরূপ।

ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নিদর্শন। ছবি: শাকিলা আক্তারভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদের পুরোনো স্মারক ও নিদর্শন সংগ্রহের প্রতি ঝোঁক ছিল। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের এই জাদুঘরে ঠাঁই পাওয়া নিদর্শনের ২০ শতাংশ সংগ্রহই তাঁর। বাকি ৮০ শতাংশ সংগ্রহ তাঁর নাতি ও বর্তমানে এই জাদুঘরের পরিচালক মোস্তাফা শাহ জামান চৌধুরীর। ১৯৮০ সালে ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁর কাছে থাকা সংগ্রহ নাতি মোস্তাফা শাহ জামান চৌধুরীকে ওসিয়ত করে যান। সেই সব সংগ্রহ এবং নিজের করা কিছু সংগ্রহ নিয়ে ২০০৪ যাত্রা করে জাদুঘরটি। বর্তমানে এটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তাফা শাহ জামান চৌধুরী। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর এখনো কোনো সরকারি আনুকূল্য পায়নি। অবশ্য সে চেষ্টাও এখন পর্যন্ত হয়নি।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাদুঘর অবশ্য নতুন কিছু নয়। বরং ব্যক্তির উদ্যোগেই যাত্রা করেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম জাদুঘর—আলেক্সান্দ্রিয়া। সরকারি বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাদুঘরের ধারণা এসেছে অনেক পরে। দেশে দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু জাদুঘর রয়েছে। নতুন করে হচ্ছেও অনেক। এই সব জাদুঘর আবার এক রকম নয়। কোনো কোনোটি বিশেষ বিশেষ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের লোকশিল্প জাদুঘরই এর বড় প্রমাণ। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা জাদুঘরের গুরুত্ব বিবেচনায় রাষ্ট্র বা সরকার কখনো কখনো এগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। লক্ষ্য থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানের বিস্তার। সাধারণ মানুষের মধ্যে জাদুঘর নিয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ঘটা করে পালন করা বিশ্ব জাদুঘর দিবসও। আজ সেই বিশ্ব জাদুঘর দিবস, যার যাত্রা হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১৮ মে। বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালিত হচ্ছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে ডিজিটাল পরিসরেই এবারের আয়োজন সীমাবদ্ধ।

ছবি: শাকিলা আক্তারঅবশ্য প্রতি বছরই বাংলাদেশে যে বিশ্ব জাদুঘর দিবস পালন হয়, তা অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা বলা যায়। তা না হলে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জাদুঘরগুলোয় সংরক্ষিত নিদর্শনগুলো যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর প্রায়ই পত্রিকার পাতায় উঠে আসত না। থাকত না অবহেলা ও খামখেয়ালিপনার অভিযোগ। এর গুরুত্ব পুরোপুরি অনুধাবন করলে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত জাদুঘরগুলো দেখভালের জন্যও আলাদা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দেখা মিলত। কিন্তু এমন কোনো কিছুর দেখা আজও বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। তেমনটি হলে ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরটির কথা অন্তত মানুষ জানত। কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগ প্রশাসনের কোনো স্তর থেকেই নেই।

ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নিদর্শন। ছবি: শাকিলা আক্তার২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর ২০১৫ সালে জাদুঘরটি সিলেটের দরগা গেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের পঞ্চম তলার বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। পারিবারিকভাবেই জাদুঘরটি পরিচালিত হচ্ছে বলে এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনো প্রচার নেই। অবশ্য আগ্রহীরা ঠিকই খুঁজে নেন জাদুঘরটিকে। কারণ এতে থাকা সংগ্রহের বৈচিত্র্য। সরেজমিনে দেখা যায়, এই জাদুঘরে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মাথার খুলি, বিভিন্ন শতাব্দীর বন্দুক, পিস্তল, এক হাজার বছর আগের রাজা চন্দ্র দেবের আমলের নাগরি ভাষায় লেখা তাম্রলিপি, ত্রিপুরার মহারাজা ও মহারানির বিভিন্ন দলিলসহ বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিক দলিলপত্র। এখানে রয়েছে নবাব আলিবর্দী খাঁর আমলের হাতির দাঁতের হাত পাখা, বিভিন্ন দেশের প্রাচীন ব্যাংক নোট, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক নোট, শতাধিক বছরের পুরোনো দেয়াল ঘড়ি, হাত ঘড়ি, ১৮৬৬ সালে জকিগঞ্জ উপজেলার উত্তরকুলের জমিদার পত্নী বেগম মুসিম রাজা চৌধুরীর ব্যবহৃত মিনি ড্রেসিং টেবিল, ১ হাজার ৩০০ বছরের পুরোনো কালো পাথরের তৈরি তৈজসপত্র, বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত ক্যামেরা, ২ হাজার বছর আগের জুলিয়াস সিজারের সময়ের মুদ্রা, ১৮৫৩ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের মুদ্রা ও ১৭১৯ সালে জৈন্তাপুর থেকে প্রাপ্ত বাংলা হরফে এবং সাংস্কৃতিক উচ্চারণে লেখা শিলালিপি ও প্রতিলিপি। রয়েছে সিলেটের জকিগঞ্জের ঐতিহাসিক গয়বী দিঘি থেকে প্রাপ্ত শিলালিপি, যার একপাশে আরবি লিপি এবং অন্য পাশে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি খোদাই করা। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ব্যবহৃত পানদান, হাতির দাঁতের তৈরি খুঁটির খড়ম, হাতির দাঁতের তৈরি চীনা খেলা মাহজং–এর দান, নেপালের রাজা বিক্রম শাহদেব কর্তৃক মতিন উদ্দীন আহমদকে উপহার দেওয়া হাতির দাঁতের তৈরি দাবা খেলার গুটি থেকে শুরু করে গরুর গাড়ি পর্যন্ত এমন অজস্র নিদর্শন এখানে রয়েছে, যা এই প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে পারে অতীত সময়ের। ইতিহাসের গলি–ঘুপচিতে চলার সাহস ও উৎসাহ জোগানোর এক অনায়াস ক্ষমতা রয়েছে জাদুঘরটির। কিন্তু সেই ক্ষমতার খুব কমই প্রয়োগ হচ্ছে শুধু এ সম্পর্কিত তথ্যের যথাযথ প্রচারের অভাবে।

ছবি: শাকিলা আক্তারএ বিষয়ে জাদুঘরটির পরিচালক মোস্তাফা শাহ জামান চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার নানার ইচ্ছা পূরণ করতেই এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছি। এখানে স্থানীয় দর্শনার্থীরা খুব একটা না এলেও বিদেশি অনেক দর্শনার্থী আসেন। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও আসেন। তবে এখন করোনা মহামারির কারণে জাদুঘরটি নিয়মিত খোলা রাখা হয় না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত