Ajker Patrika

উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত

বাড়ছে মৃত্যু, থামছে না কান্না

  • নিহতের সংখ্যা ২৮
  • চিকিৎসাধীন ৬৮
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের নেওয়া হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। গতকাল সেখানে চিকিৎসাধীন এক শিক্ষার্থীর কাছে অভিভাবক। ছবি: এএফপি
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের নেওয়া হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। গতকাল সেখানে চিকিৎসাধীন এক শিক্ষার্থীর কাছে অভিভাবক। ছবি: এএফপি

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের কোলাহল নেই। বিমানবাহিনীর বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানের বিকট শব্দে থেমে গেছে সেই কোলাহল। থামেনি সন্তান বা স্বজনহারাদের বুকফাটা কান্না, মাতম। হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আহত ও দগ্ধরা। উদ্বিগ্ন মা-বাবা ও স্বজনদের আহাজারি পুরো হাসপাতালের পরিবেশকেই করে তুলেছে ভারী।

গত সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি একাডেমিক ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩১ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নিহতের সংখ্যা ২৮ জন। ওই দুর্ঘটনায় আহত ৬৮ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত ও আহতদের বেশির ভাগই মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী।

দুর্ঘটনায় নিহত বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামের মরদেহ গতকাল রাজশাহী নগরের সপুরা কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে ঢাকায় তাঁর ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। নিহত আরও ১৯ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে, নিহত যাদের মরদেহ শনাক্ত করা যাচ্ছে না, ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্ত করে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

ওই দুর্ঘটনায় গতকাল এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গতকাল দুর্ঘটনাস্থল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও অবরোধের মুখে পড়েন। তাঁরা প্রায় ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশি পাহারায় সেখান থেকে বের হন।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। এরপর আগুন ধরে যায়। এতে বৈমানিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সেদিনই ২২ জন নিহত হন।

আইএসপিআর দুপুরে ৩১ জন নিহত ও ১৭১ জন আহত বলে জানায়। গতকাল দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-বিষয়ক বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ব্রিফিংয়ে বলেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৯ জন নিহত হয়েছে। তবে সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সরকার ফারহানা কবীর সাংবাদিকদের জানান, নিহতের সংখ্যা ২৮। উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারে মৃত দুজনের মধ্যে একজন শিক্ষার্থীকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তার নাম ওমায়ের নুর আশফিক। আরেকজনকে এখনো শনাক্ত করা হয়নি। এই স্থানান্তরের কারণে একজনের তথ্য দুবার যোগ হওয়ায় সংখ্যায় বিভ্রাট তৈরি হয়, যা পরে সংশোধন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সন্ধ্যায় জানায়, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটে ১০ জন, সিএমএইচে ১৫, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১, লুবনা হাসপাতালে ১, ইউনাইটেড হাসপাতালে একজনসহ সব মিলিয়ে ২৮ জন মারা গেছে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ২০ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, নিহতরা হলো তানভীর (১৪), আফনান ফাইয়াজ (১৪), মাহরীন (৪৬), বাপ্পি (৯), মাসুকা (৩৭), এ বি শামীম (১৪), শায়ান ইউসুফ (১৪), এরিকসন (১৩), আরিয়ান (১৩), নাজিয়া (১৩), রজনী ইসলাম (৩৭), মো. সামিউল করিম (৯), ফাতেমা আক্তার (৯), মেহনাজ আফারিন হুমায়রা (৯), সারিয়া আক্তার (১৩), নুসরাত জাহান আনিকা (১৩), সাদ সালাউদ্দিন (৯), সায়মা আক্তার (৯), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম, জুনায়েত (৯), ওমায়ের নূর আশফিক (১১)। বাকি কয়েকজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সায়েদুর রহমান দুপুরে জানান, নিহতদের মধ্যে এখনো ছয়জনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। তাদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে চারজনকে স্বজনেরা ‘নিখোঁজ’ দাবি করেছেন। তবে দুজনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো দাবি করেননি।

চিকিৎসাধীন আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানান সায়েদুর রহমান। তিনি জানান, সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে কেস রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। তাঁদের একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও দুজন নার্স রাতেই ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে এবং তাঁরা বুধবার থেকে চিকিৎসা কার্যক্রমে যোগ দেবেন।

সন্তানের অপেক্ষায় স্বজনেরা

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ঢাকার আটটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে আহতরা। এগুলো হলো—জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল।

এই আট হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়, আহতদের স্বজনদের চাপা কান্না, আর্তনাদ। কষ্টে চুপসে যাওয়া কিছু মা-বাবার মলিন মুখ। তবে ছিল না চিৎকার-চেঁচামেচি।

মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আয়ান বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তার শরীরের বেশির ভাগই পুড়ে গেছে। কথা নেই, সাড়া নেই। নিচতলা থেকে আইসিইউতে ওঠার সময় আয়ানের বাবা আরাফাত রহমানের সঙ্গে একমুহূর্ত কথা হয়। ধরা গলায় তিনি বলেন, ‘কলিজায় সহ্য হয় না ভাইয়া। আমার সোনাটা তো ব্যথা পেলেই ছটফট করত। এখন পুরো শরীরটাই ক্ষয়ে গেছে।’

উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল মাওয়া চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের করিডরে তার বাবা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এক লোক আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, আপনি দ্রুত বাংলাদেশ মেডিকেলে (উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল) আসেন। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার মেয়ে মাওয়াকে এক লোক নিয়ে আসছে। তখন হাসপাতালে পোড়া রোগীতে ভরপুর। পরে মাওয়াকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে আসি।’

প্রায় ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব

ছয় দফা দাবি আদায়ে দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে দিনভর অবরুদ্ধ ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁরা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে অবরুদ্ধ হন। কয়েক দফা বের হওয়ার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা তাঁদের পথ রোধ করে। সন্ধ্যার পর বিপুলসংখ্যক পুলিশের পাহারায় দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব মাইলস্টোন স্কুল থেকে বের হয়ে আসেন।

বিকেলে শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবিকে সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটি শিগগির গঠিত হচ্ছে বলে জানান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি এ তথ্য জানান।

‘পাইলট খালি মাঠে বিমানটি নামাতে চেষ্টা করেছিলেন’

বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি পাইলট খালি মাঠে নামানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে জানান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান। দুপুরে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির এ কে খন্দকার প্যারেড গ্রাউন্ডে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আয়োজিত ফিউনারেল প্যারেডে তিনি বলেন, পাইলট যখন বুঝতে পারছিলেন, বিমানটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনো তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন সেটিকে কোনো খালি মাঠে নামাতে। কিন্তু তাঁর সেই শেষ প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাচার করা ৭৮১ কোটি টাকা ফেরত দিতে চেয়েও জামিন পেলেন না নাসার চেয়ারম্যান নজরুল

জীবন বিলিয়ে দিয়ে উত্তরার মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের বাঁচালেন, কে এই মাহরীন চৌধুরী

পাইলটের শেষ বার্তা: বিমান ভাসছে না, নিচে পড়ছে

মেয়ের কফিনে বাবার চুমু

মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরাই ছিল ৩৭ বছরের মাসুকার ‘সংসার’, যুদ্ধবিমান তছনছ করে দিল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত