Ajker Patrika

তিস্তার পানি বইছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে: বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দী

লালমনিরহাট ও ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৩, ২১: ১২
তিস্তার পানি বইছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে: বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দী

উজানের ঢল ও বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাতে নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

এদিকে পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ। ধরলা নদীর পানিও বেড়েছে।
আজ শুক্রবার ভোর ৬টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার; যা বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বেলা ৩টায় পানি কিছুটা কমে ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

ফলে জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, সিন্দুনা, ডাউয়াবাড়ি, গড্ডিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ও সদর উপজেলা খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ডুবে যায়। চরাঞ্চলেও পানিতে ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।

গবাদিপশু নিয়ে বন্যার্তরা উঁচু স্থান ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকেই উঁচু স্থানে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার কাজ সারছেন। নলকূপ, টয়লেটে পানি ওঠায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ও স্যানিটেশন সমস্যায় পড়ছে তারা। এদিকে আজ শুক্রবার আদিতমারী উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামে আব্দার হোসেন (৯০) নামের এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে কবরস্থানে হাঁটু পরিমাণ পানি ওঠায় তাঁর লাশ দাফন করতে সমস্যা হয়।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচার গোবর্ধন এলাকার জামাল মিয়া বলেন, ‘সকাল থেকেই পানি বাড়ছে, বাড়িঘর ডুবে যাচ্ছে। অনেকটা বিপদে পরে আছি।’

একই গ্রামের মহুবর রহমান বলেন, ‘সকাল থেকেই পানি হাঁটু সমান, তাই খাটের ওপর চুলা তুলে রান্নাবান্না কাজ করতে হচ্ছে। গরু-ছাগল বাঁধে নিয়ে রাখছি। কোনো রকমে খাটের ওপর উঠে থাকতে হচ্ছে।’

আদিতমারী উপজেলার বারঘড়িয়া গ্রামের এলাকার শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পানির ওপর চলাচল করছি। তার ওপর আবার নদীর পানি বাড়তেই আছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া নদী শাসন করা দুরূহ ব্যাপার। তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার।’

বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দী। ছবি: আজকের পত্রিকাএদিকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, গয়াবাড়ি ও খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তার তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার কয়েক হাজার পরিবার। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে সদ্য রোপণ করা আমন ধানের খেত।

পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো নামমাত্র সংস্কার করলেও বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে অধিকাংশ স্থানে ধসে যাচ্ছে। ফলে নদীতে পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছে। স্থানীয় বেশ কিছু সড়ক বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই করছে। পানির চাপ আরও বাড়লে এসব সড়ক উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকবে। তাতে পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

চর কিসমত এলাকার আরিফ ইসলাম বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে বাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে। এখন ঘরের ভেতরে হাঁটুপানি। পোকামাকড়ের ভয়ে সারা রাত বিছানায় বসে নির্ঘুম কাটিয়েছি। এ চরের সব বাড়িতে পানি উঠেছে। সব রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। গবাদিপশু নিয়েও কষ্টে পড়েছি।’

একই গ্রামের মনজুয়ারা বেগম বলেন, ‘চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সব ডুবে যাচ্ছে। ঘরে মাচা বানিয়ে সেখানে একবেলা রান্না করে তিন বেলা খেতে হচ্ছে। শিশুদের নিয়ে আতঙ্কে থাকি। কখন যে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। বড় সমস্যা হচ্ছে, সব টয়লেট ডুবে গেছে। পুরুষেরা বাইরে গেলেও নারীরা চরম বিপদে পড়েছি। বন্যার সময় এটা নারীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।’

বাইশপুকুর গ্রামের আজিজুল বলেন, ‘পানিবন্দী হয়ে বৃদ্ধ, শিশু ও নারীদের নিয়ে চরম বিপদে পড়েছি। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি দিনের বেলায় রাস্তার উঁচু স্থানে রাখলেও রাতে কষ্ট বাড়ে। নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। তাই ত্রাণ নয়, তিস্তা নদীর স্থায়ী সমাধান দরকার।’

ঘরে পানি ওঠায় বিপদে বাসিন্দারা। ছবি: আজকের পত্রিকাডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা-উদ-দৌলা আজকের পত্রিকাকে বলেন, টানা বৃষ্টিপাতে ভারতের গজলডোবায় তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় উজানের ঢলে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বেড়েছে। এ পয়েন্টে তিস্তার পানি টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। যা এবার সর্বোচ্চ।

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের পানিবন্দী মানুষের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। পানিবন্দী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাজ চলছে। আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে।’

লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে পারে। ফলে আরও পানি বাড়বে। পরে নেমে যাবে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক বন্যার খোঁজ রাখছি। জেলায় দুর্যোগকালীন ৪৫০ টন চাল ও ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং পিআইওর মাধ্যমে ১১০ টন চাল ‍ও ৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে বরাদ্দ দেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত