Ajker Patrika

হঠাৎ কোটিপতি কৃষক লীগ নেত্রী

কাজী শামিম আহমেদ, খুলনা
Thumbnail image

খুলনা নগরীর খালিশপুরে ১০-১২ বছর আগেও স্বামীর সঙ্গে মুদি ব্যবসা করতেন হালিমা রহমান। পরে সেখান থেকে চলে আসেন নগরীর বয়রার মুজগুন্নি এলাকায়। এরপর মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন তিনি।

খুলনা নগরীতেই হালিমা গড়ে তুলেছেন ৯ ও ৫ তলার দুটিসহ বেশ কয়েকটি ভবন। রাজধানী ঢাকাতেও রয়েছে ফ্ল্যাট। বাগেরহাটের মোল্লাহাটে রয়েছে ৪২ বিঘা জমির ওপর
মাছের ঘের।

খুলনায় কখনো রাজনীতি না করলেও হঠাৎ একদিন কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদ পেয়ে যান হালিমা। তবে, সম্প্রতি পুলিশের কাজে বাধা ও হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ায় দলের ওই পদ হারিয়েছেন তিনি। 

যেভাবে হালিমার উত্থান
হালিমার একসময়ের সহযোগীরা জানান, সুশ্রী হালিমা একসময় মুদিদোকানের ব্যবসার বাইরে বিত্তবানদের নজর কাড়তে শুরু করেন। খালিশপুর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গেও তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ওই সময় খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মফিজুর রহমান পলাশ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঠিকাদারি কাজ করতেন। এই সুযোগটি নেন হালিমা। একপর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তার সহযোগিতায় কেএমপিতে খাদ্য সরবরাহের ঠিকাদারি শুরু করেন হালিমা। পুলিশের ওই কর্মকর্তার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, ব্যাংকার এবং কিছু রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তবে তাঁদের অনেককেই হালিমা ব্ল্যাকমেল করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

হালিমার অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকা একটি সূত্র জানায়, সখ্য থাকা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময় কয়েকজন তরুণীর মাধ্যমে ব্ল্যাকমেল করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন হালিমা। এমনকি নিজে বিয়ের ফাঁদে ফেলেও টাকা হাতিয়ে নিতেন। এ পর্যন্ত তিনি সাতটি বিয়ে করেছেন বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুজগুন্নি এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, মুজগুন্নি এলাকায় এসে হালিমা হাউজিং এস্টেটে পাঁচ কাঠা জমি কেনেন। ওই জমির ওপর নয়তলা বাড়ি করেন। একই এলাকায় রয়েছে পাঁচতলা আরও একটি বাড়ি। এ ছাড়া নগরীর গোয়ালখালীতে বাড়ি ও মুজগুন্নি হাউজিং এস্টেটে তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে।

নাম না প্রকাশের শর্তে খুলনা হাউজিং এস্টেটের একজন কর্মকর্তা জানান, হালিমা রহমান ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর খালিশপুর হাউজিং এস্টেটের ডি-ব্লকে পাঁচ কাঠার প্লটটি নিজের নামে কেনেন। এখন সেখানকার প্রতি কাঠা জমির দাম ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা।

এলাকাবাসী জানান, হালিমা মুজগুন্নি বাস্তুহারা এলাকায় মাদকের একটি সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিতেন পলাশ হাওলাদার। তাঁর অধীনে ছিল ৪০-৫০ জনের একটি বাহিনী।

মুজগুন্নি বাস্তুহারা এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক বাবলু বলেন, ‘হালিমাকে কোনো দিন রাজনীতি করতে দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ করে শুনি সে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তার ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খোলে না।’

আওয়ামী লীগ নেত্রী ও কেসিসির প্যানেল মেয়র মেমরি সুফিয়া রহমান শুনু বলেন, ‘হালিমা রহমান বাস্তুহারা এলাকায় মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর অসামাজিক কর্মকাণ্ডে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তাকে ফাঁদে ফেলে অযাচিত স্বার্থ হাসিল করতেন তিনি। ব্যাংকের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের চেক লিখে নেন। সালিস-দরবার করে সেই টাকা আদায়ও করেছেন হালিমা।’

খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শুনেছি বাস্তহারার নয়তলা ভবনে অসামাজিক কার্যকলাপ আগে হতো। আমি যোগদান করার পর এসব বন্ধ হয়ে যায়।’

কেসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মফিজুর রহমান পলাশ বলেন, ‘হালিমা আমার ৩-৪ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। হালিমার সঙ্গে বর্তমানে কোনো সম্পর্ক নেই।’ 

পুলিশের কাজে বাধা ও হামলা
১১ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামিদের ধরতে মুজগুন্নি বাস্তুহারা এলাকায় হালিমা রহমানের বাসায় অভিযানে যায় পুলিশ। সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পেয়ে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু তাঁদের পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হামলা চালান হালিমাসহ বেশ কয়েকজন। এ সময় আহত হন পুলিশের নয়জন সদস্য। অন্যদিকে পালিয়ে যান মামলার অন্যতম আসামি পলাশ হাওলাদার। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে। এ সময় হালিমা ও তাঁর ১৫ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে, হালিমাকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর শাস্তির দাবিতে ১৫ জুলাই খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন নগরীর খালিশপুর এলাকার বাসিন্দারা। 
খালিশপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের কাজে বাধা ও হামলার ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। হালিমার সম্পর্কে ওঠা সব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। তাঁর সম্পদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত