Ajker Patrika

মনিরামপুরে আমনচাষির স্বপ্ন পানির নিচে

আনোয়ার হোসেন, মনিরামপুর (যশোর) 
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪: ১৬
মনিরামপুরে আমনচাষির স্বপ্ন পানির নিচে

এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় অন্যের জমি ইজারা নিয়ে সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মামুদকাটি গ্রামের চাষি শফিকুল ইসলাম। কয়েক দিন আগের ভারী বৃষ্টিতে তাঁর পুরো আমনখেত পানিতে তলিয়ে গেছে। রোদে কিছুটা পানি টেনে যাওয়ার পর এখন পচে যাওয়া ধানগাছ ফিকে হয়ে ভেসে উঠছে খেতে।

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিজের জমি নেই। সমিতি (এনজিও) থেকে লোন তুলে ৩২ হাজার টাকায় সাড়ে ৫ বিঘা জমি লিজ নিছি। এক বিঘা নিছি ধানের ওপরে। ধান উঠলে এই বাবদ মালিককে সাত মণ ধান দিতে হবে। সাড়ে ছয় বিঘা জমি চাষ, রোপণ ও সার-কীটনাশক দিতে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করিছি। ধান রোপণের পর তিনবার পানিতে তলাইছে। এবারের বৃষ্টিতে তলায়ে ছয় বিঘা ধানগাছ পচে শেষ হয়ে গেছে। সমিতির লোন শোধ করব কী করে আর জমির মালিকেরে বা ধান দেব কীভাবে—এসব কথা মনে উঠলে মনে হয় বুক ফেটে মারা যাব।’

উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর মাঠে চার বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন কৃষক নাজিম উদ্দিন। এর মধ্যে তিন বিঘা জমির ধান কোমরপানিতে ডুবে পচে গেছে। 

মনিরামপুরে পানির নিচে পচছে আমন খেত। ছবি: আজকের পত্রিকাএকই অঞ্চলের মামুদকাটি ও টেংরামারী বিলে নিজের ছয় বিঘা জমিতে আমনের চাষ করেছেন কৃষক আমির হোসেন। তাঁর চার বিঘা ধান তলিয়ে পচে ভেসে উঠেছে।

এই কৃষক বলেন, ‘তিনবার বৃষ্টির পানিতে আমন ধান তলাইছে। প্রথমবার নষ্ট হয়ে কিছু গাছ বেঁচে ছিল। পানি টানার পর সেখানে নতুন চারা রোপণ করেছিলাম। পরেরবার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে অর্ধেক গাছ পচে গেছিল। এবার পুরোটাই পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এই বিলে চাষির ১২০ থেকে ১৫০ বিঘা জমির ধান পানির নিচে পচে গেছে।’

মামুদকাটি গ্রামের চাষি নূর আলম ১২ কাঠা জমি ভাগে নিয়ে আমন চাষ করেছেন। সেই ধান ১০ দিন ধরে পানির নিচে পড়ে আছে। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির পরপরই ধানখেতে প্রচুর শেওলা জন্মেছে, যার জন্য ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। ধান না হলেও খেতের মালিকের ভাগেরটা শোধ করতে হবে।’ 

শুধু শফিকুল, আমির, নূর আলম বা নাজিমের নয়, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে আমন ধান তলিয়ে মনিরামপুর উপজেলার অন্তত ২৪ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস।

উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, মনিরামপুরে চলতি আমন মৌসুমে ২২ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। গত ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বরের ভারী বৃষ্টিতে ৬ হাজার ৭৪২ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে, যার মধ্যে ৪ হাজার ৪৬৭ হেক্টর জমিন ধান তলিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমির ধান। 

উপজেলার মামুদকাটি, রঘুনাথপুর, খড়িঞ্চি, খেদাপাড়া, রোহিতা শেখপাড়া, বাগডোব, ইত্যা, কাশিমনগর, ঢাকুরিয়া, জয়পুর, শ্যামকুড়, হরিদাসকাটি, চালুয়াহাটি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বিলে পানি জমে আমনখেত তলিয়ে আছে। বিলের পানি অপসারণের জন্য যেসব খাল বা নালা আছে, সেগুলোর মুখ অনেক জায়গায় বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে পানি সরতে না পেরে খেতে আটকে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। ধানগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খেতের মালিকের পাওনা শোধ দেওয়া নিয়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ প্রান্তিক চাষিদের।

বৃষ্টি থামার কয়েক দিন পরও মাঠজুড়ে তলিয়ে আছে আমনখেত। ছবি: আজকের পত্রিকাকৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে মনিরামপুরে বেশির ভাগ আমন চাষি দুর্যোগ সহিষ্ণু ব্রি-৫১ জাতের ধান চাষ করে আসছেন। জলাবদ্ধতায় দুই-চার দিন ডুবে থাকলেও এই জাতের ধানে তাতে তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু এবারের বৃষ্টিতে তিনবার ধান ডুবেছে। শেষবার জমিতে সার ব্যবহারের পরপরই বৃষ্টি হওয়ায় তলিয়ে গিয়ে ধানগাছ পচে গেছে। তা ছাড়া শেষ বৃষ্টির পরে ৮-১০ দিন পার হলেও এখনো ধানগাছ পানির নিচে। এসব জমিতে ধানের আর আশা করা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরি করে সরকারি সহায়তার দাবি তাঁদের। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, ‘শেষের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় আমনচাষি বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। যেসব জমিতে ধানগাছ পানির নিচে, ওই ধান আর হবে না। এতে করে মনিরামপুরে এবার আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত