Ajker Patrika

বাড়িয়ে দেওয়া হাত

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২: ১১
বাড়িয়ে দেওয়া হাত

সূর্য পুবাকাশে উঠলেই যে সবার হৃদয়েও পৌঁছে যাবে তার আলো, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। খলিলুর রহমান প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই চলে আসেন চন্দ্রিমা উদ্যানে, থাকেন সকালের অনেকটা সময়। কিন্তু সূর্যের আলো তাঁর কাছে উজ্জ্বল কোনো বার্তা নিয়ে আসে না। সামনের দিকে পেতে রাখা হাত ভাগ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। কখনো দুবেলা খাবার জোটার মতো অর্থ সংগ্রহ হয়, কখনো হয় না। তা নিয়ে এখন আর আক্ষেপ করেন না। আকাশের দিকে তাকিয়ে কাউকে অভিশাপও দেন না।

সকালের ক্রিসেন্ট লেকে স্বাস্থ্যোদ্ধারে ব্যস্ত মানুষের ভিড়। মাস্ক আছে অনেকের মুখে, অনেকেরই নেই। কোত্থেকে মাস্ককে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলার এতটা সাহস পেয়ে গেছে মানুষ, কে জানে! জায়গায় জায়গায় কাপড় টানিয়ে ব্যায়ামের দলগুলো তাদের নাম প্রচার করছে, সেখানে ব্যায়াম করছে। সবার জন্য উন্মুক্ত এ শারীরিক কসরত—সে কথাও লেখা আছে কোথাও কোথাও।

শরীর মজবুত করার জন্য এই মাঠে হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম, দৌড়—সবকিছুই চলছে, কিন্তু তাতে খলিলুর রহমানের ভেঙে পড়া শরীরে শক্তি আসে না। এবং তিনি তা মেনে নিয়েছেন। তবে একটা আশা এখনো মনকে স্বপ্ন দেখায়—সে কথা বলব শেষে।

লাঠিতে ভর করে এক হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন খলিলুর রহমান। নাম জিজ্ঞেস করার পর দ্বিতীয় প্রশ্নটা হয় বয়স নিয়ে। 
‘আশি হইব মনে হয়।’ 
‘এখানে প্রতিদিন আসেন?’ 
‘এখানে না আইলে খাওন জুটব কই থিকা?’ 
‘বাড়িতে কেউ নেই?’ 
‘বউ আছে।’ 
‘কোথায় থাকেন?’ 
‘মোহাম্মদপুর সি ব্লক।’ 
সি ব্লকটা আসলে ঠিক কোন জায়গায়, জানতে চাইলে অস্পষ্ট উত্তর দেন তিনি। বলেন, বিহারিদের জন্য যে কোয়ার্টার বানিয়ে দিয়েছে সরকার, তারই একটায় ভাড়া থাকেন বুড়োবুড়ি। তাঁরা বিহারি নন। 
‘কত টাকা ভাড়া দেন?’ 
‘দুই হাজার দুই শ টাকা। পায়খানার জন্য আরও পঞ্চাশ।’ 
‘মানে? বাড়িতে টয়লেট নেই?’ 
‘না, বাইরে আছে।’ 
বাড়িটার ধরন কল্পনা করেও কোনো কূল-কিনারা করা গেল না।
‘কেউ সাহায্য করার নেই?’
‘না। তিন মেয়েরে বিয়া দিতে গিয়া ফতুর হইয়া গেছি। জায়গাজমি যা ছিল, সব বিক্রি হয়ে দিতে হইসে।’ 
‘আপনার বাড়ি ছিল কোথায়?’ 
‘মুন্সিগঞ্জে। নদীভাঙনে বাড়ি হারানোর পর ঢাকায় চইলা আইছি। বাড়িঘর নাই। সে বহু আগের কথা।’ 
কথা বলতে বলতে খলিলুর রহমানের মনে হয়, বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা এ মুহূর্তে কোনো কাজে আসবে না। তাই প্রথমবারের মতো তাঁর হাতটা সোজা হয়ে শরীরের একপাশে ঝুলে থাকে। 
‘কী খাওয়াদাওয়া করেন?’
‘ভাত, ডাইল আর সবজি। মাছ-মাংস খাই না।’
শেষ বাক্যটার অর্থ দুই রকম হতে পারে। মাছ-মাংস কেনার সামর্থ্য নেই বলে খান না, অথবা খেতে পছন্দ করেন না। খলিলুর রহমানের কাছে সে প্রশ্ন তুলতে সংকোচ হয়। 
‘জীবনটা কেমন? 
‘জীবন মানেই তো কষ্ট। ভাগ্যটাই এই রকম। এটা ছেলে ছিল, বাইরে পাঠাইছিলাম।’ 
জীবনের গল্পটা অন্যদিকে মোড় নেবে কি না, তা জানার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকি। 
‘আপনার ছেলেকে কোথায় পাঠিয়েছিলেন?’
‘দুবাইতে?’ 
‘তারপর? ছেলের রোজগার?’ 
‘টাকাপয়সা কিছুই রোজগার করতে পারে নাই। যে কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে গেসিলো, তা মামলা খেয়ে কাজ বন্ধ কইরা দিছে। দেশে ফিরে আসছে আমার ছেলে।’ 
‘সে সাহায্য করে না?’ 
‘সে তো থাকে মুন্সিগঞ্জ।’ 
‘আপনি না বললেন, মুন্সিগঞ্জে আপনার কিছু নাই?’ 
‘আমার নাই। ও শ্বশুরবাড়িতে থাকে।’
‘ও কি আপনাকে সাহায্য করতে পারে না?’ 
‘করে তো টুকটাক। পারে না।’ 
‘যদি পারত, তাহলে করত?’ 
একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে খলিলুর রহমানের মুখ। ‘নিশ্চয়ই করত। আমার ছেলে না? ও একটু দাঁড়াইতে পারলে আমাদের এত কষ্ট থাকবে না।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত