Ajker Patrika

‘মানুষ যা চায় সব কি পায়?’

অর্চি হক, ঢাকা
‘মানুষ যা চায় সব কি পায়?’

রাজধানীর প্রথম সারির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন নাদিরা বেগম। স্বামী-সন্তান, নিজের ঘরবাড়ি—সবকিছু থেকেও যেন কিছুই নেই তাঁর। পরিবার ছেড়ে প্রবীণ নিবাসে একাকী ঈদ করছেন তিনি। আজকের পত্রিকাকে নাদিরা বেগম বললেন, ‘স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর সব এলোমেলো হয়ে গেল। ছেলেটা সৎ মায়ের কাছে থেকে মানসিক ভারসাম্য হারাল। আর মেয়ে নিজেই সাবলেটে থাকে, আমাকে রাখবে কীভাবে?’ 

 ২০১৫ সাল থেকে প্রবীণ নিবাসে আছেন নাদিরা বেগম। মুঠোফোনে আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে কথা বলে আর পুরোনো দিনের ছবি দেখে ঈদ কাটছে তাঁর। তবে প্রবীণ নিবাসের আরেক বাসিন্দা শেখ মুজিবুল হকের কপালে এই সুখটুকুও জোটেনি। কারণ তাঁর নিজের মুঠোফোনও নেই। ছেলেমেয়ে কাউকেই ঈদের শুভেচ্ছাটুকুও জানাতে পারেননি ৮২ বছরের এই বৃদ্ধ। পরিবারের কেউ আসবেন কিনা তাও নিশ্চিত নন তিনি। তবে কষ্টের অনুভূতিগুলো সযত্নে লুকিয়ে রাখলেন অবসরপ্রাপ্ত এই প্রিন্সিপাল। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ঈদটাকে এত বড় করে দেখতে হবে কেন। এটাও তো একটা দিনই। এখানে সবাই আছে, এদের সঙ্গেই তো প্রায় ২৭ বছর ধরে আছি। আজও এদের সঙ্গেই থাকব।’ 

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ নিবাসে এ রকম ২৯ বাসিন্দার ঈদ কাটছে এবার। প্রবীণ নিবাস কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য ঈদে বিশেষ খাবার দাবারের আয়োজন করেছে। সকালে দেওয়া হয়েছে সেমাই। দুপুরের পোলাও-রোস্টসহ নানা পদ। নিবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মীরা দুপুরে প্রবীণদের সঙ্গে খাবার খেয়েছেন। 

বয়সের ভারে জীবন থেমে গেছে, অপেক্ষা কেবল শেষের দিনেরঈদের দিনে প্রবীণ নিবাসের এই বাসিন্দাদের কেউ আছেন পরিবারের সদস্যদের আসার অপেক্ষায়, কেউ আবার ধরেই নিয়েছেন কেউই আসবে না তাদের দেখতে। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। নিবাসের চারতলার একটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, এক ছেলে তাঁর মাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। সংগত কারণেই মা-ছেলে কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে চাইলেন না। প্রবীণ নিবাস বলতে যে গল্পগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেগুলোও এই মা-ছেলের সঙ্গে মেলে না। 

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। রামপুরা সরকারি প্রজেক্টে তাদের বাড়িসহ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বিনিময়ে তাদের টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৪ বছরেও কিছুই পাননি তাঁরা। এই মায়ের মেয়ে থাকেন কানাডায়। ছেলে থাকতেন যুক্তরাজ্যে। ২০১৫ সালে মায়ের অসুস্থতার কারণে দেশে আসেন ছেলে। মায়ের কাছাকাছি থাকতে এরপর আর বিদেশে ফেরেননি। কিন্তু দেখাশোনার লোক না থাকায় মাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় রাখতে পারছেন না। প্রবীণ নিবাসে অনেক মানুষের মাঝে মা ভালো থাকেন, তাই এখানেই তাঁর আপাত ঠিকানা। প্রতিদিন এসে ছেলে মায়ের সঙ্গে থাকেন, সময় কাটান। 

ঈদের মতো উৎসব এলেই একটু হাসি মুখে ফোটে প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের। তবে আনন্দের সঙ্গে থাকে বিষাদওসোহেলি আক্তার নামের আরেক বাসিন্দা জানালেন, মেয়েরা বিদেশে থাকেন। সেখানে তাকে নিয়েও গিয়েছিলেন মেয়েরা। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারায় প্রবীণ নিবাসেই থাকছেন তিনি। 

ঈদের দিন কেমন যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ নিবাসের অধিকাংশ বাসিন্দাই জানালেন, সবার যেমন কাটে তেমনই। এখানে আনন্দেরও কিছু নাই। কষ্টেরও কিছু নাই। তবে নাদিরা বেগমের কথাটা আলাদা করে দাগ কেটে গেল, ‘মানুষ যা চায়, সব কি পায়? আমরাও যেমনটা চেয়েছিলাম সে রকমটা হয়তো হয়নি। এটাই আমাদের ভাগ্য।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত