Ajker Patrika

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল

স্কুল ভবনটা খাঁচার মতো এতেই প্রাণহানি বেড়েছে

  • ছিল না জরুরি বের হওয়ার পথ।
  • আগুন আর ধোঁয়ায় পরিবেশ ছিল দমবন্ধকর।
  • বারান্দাগুলোও লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো।
আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১২: ২৭
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

রাজধানীর দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনটির কাঠামোই দৃশ্যত সোমবারের বিপর্যয়কে এতটা প্রাণঘাতী করে তুলেছে। সরেজমিন ঘুরে এবং ভুক্তভোগী অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে।

মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি শাখার মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পরই দেখা গেছে একটি টেনিস কোর্ট ও ক্যানটিন। এরপরই হায়দার আলী ভবন। পশ্চিমমুখী হায়দার আলী ভবনটি দোতলা। তবে দ্বিতীয় তলার ছাদটি টিনের ছাউনির। দোতলা ভবনটির মাঝ বরাবর সিঁড়ি, দুই পাশে কক্ষ। নিচতলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং ওপরতলায় পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের পাঠদান চলে। প্রতিটি ক্লাসে ৩৫-৪৫ জন শিক্ষার্থী। দুটি তলায় মোট ১৬টি শ্রেণিকক্ষ থাকলেও ভবনে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ একটাই। ছিল না অগ্নিকাণ্ডের মতো বিপর্যয়ের সময় বের হওয়ার জরুরি পথ। বারান্দাগুলোও লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো।

একজন শিক্ষক এই প্রতিবেদককে ভবনের শ্রেণিকক্ষগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, ভবনটির নিচতলার বাঁ দিকে সিঁড়ির পাশেই শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষ। এরপরই পরপর পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ। সেখানে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি ও বাংলা ভার্সনের পাঠদান হয়। এরপর একটি ওয়াশরুম। একটু আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সঙ্গে চলে গিয়েছিল। কিছু শিক্ষার্থী ছিল মা-বাবার অপেক্ষায়। কিছুসংখ্যক রয়ে গিয়েছিল কোচিংয়ের জন্য। নিচতলার ডান দিকে প্রথমে একটি ওয়াশরুম, এরপর ভাইস প্রিন্সিপালের অফিস। তার পাশেই ইংরেজি ভার্সনের সমন্বয়কারী মাহরীন চৌধুরীর কক্ষ। ২০টি শিশুকে বাঁচিয়ে যিনি প্রাণ দিয়েছেন। এরপরই মেয়েদের তিনটি শ্রেণিকক্ষ।

দোতলার বাঁ পাশে যথাক্রমে একটি ল্যাব রুম, চারটি শ্রেণিকক্ষ এবং একটি ওয়াশরুম। সেখানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান হয়। দোতলার ডান পাশে প্রথমে একটি ওয়াশরুমের পর পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ। সেখানে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠদান হয়।

বিকল বিমানটি পড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার সময় সব ক্লাসের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ মা-বাবার সঙ্গে বাইরে চলে না যাওয়া অন্য শিক্ষার্থীরা অপেক্ষমাণ ছিল। একাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণিতে পড়া রাহিম তাসকিন আহমেদ সেদিন কিছুটা আহত হয়েছে। আগুনের শিখায় তার দুই কান ঝলসে গেছে। বন্ধু হারানোর বেদনায় কাতর তাসকিন নিজের শারীরিক কষ্ট যেন ভুলেই গেছে। রাহিম গতকাল এসেছিল ঘটনার দিন ফেলে যাওয়া বইয়ের ব্যাগ নিতে। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে বলল, ‘আমাদের ছুটি হয়ে গেছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ায় সবাইকে বের করে দেওয়ার পর আমি বের হই। ব্যাগ কাঁধে তুলব এমন সময় টিনের চালের ওপর আমরা একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনি। পরপর আরও দুইটা বিকট শব্দ হয়। তৃতীয় শব্দটা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। দ্বিতীয় শব্দের পর মিনিটখানেকের মধ্যে কালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। আর তৃতীয় শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই আগুন লেগে যায়। আমি জ্বলন্ত বিমানের পাশ দিয়ে লাফিয়ে বের হই। আমার তিন বন্ধু গায়ে আগুন লেগে মারা গেছে। সেই দৃশ্য আর মনে করতে চাই না!’

ঘটনার সময় স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। তবে কিছু শিক্ষার্থী কোচিং ক্লাস ও অভিভাবকের জন্য অপেক্ষা করছিল। এ ছাড়া শিক্ষক ও স্টাফরাও ছিলেন ভবনের ভেতরে। কয়েকজন শিক্ষক জানান, নিচতলার সিঁড়ির পাশে শিক্ষকদের কক্ষ, যেখানে শিক্ষকেরা অবস্থান করছিলেন।

বাংলা ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিদ মোল্লা বলল, প্রতিদিন ছুটির পর সে ঠিক যে জায়গায় দাঁড়ায়, সেখানেই যুদ্ধবিমানটি পড়েছে। এক বন্ধু ডেকে ক্যানটিনে নিয়ে না গেলে সে হয়তো ওখানেই থাকত।

কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছে, আগুন লেগে যাওয়ার পর আটকে গিয়ে তারা জানালা ও বারান্দার গ্রিলের ভেতর থেকে চিৎকার করতে থাকে। সেনাবাহিনীর দল ও ফায়ার সার্ভিস কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে দোতলার টিনের চাল ও নিচতলার গ্রিল কেটে শিক্ষার্থীদের বের করে।

শিক্ষার্থীরা ছাড়াও গতকাল স্কুলের সামনে যাওয়া কয়েকজন অভিভাবক হায়দার আলী ভবনের কাঠামোগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তাঁদের প্রশ্ন, যেখানে কয়েক শ শিক্ষার্থী একসঙ্গে ক্লাস করে, সেখানে কেন একটিমাত্র প্রবেশপথ থাকবে? শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা বলেছেন, ভবনের বারান্দায় গ্রিল না থাকলে অনেকে হয়তো বের হতে পারত।

রফিক নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘ভবনটি একটা খাঁচার মতো। একটিই প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ। ভবনটি খোলামেলা হলে বাচ্চারা বের হতে পারত। বারান্দাও গ্রিল দিয়ে ঘেরা। তাই নিচতলায় থেকেও অনেকে বের হতে পারেনি।’

এদিকে গতকাল মাইলস্টোন স্কুলের মূল ফটকসহ পাঁচটি প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ভবনের সামনে মোতায়েন করা হয় নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, এমনকি অভিভাবকেরাও প্রবেশ করতে পারেননি। শুধু শিক্ষকদের পরিচয়পত্র দেখে জরুরি সভার জন্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। সংবাদকর্মীদের প্রবেশেও বাধা দেওয়া হয়। চার-পাঁচজন শ্রমিককে হায়দার আলী ভবনের তিন পাশে টিনের বেড়া দিতে দেখা যায়।

গতকাল ভবনের জানালা দিয়ে দেখা গেছে, এখনো পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া বই, টিফিন বক্স, পানির বোতল, ব্যাগ। কিছু ব্যাগ ও বই-খাতা উদ্ধার করে রাখা হয়েছে, যা ধীরে ধীরে অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো আসছে, পে কমিশন গঠন

ব্যাংকে চোখ বেঁধে গ্রাহককে হাতুড়িপেটা, পায়ের নখ তোলার চেষ্টা

‘সোজা কথা, যারে ভালো লাগবে তারে কোপামু’

শুল্ক ছাড়া যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ পেল ভারত

সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে পারে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া—শক্তিতে কে বেশি এগিয়ে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত