Ajker Patrika

‘শাকিব খান আইসা গেলো, ঢাকার শহর দেখেন ভালো’

আব্দুর রাজ্জাক, (ঘিওর) মানিকগঞ্জ
Thumbnail image
বায়োস্কোপে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুপারস্টার নায়ক-নায়িকা, নামী খেলোয়াড়, মুভি সিন ও বিশাল অট্টালিকা দেখছে কয়েক শিশু। গতকাল মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সাংইজুরী কালীগঙ্গার তীরে পার্বণ নবান্ন উৎসব ও গ্রামীণ মেলায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘কী চমৎকার দেখা গেলো, এইবারেতে আইসা গেলো, শাকিব খান আইসা গেলো, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেলো।’ সুরে সুরে এমন বর্ণনা শুনে থমকে যান যে কেউ। দেখেন, কিছু শিশু-কিশোর একটি বাক্সে লাগানো কাচে চোখ গুঁজে আছে। আগ্রহ নিয়ে জানার চেষ্টা ওই বাক্স সম্পর্কে।

হ্যাঁ, এই বাক্সের নাম বায়োস্কোপ। বছর তিরিশেক আগেও গ্রাম-বাংলার মানুষের বিনোদনের একটি মাধ্যম ছিল বায়োস্কোপ। কিন্তু এই অত্যাধুনিক যুগে বিনোদনও বদলে গেছে। তাই বায়োস্কোপ হয়ে গেছে সেকেলে। বলা যায় হারিয়েই গেছে। তাই এমন বর্ণনা শুনলে থমকে যান অনেকে।

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সাংইজুরী কালীগঙ্গাতীরে গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত হয় পার্বণ নবান্ন উৎসব ও গ্রামীণ মেলা। এলাকাবাসীর সহায়তায় উৎসবের আয়োজন করে ইস্পাহানির ব্র্যান্ড ‘পার্বণ’ ও প্রথম আলো ডটকম। সেই উৎসবে দেখা মেলে বায়োস্কোপের। ৪২ বছর বয়সী মো. জামাল উদ্দিন সাভার থেকে গিয়েছিলেন বায়োস্কোপ দেখাতে। আর দিনভরই বায়োস্কোপে চোখ রেখে বিনোদিত হয়েছে শিশু-কিশোরেরা।

কাঠের বাক্স থেকে চোখ সরিয়ে যেন ঘোর কাটে না। কীভাবে এই বাক্সে ছবি যায়, গান বাজে—এমন নানা প্রশ্ন শিশুদের মনে। পাশেই আরও জনাদশেক শিশু-কিশোর ছিল বায়োস্কোপ দেখার অপেক্ষায়।

রাথুরা গ্রামের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া জেবীন নামের এক শিশু উৎফুল্ল চিত্তে বলে, ‘এবারই প্রথম বায়োস্কোপ দেখলাম। অনেক ছবি আর জোকার কাকুর গান ভালো লেগেছে। আবারও দেখব।’

হ্যাঁ, বায়োস্কোপওয়ালা জামাল উদ্দিনের পরনে ছিল রংবেরঙের পোশাক। মাথায় রঙিন চুল। মুখে কৌতুকাবহ মুখোশ। হাতে খঞ্জনি বাজিয়ে প্রতিটি ছবির সুরেলা বর্ণনা দিচ্ছিলেন জামাল। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরে। সাভারের একটি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। আশপাশের বিভিন্ন করপোরেট অফিসের আয়োজনে ডাক পড়ে তাঁর। এ ছাড়া বিভিন্ন মেলাতেও যান।

বায়োস্কোপ দেখে কেমন লাগল—এমন প্রশ্নে বিপু, ফারহীম, স্নেহা নামের খুদে শিশুরা হেসে কুটিকুটি। সমস্বরে তারা বলে, খু-উ-ব ভালো লাগছে। প্লে শ্রেণির এই শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা সেই দৃশ্য মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করে রাখেন।

এই উৎসব ও গ্রামীণ মেলা উদ্বোধন করেন বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল খান। শিশুদের এমন খুশি দেখে রোমন্থন করেন নিজের স্মৃতি। তিনি বলেন, ‘শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই। নব্বইয়ের দশকের দিকে, আমাদের গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি, ছিল না টেলিভিশন। তখন আমাদের আনন্দের একটি মাধ্যম ছিল বায়োস্কোপ।’

মূলত জামাল উদ্দিনের বাবা দেখাতেন বায়োস্কোপ। বাবার হাত ধরেই তিনি বায়োস্কোপ দেখানোর পেশায় নেমে পড়েন। বাবা মারা গেছেন, কিন্তু জামাল ছাড়তে পারেননি বায়োস্কোপের নেশা। তাই ডিজিটাল যুগেও বয়ে বেড়ান চারকোনা কাঠের এ বাক্স।

জামাল বলেন, তাঁর বায়োস্কোপে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুপারস্টার নায়ক-নায়িকা, নামী খেলোয়াড়, মুভি সিন, বিশাল অট্টালিকা, ঝরনা, পাহাড়-পর্বতের ছবি আছে। আগে দেখানো হতো দেশের নামকরা বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ছবি, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, রাম-লক্ষ্মণের যুদ্ধ, স্বর্গ ও নরকের কাল্পনিক চিত্র, রাজনৈতিক ব্যক্তি, মক্কা-মদীনাসহ আরও কয়েকটি স্থিরচিত্র। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবিও পাল্টাতে হয়েছে। তাঁর বায়োস্কোপে চারজন একসঙ্গে দেখতে পারে। এতে ৪০টি ছবি লাগানো হয়েছে। ৫ থেকে ১০ মিনিট দেখানো হয় বায়োস্কোপ। একবারের জন্য সাধারণত ১০-২০ টাকা নেন। তবে খুশি হয়ে অনেকে বকশিশ দেন। আর বায়োস্কোপ দেখিয়েই চলে তাঁর চার সদস্যের সংসার।

স্থানীয় বানিয়াজুরী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান মোল্লা বলেন, এখন আর গ্রামের মেঠো পথে মেলায় বায়োস্কোপ আসে না। বায়োস্কোপওয়ালার পিছে পিছে দৌড়ে ছুটে চলি না। ভীষণ মনে পড়ে সেই স্মৃতিগুলো।

মেলা আয়োজকদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইস্পাহানির উপমহাব্যবস্থাপক এইচ এম ফজলে রাব্বি বলেন, ‘বায়োস্কোপ আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্যই এবারের মেলায় বায়োস্কোপ নিয়ে আসা হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত