Ajker Patrika

প্রত্যাবাসন বিরোধীরাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত

কক্সবাজার ও উখিয়া প্রতিনিধি
প্রত্যাবাসন বিরোধীরাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরানোর জন্য কাজ করছিলেন তাদের নেতা মো. মহিবুল্লাহ। এ জন্যই প্রত্যাবাসনবিরোধী মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সেলভ্যশন আর্মি) তাঁকে খুন করেছেন বলে মনে করেন তাঁর ভাই মৌলভি হাবিবুল্লাহ। হত্যাকাণ্ডে জড়িত কয়েকজন আরসা নেতার নামও বলেছেন তিনি। পুলিশও মনে করছে, এটা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধীদের কাজ।

তবে আরসা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা অডিওবার্তায় তারা বলেছে, আরসার এমন কোনো দায় পড়েনি যে মহিবুল্লাহকে খুন করতে হবে। কে না কে মহিবুল্লাহ মাস্টারকে খুন করেছে, এখন তাঁর ছোট ভাই সেই দায় আরসার ওপর চাপাতে চাইছেন।

রোহিঙ্গা নেতাকে এভাবে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এইচআরডব্লিউসহ পশ্চিমারা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন মহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গা স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় তিনি। গত বুধবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার লাম্বুশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে নিজ সংগঠনের কার্যালয়ে বসে আলাপ করছিলেন মহিবুল্লাহ। এ সময় খুব কাছ থেকে পরপর ৫টি গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। আততায়ী দলে ছিল ১৫ থেকে ২০ জন।

মহিবুল্লাহর ছোট ভাই মৌলভি হাবিবুল্লাহ গতকাল বৃহস্পতিবার জানান, তাঁর ভাইকে যখন গুলি করা হয়, তখন তিনিও সেখানে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরসা নেতা আবদুর রহিম, মোরশিদ, লালুসহ কয়েকজনের নাম প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সামনে আনা হলে তাদের আমি চিনব।’ টুইটারে প্রচারিত এক ভিডিওতে তিনি এ কথা বলেন।

হাবিবুল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ভাই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক মহলে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন। এ জন্য রোহিঙ্গাদের একটি গোষ্ঠী তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী শক্তি তাঁকে খুন করেছে।’

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিকভাবে মোতায়েন আছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকায় রোহিঙ্গাদের মাঝে জনপ্রিয় ছিলেন মহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গা প্রত্যাসন নিয়ে তিনি কাজ করছিলেন। এ জন্য প্রত্যাবাসনবিরোধীরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।’ তিনি জানান, পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

থমথমে শিবির
মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা শিবিরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ভয় ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গার মধ্যে। মৌলভি হাবিবুল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরও তাঁরা সবাই ভয়ের মধ্যে আছেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আরসা তাঁদের হুমকি দিচ্ছে।

দুজন প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাম্পের প্রত্যাবাসনবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত মাস্টার আবদুর রহিম মুর্শিদ, লালুসহ কয়েকজন।

স্থানীয় রোহিঙ্গারা জানান, কয়েক মাস ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মহিবুল্লাহকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করে আসছে। গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নির্যাতনের চার বছর পালনের সময় মহিবুল্লাহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবি তুলে সাক্ষাৎকার দেন। এরপর থেকেই তারা মহিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে আসছিল। 

হোয়াইট হাউসে মহিবুল্লাহ
২০১৯ সালের ১৭ জুলাই রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় আসেন মহিবুল্লাহ। এ সময় তিনি দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান।

এর আগে তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের ফুটবল মাঠে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গার গণহত্যাবিরোধী যে মহাসমাবেশ হয়েছিল, তা সংগঠিত করেছিলেন মহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মহিবুল্লাহ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মিয়ানমারে থাকতে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। গণহত্যাবিরোধী ওই সমাবেশ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিলেন এই রোহিঙ্গা নেতা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সেই সময় বাস্তুচ্যুত অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ দেশে এসেছিলেন মহিবুল্লাহ ও তাঁর পরিবার। বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
 
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগ
মহিবুল্লাহ হত্যার তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শরণার্থীসহ ক্যাম্পে থাকা সব মানুষ, রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি উভয় অংশের নাগরিক অধিকার আন্দোলনকর্মী, মানবাধিকারকর্মীদের অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।

মহিবুল্লাহ তাঁর কাজের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে হত্যার হুমকি পেয়ে আসছিলেন বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি বিবৃতিতে বলেছে, যাঁরা শিবিরে মুক্তি এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, মহিবুল্লাহর হত্যা তাঁদের জন্য একটি নিদর্শন যে তাঁরা কি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন?

টুইট করে জাতিসংঘে মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি, ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আন্নে ভেন লিউইন, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার-এসভেন্ডসেনসহ অনেকে মহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বিবৃতি দিয়ে মহিবুল্লাহর মৃত্যুতে গভীর শোক ও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে আহ্বান জানিয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ক্যাম্প এলাকাতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে সেখানে সংঘাতের আশঙ্কা যে বাড়ল, এটা বলা যায়।’

জানাজায় মানুষের ঢল
গতকাল সন্ধ্যায় উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে কবরস্থানে নিহত মহিবুল্লাহর দাফন সম্পন্ন হয়। তার আগে অনুষ্ঠিত জানাজায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। গতকাল বৃহস্পতিবার বাদ আসর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১ ইস্টের ২ নম্বর কেন্দ্রে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কেন্দ্রের আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত ঘটে। কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধিকে জানাজার স্থলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, ‘উখিয়া লম্বাশিয়া ক্যাম্পে জানাজা শেষে মহিবুল্লাহর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে যেকোনো বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বেনজীরের এক ফ্ল্যাটেই ১৯ ফ্রিজ, আরও বিপুল ব্যবহার সামগ্রী উঠছে নিলামে

ছেলের লাশ পেতে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে

ই-মেইলে একযোগে ৫৪৭ ব্যাংক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত, পুনর্বহালের দাবি

সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের মারধরের প্রতিবাদে সিপিবি-বাসদের ওয়াকআউট

এইচএসসির স্থগিত ২২ ও ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষা একই দিনে: শিক্ষা উপদেষ্টা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত