Ajker Patrika

৭৫ বছর ধরে ‘নিজেকে খুঁজছে’ পাকিস্তান

মারুফ ইসলাম
৭৫ বছর ধরে ‘নিজেকে খুঁজছে’ পাকিস্তান

স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে পা দিল পাকিস্তান। দিনটি পাকিস্তানিদের কাছে ঐতিহাসিক নিঃসন্দেহে, একই সঙ্গে নিজেকে খুঁজে ফেরার দিনও। যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তান, সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-আদর্শ পূরণ হয়েছে কি? পেয়েছে কি নিজস্বতার দেখা? দীর্ঘ ৭৫ বছর পাড়ি দিয়ে এসে এসব প্রশ্ন এখন দানা বাঁধছে দেশটির অনেকেরই মনে। 

পাকিস্তানকে স্বাধীনতা এনে দেওয়া মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা যান ১৯৪৮ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রতি বছরই মহা ধুমধামে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করছে পাকিস্তান। কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জিন্নাহ দেশটি স্বাধীন করেছিলেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাকিস্তান বহু দূরে সরে গেছে বলে মনে অনেক বিশ্লেষক। 

পাকিস্তানের সাংবাদিক ও বিশ্লেষক উমাইর জামাল যেমনটা বলেছেন—‘সাত দশক পাড়ি দিয়ে এসেও পাকিস্তান ‘‘ইন্ডিয়া সিনড্রোম’’ থেকে বের হতে পারেনি। আগেও ভারতকে চিরশত্রু জ্ঞান করত পাকিস্তান, এখনো করে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস মানেই নেতাদের ভারতবিরোধী বাগ্মিতা।’ 

পাকিস্তান তার ইতিহাসও ভুলে গেছে বলে মনে করেন ফরাসি বিশ্লেষক আর্নেস্ট রেনান। তিনি পাকিস্তানিদের বলেছেন, ‘ইতিহাস ভুল করা জাতির অংশ’। 

রেনানের মতে, সাত দশক ধরে পাকিস্তানের স্কুলগুলোতে ভুল ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে। অষ্টম শতাব্দীতে মুহম্মদ বিন কাসেম আক্রমণ করে সিন্ধু প্রদেশ দখল করে নিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমেই নাকি পাকিস্তানের উৎপত্তি! পাকিস্তানের শিশুদের বইয়ে এসব ইতিহাসই পড়ানো হয়। 

জিন্নাহ নিশ্চয় এমন দেশ চাননি। এমনকি তিনি এমন রাষ্ট্রও চাননি, যার আইন ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকুক। অথচ বিতর্কটি আজ অবধি চলছে। অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন, পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে জিন্নাহর কৌশলগত ভুলের কারণে। 

ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের

পাকিস্তানকে স্বাধীন করার একমাত্র কৃতিত্ব জিন্নহরই। কারণ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরু একটি অখণ্ড ভারতই চেয়েছিলেন, যে ভারত উদারচিত্তে সব ধর্মের মানুষকে গ্রহণ করবে। কিন্তু সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অখণ্ডতার পরিবর্তে ভারত বিভাজনের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারত ধর্মের ভিত্তিতেই ভাগ হোক। 

জিন্নাহর দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই পরে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়। তবে ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম হলেও পাকিস্তানের ইসলামি পরিচয় দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেনি। আজ এত বছর পরও দেশটি ধর্মের মতো স্পর্শকাতর সুতো ধরে বিভক্ত। সেখানে ইসলামি দল যেমন আছে, তেমনি চরম ডানপন্থী গোষ্ঠীও আছে। 

১৯৭৩ সালের সংবিধান অনুসারে পাকিস্তান চলার কথা থাকলেও দেশটির প্রকৃত রাষ্ট্রক্ষমতা থাকে অন্য কোনো শক্তির হাতে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সংসদের ওপর রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ভর করে না। রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ভর করে কতিপয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ওই সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। 

 

ইতিহাস ভুলে যাওয়া এই জাতি এখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকায় সংসদ কার্যত ভেঙে পড়েছে। হাজার হাজার মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকায় দেশটির বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমলাতন্ত্র গভীরভাবে রাজনীতিকে গ্রাস করে ফেলেছে। 

নজিরবিহীন এই অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হয়ে পাকিস্তান

দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব পালনের চেয়ে রাজনীতি পরিচালনা করায় বেশি আগ্রহী ও উৎসাহী। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দশকের পর দশক ধরে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গোটা জাতির ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছে। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘সেনাবাহিনীর পুতুল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। করাচির রাজনৈতিক বিশ্লেষক তৌসিফ আহমেদ খান গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইমরান খান হচ্ছেন একটি সামরিক রাষ্ট্রের বেসামরিক মুখ।’ 

এসব রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশটিতে বাড়ছে জঙ্গিবাদের বিস্তার। দেশটির সমাজের পরতে পরতে উগ্র জঙ্গিদের মতাদর্শ গভীরভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে। মালালা ইউসুফজাইকে এখনো ভুলে যায়নি মানুষ। পাকিস্তানের ইতিহাসে জঙ্গিবাদের দগদগে ক্ষত হয়ে নামটি আজও রয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৯ নভেম্বর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে উগ্রবাদীরা তাঁর মাথায় গুলি করেছিল। 

সেই অবস্থা থেকে পাকিস্তানের জাতিগত মানসিকতা আগের চেয়ে অনেক বেশি অসহিষ্ণু, পশ্চাৎপদ ও উগ্র হয়েছে। সত্যিকার অর্থে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংকট এখন বাইরের চেয়ে দেশের অভ্যন্তরেই বেশি। 

এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে আছে অর্থনৈতিক দুরবস্থা। অধুনা পাকিস্তানে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার দিকে তাকালে যেকোনো বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের রক্ত হিম হয়ে আসবে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এতটাই বেড়ে গেছে, সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পাশবিক সংগ্রাম করছে। গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। 

এর পেছনে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতিকে দায়ী করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসাইন হাক্কানি মনে করেন, সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। দুর্নীতির সঙ্গে রয়েছে কাঠামোগত সমস্যা। 

পাকিস্তানের ইতিহাসে জঙ্গিবাদের দগদগে ক্ষত হয়ে মালালা নামটি আজও রয়ে গেছে।হুসাইন হাক্কানির মতে, পাকিস্তানকে এখনো প্রচুর পণ্য ও পরিষেবা আমদানি করতে হয়। শিল্পায়ন যথেষ্ট প্রসারিত হয়নি। এ ছাড়া সরকার সব সময়ই রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে থাকে। নজিরবিহীন এই অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয়েছেন। 

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতেও সমস্যা আছে বলে মনে করেন হুসাইন হাক্কানি। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ভারতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং বৃহত্তর মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা এবং তাদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধাদি গ্রহণ করা। তা না করে দেশটি শুধু ভারত বিরোধিতায় মনোনিবেশ করেছে। 

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এসব সমস্যার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা সমস্যা বাড়ছে। দেশটির শাসকেরা অপেক্ষাকৃত অভিজাত। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষদের থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন তাঁরা। পাকিস্তানের অভিজাত নেতারা বরাবরই ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ফারজানা বারি নামের এক পাকিস্তানি অধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদ। 

রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জঙ্গিবাদ, শিক্ষা, পরিবেশ—এ রকম নানা বিষয়ে পাকিস্তান এখনো নিজের স্বকীয়তা খুঁজে পায়নি। একটি জাতি দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে নিজেকে খুঁজে ফিরছে। 

তথ্যসূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট, ডয়চে ভেলে ও বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত