অনলাইন ডেস্ক
গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের আমদানি শুল্ক নিয়ে বেশ কড়া মন্তব্য করেছিলেন। তিনি ভারতকে ‘শুল্কের ক্ষেত্রে একটি বড় দুর্বৃত্ত’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর ফলে বলতে গেলে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের মূল কারণ হলো, ভারত আমদানি করা মার্কিন পণ্যে অনেক বেশি শুল্ক আরোপ করে। বর্তমানে ভারতের গড় শুল্কের হার প্রায় ১৭ শতাংশ, যেখানে জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলোতে শুল্কহার ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেলের মতো কিছু পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে ভারত।
ট্রাম্পের অভিযোগ, ভারত ‘খুব চালাক’ এবং তারা এই শুল্ক আরোপের মাধ্যমে আমেরিকার সঙ্গে ‘অন্যায়’ করছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ভারতের এই শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও এতে উভয় দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ জটিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, আমেরিকা ছিল ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার। ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশ এবং আমদানির ৬ দশমিক ২২ শতাংশ আমেরিকার সঙ্গে হয়ে থাকে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য উদ্বৃত্তও উল্লেখযোগ্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই উদ্বৃত্ত ছিল ৩৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, আমেরিকা ভারতের থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করে।
যদি আমেরিকা ভারতের সব পণ্যে একক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তবে শুল্ক বাড়বে প্রায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বর্তমানে ভারতীয় পণ্য আমেরিকায় গড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশ (ওয়েটেড মিন বা ভারযুক্ত গড়) শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করে, যেখানে আমেরিকান পণ্য ভারতে প্রবেশ করার সময় গড়ে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক দেয়। সে হিসাবে পার্থক্য ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
শুল্কের এই পার্থক্য বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলবে। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা অনেক বেশি, যেখানে আমেরিকান কৃষিপণ্য ভারতে প্রবেশ করার সময় গড়ে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক দেয়, সেখানে ভারতীয় কৃষিপণ্য আমেরিকায় প্রবেশের সময় দেয় মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, শিল্পজাত পণ্যের ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে আসা পণ্যের ওপর গড়পড়তা ৫ দশমিক ৯ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়, যেখানে ভারত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া শিল্পজাত পণ্যের ওপর মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ শুল্ক লাগে। এর ফলে ৩ দশমিক ৩ শতাংশের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিস্তৃত খাত পর্যায়ে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য শুল্ক ব্যবধান বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন রকম। এই ব্যবধান রাসায়নিক ও ওষুধে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, প্লাস্টিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, বস্ত্র ও পোশাকে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, হীরা, সোনা ও গয়নায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ, লোহা, ইস্পাত ও মৌলিক ধাতুতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটারে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ইলেকট্রনিকসে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং অটোমোবাইল ও অটো যন্ত্রাংশে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ।
শুল্কের ব্যবধান যত বেশি, কোনো খাত তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত ৩০টি খাতের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে। এগুলোর মধ্যে ৬টি কৃষি খাতের এবং ২৪টি শিল্প খাতের। এই সব কটি খাতই বাড়তি শুল্কের কারণে প্রভাবিত হবে।
এর মধ্যে গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, ভারত আমেরিকার অনেক পণ্যে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নেয়। তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপের এটাই সময়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফর বলতে গেলে ভারতের সরকার প্রধানের সাম্প্রতিক সময়ের ব্যর্থতম সফর। কোনো কিছু আদায় করা তো দূরের কথা, মোদি দেশের ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীদের অপমানজনকভাবে দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনা দেশগুলোর ওপরও পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এমন নিষেধাজ্ঞা এলে ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো, যারা রাশিয়া থেকে প্রচুর তেল আমদানি করে, তারা বিপাকে পড়বে।
পুতিনের উদ্দেশে রীতিমতো হুমকির সুরেই ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ব্যর্থতার জন্য যদি রাশিয়ার কোনো ভুল বা দায় প্রতীয়মান হয়, তাহলে জ্বালানি তেলের ওপর ২৫ থেকে ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট পরোক্ষ ট্যারিফ আরোপ করবেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের সময় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মুখে থাকা রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনেছে ভারত। এ নিয়ে দেশীয় পরিশোধনাগার থেকে মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হুমকিতেও পড়েছিল মোদি সরকার।
ইরানের ওপর আমেরিকার চাপও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। ইরান পরমাণু চুক্তিতে রাজি না হলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা তো বটেই, বোমা হামলার হুমকিও দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই হুমকি দিল্লির জন্য বড় শঙ্কার কারণ।
একসময় ইরানই ছিল ভারতের জ্বালানি তেল আমদানির প্রধান উৎস। কিন্তু আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত এখন অন্যান্য দেশ থেকে তেল কিনতে বাধ্য হচ্ছে। আবার নিষেধাজ্ঞা এলে তা ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করবে এবং ভারতকে আরও ব্যয়বহুল বিকল্পের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করবে।
যদি ট্রাম্পের ইরানবিরোধী ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে তেহরানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য, সম্পর্ক এবং কৌশলগত স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যেখানে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি) প্রকল্পটি এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আইএমইসিএর লক্ষ্য সুয়েজ খালের মতো ঐতিহ্যবাহী পথগুলো এড়িয়ে ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক সংহতি বাড়ানো। জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য খাতে বাণিজ্য বহুমুখী করার জন্য ভারত ও ইরান একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) নিয়ে আলোচনা করছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা শুল্ক আর্থিক লেনদেন সীমিত করে এবং অপরিশোধিত তেল ছাড়া অন্য খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে এই প্রচেষ্টাগুলোকে জটিল করে তুলতে পারে।
এরই মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত ও ইরানের মধ্যে সামগ্রিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০১৮-১৯ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ সালে মাত্র ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ৮৬ শতাংশের বেশি হ্রাস।
ভারত-ইরান অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চাবাহার বন্দর প্রকল্প। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে এটি বাধার সম্মুখীন হয়েছে। যদিও বন্দরটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে বলে বিবেচিত, তবু সামগ্রিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং আর্থিক বিধিনিষেধ পরোক্ষভাবে এর উন্নয়ন এবং ব্যবহার প্রভাবিত করেছে। এই প্রকল্প আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য ভারতকে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত ট্রানজিট পথের ওপর নির্ভরতা কমাতে একটি বিকল্প পথ দেয়।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়েও ভারতকে ভাবাবে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা। ইয়েমেনে তেহরানের অবস্থান ভারতের জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ভারতের মিত্রদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইয়েমেন সংঘাত, যেখানে হুতি বিদ্রোহীদের ইরানের সমর্থন, ভারতের জন্য কঠিন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সর্বোপরি চীন তো রয়েছেই। এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ের ২৫ বছরের কৌশলগত অংশীদারত্ব ইত্যাদি বিষয় ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষভাবে ইরান ও ভারতের সম্পর্ককে সীমিত করে চীনকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
আশঙ্কা রয়েছে, ইরানের সম্পদ এবং বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য চীন ইরানের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ব্যবহার করতে পারে, যা ভারতীয় প্রকল্পগুলোর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এদিকে নরেন্দ্র মোদির ঘুম হারাম করে দিয়েছে ইলন মাস্কের এআই চ্যাটবট গ্রোক। বিজেপি ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী বয়ান ধসিয়ে দিচ্ছে এই চ্যাটবট। ভারতের ইতিহাস, বিজেপি ও আরএসএসের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক এবং তাদের নেতাদের ভাবমূর্তি রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলেছে গ্রোক। বিজেপির প্রোপাগান্ডা সেল এবং তথাকথিত গদি মিডিয়ার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে এটি।
ভারতে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সের (সাবেক টুইটার) সঙ্গে এই চ্যাটবট বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে দিচ্ছে ইলন মাস্কের সংস্থা এক্সএআই। ভারতীয়রা গ্রোককে রীতিমতো ব্যক্তিগত পকেট ফ্যাক্টচেকার বানিয়ে ফেলেছে! ফলে আগামী নির্বাচনে মোদির চ্যালেঞ্জ যে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে ডিজিটাল মেন্টর হয়ে ওঠা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এর আগে গুগলের জেমিনি চ্যাটবটের মুখ বন্ধ করতে পারলেও ইলন মাস্ককে কোনোভাবেই ম্যানেজ করতে পারছে না মোদি সরকার। গত ডিসেম্বরে গ্রোক সবার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনো গ্রোক নিয়ে কোনো রা নেই!
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক, রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুমকি, চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এবং ইলন মাস্কের গ্রোক—এই চতুর্মুখী চাপ বিজেপির পোস্টার বয় নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কীভাবে সামলাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: ইকোনমিক টাইমস, দ্য ইনডিপেনডেন্ট, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের আমদানি শুল্ক নিয়ে বেশ কড়া মন্তব্য করেছিলেন। তিনি ভারতকে ‘শুল্কের ক্ষেত্রে একটি বড় দুর্বৃত্ত’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর ফলে বলতে গেলে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের মূল কারণ হলো, ভারত আমদানি করা মার্কিন পণ্যে অনেক বেশি শুল্ক আরোপ করে। বর্তমানে ভারতের গড় শুল্কের হার প্রায় ১৭ শতাংশ, যেখানে জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলোতে শুল্কহার ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেলের মতো কিছু পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে ভারত।
ট্রাম্পের অভিযোগ, ভারত ‘খুব চালাক’ এবং তারা এই শুল্ক আরোপের মাধ্যমে আমেরিকার সঙ্গে ‘অন্যায়’ করছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ভারতের এই শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও এতে উভয় দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ জটিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, আমেরিকা ছিল ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার। ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশ এবং আমদানির ৬ দশমিক ২২ শতাংশ আমেরিকার সঙ্গে হয়ে থাকে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য উদ্বৃত্তও উল্লেখযোগ্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই উদ্বৃত্ত ছিল ৩৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, আমেরিকা ভারতের থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করে।
যদি আমেরিকা ভারতের সব পণ্যে একক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তবে শুল্ক বাড়বে প্রায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বর্তমানে ভারতীয় পণ্য আমেরিকায় গড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশ (ওয়েটেড মিন বা ভারযুক্ত গড়) শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করে, যেখানে আমেরিকান পণ্য ভারতে প্রবেশ করার সময় গড়ে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক দেয়। সে হিসাবে পার্থক্য ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
শুল্কের এই পার্থক্য বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলবে। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা অনেক বেশি, যেখানে আমেরিকান কৃষিপণ্য ভারতে প্রবেশ করার সময় গড়ে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক দেয়, সেখানে ভারতীয় কৃষিপণ্য আমেরিকায় প্রবেশের সময় দেয় মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, শিল্পজাত পণ্যের ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে আসা পণ্যের ওপর গড়পড়তা ৫ দশমিক ৯ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়, যেখানে ভারত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া শিল্পজাত পণ্যের ওপর মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ শুল্ক লাগে। এর ফলে ৩ দশমিক ৩ শতাংশের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিস্তৃত খাত পর্যায়ে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য শুল্ক ব্যবধান বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন রকম। এই ব্যবধান রাসায়নিক ও ওষুধে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, প্লাস্টিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, বস্ত্র ও পোশাকে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, হীরা, সোনা ও গয়নায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ, লোহা, ইস্পাত ও মৌলিক ধাতুতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটারে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ইলেকট্রনিকসে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং অটোমোবাইল ও অটো যন্ত্রাংশে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ।
শুল্কের ব্যবধান যত বেশি, কোনো খাত তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত ৩০টি খাতের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে। এগুলোর মধ্যে ৬টি কৃষি খাতের এবং ২৪টি শিল্প খাতের। এই সব কটি খাতই বাড়তি শুল্কের কারণে প্রভাবিত হবে।
এর মধ্যে গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, ভারত আমেরিকার অনেক পণ্যে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নেয়। তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপের এটাই সময়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফর বলতে গেলে ভারতের সরকার প্রধানের সাম্প্রতিক সময়ের ব্যর্থতম সফর। কোনো কিছু আদায় করা তো দূরের কথা, মোদি দেশের ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীদের অপমানজনকভাবে দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনা দেশগুলোর ওপরও পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এমন নিষেধাজ্ঞা এলে ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো, যারা রাশিয়া থেকে প্রচুর তেল আমদানি করে, তারা বিপাকে পড়বে।
পুতিনের উদ্দেশে রীতিমতো হুমকির সুরেই ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ব্যর্থতার জন্য যদি রাশিয়ার কোনো ভুল বা দায় প্রতীয়মান হয়, তাহলে জ্বালানি তেলের ওপর ২৫ থেকে ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট পরোক্ষ ট্যারিফ আরোপ করবেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের সময় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মুখে থাকা রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনেছে ভারত। এ নিয়ে দেশীয় পরিশোধনাগার থেকে মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হুমকিতেও পড়েছিল মোদি সরকার।
ইরানের ওপর আমেরিকার চাপও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। ইরান পরমাণু চুক্তিতে রাজি না হলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা তো বটেই, বোমা হামলার হুমকিও দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই হুমকি দিল্লির জন্য বড় শঙ্কার কারণ।
একসময় ইরানই ছিল ভারতের জ্বালানি তেল আমদানির প্রধান উৎস। কিন্তু আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত এখন অন্যান্য দেশ থেকে তেল কিনতে বাধ্য হচ্ছে। আবার নিষেধাজ্ঞা এলে তা ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করবে এবং ভারতকে আরও ব্যয়বহুল বিকল্পের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করবে।
যদি ট্রাম্পের ইরানবিরোধী ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি অব্যাহত থাকে, তাহলে তেহরানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য, সম্পর্ক এবং কৌশলগত স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যেখানে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি) প্রকল্পটি এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আইএমইসিএর লক্ষ্য সুয়েজ খালের মতো ঐতিহ্যবাহী পথগুলো এড়িয়ে ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক সংহতি বাড়ানো। জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য খাতে বাণিজ্য বহুমুখী করার জন্য ভারত ও ইরান একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) নিয়ে আলোচনা করছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা শুল্ক আর্থিক লেনদেন সীমিত করে এবং অপরিশোধিত তেল ছাড়া অন্য খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে এই প্রচেষ্টাগুলোকে জটিল করে তুলতে পারে।
এরই মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত ও ইরানের মধ্যে সামগ্রিক বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০১৮-১৯ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ সালে মাত্র ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ৮৬ শতাংশের বেশি হ্রাস।
ভারত-ইরান অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চাবাহার বন্দর প্রকল্প। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে এটি বাধার সম্মুখীন হয়েছে। যদিও বন্দরটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে বলে বিবেচিত, তবু সামগ্রিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং আর্থিক বিধিনিষেধ পরোক্ষভাবে এর উন্নয়ন এবং ব্যবহার প্রভাবিত করেছে। এই প্রকল্প আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য ভারতকে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত ট্রানজিট পথের ওপর নির্ভরতা কমাতে একটি বিকল্প পথ দেয়।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়েও ভারতকে ভাবাবে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা। ইয়েমেনে তেহরানের অবস্থান ভারতের জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ভারতের মিত্রদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইয়েমেন সংঘাত, যেখানে হুতি বিদ্রোহীদের ইরানের সমর্থন, ভারতের জন্য কঠিন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সর্বোপরি চীন তো রয়েছেই। এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ের ২৫ বছরের কৌশলগত অংশীদারত্ব ইত্যাদি বিষয় ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষভাবে ইরান ও ভারতের সম্পর্ককে সীমিত করে চীনকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
আশঙ্কা রয়েছে, ইরানের সম্পদ এবং বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য চীন ইরানের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ব্যবহার করতে পারে, যা ভারতীয় প্রকল্পগুলোর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এদিকে নরেন্দ্র মোদির ঘুম হারাম করে দিয়েছে ইলন মাস্কের এআই চ্যাটবট গ্রোক। বিজেপি ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী বয়ান ধসিয়ে দিচ্ছে এই চ্যাটবট। ভারতের ইতিহাস, বিজেপি ও আরএসএসের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক এবং তাদের নেতাদের ভাবমূর্তি রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলেছে গ্রোক। বিজেপির প্রোপাগান্ডা সেল এবং তথাকথিত গদি মিডিয়ার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে এটি।
ভারতে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সের (সাবেক টুইটার) সঙ্গে এই চ্যাটবট বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে দিচ্ছে ইলন মাস্কের সংস্থা এক্সএআই। ভারতীয়রা গ্রোককে রীতিমতো ব্যক্তিগত পকেট ফ্যাক্টচেকার বানিয়ে ফেলেছে! ফলে আগামী নির্বাচনে মোদির চ্যালেঞ্জ যে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে ডিজিটাল মেন্টর হয়ে ওঠা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এর আগে গুগলের জেমিনি চ্যাটবটের মুখ বন্ধ করতে পারলেও ইলন মাস্ককে কোনোভাবেই ম্যানেজ করতে পারছে না মোদি সরকার। গত ডিসেম্বরে গ্রোক সবার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনো গ্রোক নিয়ে কোনো রা নেই!
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক, রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুমকি, চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এবং ইলন মাস্কের গ্রোক—এই চতুর্মুখী চাপ বিজেপির পোস্টার বয় নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কীভাবে সামলাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: ইকোনমিক টাইমস, দ্য ইনডিপেনডেন্ট, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, তবে দেশটি কেবল পরিবর্তিত বাণিজ্য কাঠামোর সুবিধাভোগী হিসেবেই নয়, তৈরি পোশাক শিল্পের একটি প্রভাবশালী অংশীদার হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারবে।
২ দিন আগেনেপালে রাজতন্ত্র পুনর্বহাল ও হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে। কাঠমান্ডুতে রাজতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়েছে। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হলেও, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতির কারণে জনগণের একাংশ রাজতন্ত্র ফি
৪ দিন আগেভারতের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কৌশল পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ভারত অত্যধিক কঠোরহস্ত হয়ে উঠেছে, চীন যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে বা সাধারণ মূল্যবোধ ও পরিচয়ের অনুভূতি প্রচারে সফল হয়নি, ভারতের
৪ দিন আগেভোটারের ন্যূনতম বয়স নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের সংস্কার প্রস্তাবে ভোটারের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার প্রস্তাব করেছে। আবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৭ বছরের প্রস্তাব করেছেন। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছে।
৯ দিন আগে