Ajker Patrika

‘সব তো হইল, বাপের চোখটা কি ফিরবে’

অর্চি হক, ঢাকা
‘সব তো হইল, বাপের চোখটা কি ফিরবে’

‘গোলাগুলির মদ্দে বাপরে হারাইয়া ফেলছিল সাব্বির। গুলি থিকা বাঁচতে একটা ট্রাকের ভিতরে গিয়া ঢুকছিল। সেইখানেই ওর চোখে গুলি লাগে।’—বলছিলেন কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় চোখ হারানো কিশোর মোহাম্মদ সাব্বিরের মা রহিমা বেগম।

১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয় তাঁর ১৫ বছরের সন্তান। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৮ দিন। নিজের কানের দুল বিক্রি করে ছেলের চোখে দুই দফায় অপারেশন করিয়েছেন রহিমা। কিন্তু এখনো ফেরেনি সাব্বিরের চোখে আলো। তার একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য চোখটিও ধীরে ধীরে দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে চিকিৎসাধীন আছে সাব্বির। ৩ আগস্ট শনিবার হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের ওয়ার্ডে কথা হয় রহিমা বেগমের সঙ্গে। চিটাগাং রোডে একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন তিনি। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ ওহিদ ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন। ছেলের অসুস্থতার কারণে সব কাজ বাদ দিয়ে হাসপাতালেই থাকতে হচ্ছে তাঁদের।

হাসপাতালের শয্যায় থাকা ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রহিমা জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাটে। সেখান থেকে মাস দুয়েক আগে ঢাকায় আসে সাব্বির। গ্রামে সে নানার সঙ্গে থাকত। রহিমা বলেন, ‘ভাবছিলাম, গ্রামে থাকলে আজেবাজে মানুষের সাথে মিশা ছেলেটা নষ্ট হইয়া যাইব। ঢাকায় আইসা বাপের সাথে কামকাজ করলে ভালো হইব।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে রহিমার। কথা আর এগোতে পারেন না তিনি।

চোখ মুছতে মুছতে ওয়ার্ডের সামনে করিডরে এসে দাঁড়ান রহিমা। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলেন, ‘বাপেরে সাহায্য করতে গিয়া ছেলেটা আমার গুলি খাইয়া অন্ধ হইয়া গেল। ওর চোখ যে পুরোপুরি অন্ধ হইয়া গেছে, ও জানে না। ওরে বলছি, কয়েক দিন পর চোখে দেখতে পারবা।’

ক্লাস ফাইভের পর আর পড়াশোনা করা হয়নি সাব্বিরের। মা রহিমা ভেবেছিলেন, ঢাকায় এসে থাকলে ছেলে কাজকর্ম করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। মায়ের ইচ্ছানুযায়ী বাবার সঙ্গে থেকে কাজও শুরু করে সে। ১৯ জুলাই বিকেলে বাবা ওহিদ মিয়ার সঙ্গে সবজি কিনতে যাত্রাবাড়ী গিয়েছিল সাব্বির। সে সময়ই শুরু হয় গোলাগুলি।

রহিমা বেগম জানান, ১৯ জুলাই গোলাগুলির সময় হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিন দিন সাব্বিরের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না তাঁরা। ২১ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।

তিন বছর ধরে সোয়েটার কারখানায় কাজ করে যেটুকু সঞ্চয় করেছিলেন রহিমা, তার সবই ছেলের চিকিৎসার পেছনে চলে গেছে।

কীভাবে ছেলের চোখের চিকিৎসা করাবেন, কীভাবে সংসার চালাবেন, তার হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি। গতকাল মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে সর্বশেষ যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন দেশে চলছে ক্ষমতার পালাবদল। রহিমা বলেন, ‘সব তো হইল, কিন্তু আমার বাপের চোখটা কি ফিরবে? আমি কূলকিনারা পাইতেছি না। সব টাকাপয়সা শেষ করছি। কী দিয়া ওর চিকিৎসা করামু?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত