Ajker Patrika

এখানেও নারী উপেক্ষিত

ইমতিয়াজ মাহমুদ
Thumbnail image

কোটা সংস্কার প্রস্তাবটির একরকম সুরাহা হয়ে গেল। আন্দোলনের মুখে প্রথমবার ২০১৮ সালে সরকার কোটা বিলোপ করে দিয়েছিল। এক রিট পিটিশনে সরকারের সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিলেন হাইকোর্ট। ফেরত এল সব কোটা। আবার আন্দোলনের মুখে সরকারের করা আপিলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের কোটাকাঠামো কী রকম হবে, তা নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে কোটা নির্ধারণ করে মঙ্গলবারই সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এ পর্যন্ত ঘটনাবলি আমরা সবাই জানি।

কিন্তু যে কথাটি কেউ বলছেন না সেটি হলো, কোটা নিয়ে এই পুরো ঘটনাবলিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অংশ—নারীরা।

নারীরা যে আমাদের সমাজে পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছে, সে কথা কেউ অস্বীকার করে না। পুরুষের সঙ্গে তাদের সমান কাতারে নিয়ে আসার প্রয়োজনে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করাও যে জরুরি, এই কথাটিও কেউ অস্বীকার করে না। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার বিধান করা হয়েছে সংবিধানে। 

বিশ্বব্যাপী নারীকে পুরুষের সঙ্গে একই সমতলে নিয়ে আসাকে একটি জরুরি কাজ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ থেকে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি নামে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানেও নারীর ক্ষমতায়নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যভাবে বললে, বিশ্বব্যাপী মেনে নেওয়া হয়েছে যে, শতকের পর শতক ধরে পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্যের শিকার নারীরা সবখানে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। এটা থেকে নারীর উত্তরণ জরুরি এবং এর কারণে নারীর জন্য একটু বাড়তি সুবিধা সংরক্ষণ করাটা ন্যায়সংগত।

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনের একটি উপায় ছিল সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য কোটার বিধান করা। এ কারণে নারীর জন্য সরকারের সকল চাকরিতে আগে কোটার বিধান ছিল। বিশেষ করে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে কোটা ছিল শতকরা ৬০ ভাগ। শিক্ষকতার এই কোটা আর সেই সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে শতকরা ১৫ ভাগ কোটা মিলিয়ে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র নারীদের একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছিল। বড় শহরগুলোর বাইরে সবখানে আত্মনির্ভরশীল চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা খানিকটা বেড়েছে। একদম গ্রামে গেলেও দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি বা অন্য অফিসগুলোতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করে নিজের ও সন্তানদের জীবন চালাতে সক্ষম এ রকম নারীর সংখ্যা বেড়েছে। এর ফলে শুধু যে সেই নারীরাই উপকৃত হয়েছে, তা নয়।

সামগ্রিকভাবে পুরো জাতিই উপকৃত হয়েছে। দেশের নারীরা সমাজে নানান পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে। জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ নারী। আর সেই নারীকে অন্যের গলগ্রহ করে রেখে দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।

নারীর জন্য কোটার প্রয়োজন কেন? এটা নারীর দুর্বলতার জন্য নয়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নারী যে পুরুষের চেয়ে অধম, সে কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান বৈষম্য নারীকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত রেখেছে। সে কারণে নারী খানিকটা পিছিয়ে ছিল।

বৈষম্যটা পুরুষের সৃষ্টি এবং পরিচালিত। সেই বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নারীকে একটু বাড়তি সুবিধা দেওয়া রাষ্ট্র ও সমাজেরই দায়িত্ব। কোটা বা এসব বিশেষ ব্যবস্থায় নারীর চূড়ান্ত মুক্তি ঘটবে না। কিন্তু একেবারে পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে খানিকটা হলেও নারী-পুরুষের সঙ্গে একই সমতলে হয়তো আসতে পারত। সে সুযোগ এখন আর থাকল না। কোটা নিয়ে এই ঝগড়াঝাঁটি আর আপস নিষ্পত্তির পুরো কার্যক্রমের মূল ক্ষতিটা হলো নারীর। যে দু-একজন নারী বলেছেন, তাঁরা কোটা চান না, তাঁরা বঞ্চিত, নিগৃহীত আর বৈষম্যের শিকার কোটি কোটি নারীর প্রতিনিধিত্ব করেন না।

যুগ-যুগান্তর ধরে প্রচলিত বৈষম্যের বিপরীতে যা-ও একটু সুযোগ এসেছিল, নারীর হাত থেকে সেটাও কেড়ে নেওয়া হলো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত