Ajker Patrika

সাইকেলে ছুটে চলা মেয়েটি

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
সাইকেলে ছুটে চলা মেয়েটি

আনুশকা শর্মা ও রণবীর সিং অভিনয় করেছিলেন ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ চলচ্চিত্রটিতে। সেটি দুজন সফল ওয়েডিং প্ল্যানারের গল্প নিয়ে বানানো। চলচ্চিত্রটি দেখে বাস্তবে একজন ওয়েডিং প্ল্যানার হয়েছেন। ব্যবসায়িক সফলতা আর খ্যাতিও পেয়েছেন। এই সফল ওয়েডিং প্ল্যানারের নাম বিতস্তা আহমেদ।

প্রাচীন ভারতের সাহিত্যে ‘সপ্তসিন্ধু’ নামে যে শব্দ পাওয়া যায়, ধারণা করা হয়, ঝিলম নদী এই সপ্তসিন্ধুর মধ্যে একটি। ঝিলমের অন্য নাম বিতস্তা। পাঞ্জাবের পাঁচটি বড় নদীর মধ্যে এটি একটি। সে অর্থে বিতস্তা অর্থ স্রোতস্বিনী অর্থাৎ বহমান নদী। বিতস্তা আহমেদের স্বপ্নের স্রোত দুকূল ছাপিয়ে প্রবহমান। 

ভাঙা সাইকেলের গল্প
একটা ভাঙা সাইকেলে চেপে ভোর ৫টায় শাহবাগ মোড় থেকে ফুল কেনা। কখনো কখনো উত্তরা থেকে ধানমন্ডি সেই সাইকেলেই  যাতায়াত। কষ্ট হলেও একটা সময় সাইকেল নিয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটেছেন বিতস্তা। হয়েছেন চলচ্চিত্রের চরিত্রের মতোই সফল। মনে আছে, নায়ক সিয়াম আহমেদের বিয়ের আয়োজনের কথা? বিতস্তা সাজিয়েছিলেন সেটি। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র, সংগীত ও করপোরেট জগতের অনেকের বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছেন তিনি।

একদিন আড্ডায়
নির্দিষ্ট সময়ে বিতস্তার অফিসে অপেক্ষা করছিলাম। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর হন্তদন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। কণ্ঠে কিছুটা অনুশোচনা। বললেন, ‘দেরি হয়ে গেল, কিছু মনে করবেন না। একটা ভেন্যু দেখতে গিয়েছিলাম।’ একটু গুছিয়ে নিয়ে শুরু হলো আলাপ।

২০১২ সাল থেকে ওয়েডিং প্ল্যানিং নিয়ে কাজ করার কথা ভাবেন বিতস্তা। লক্ষ্য স্থির করার পর এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে কাজটা করবেন বলে ঠিক করেন। তখন তাঁরা দুজনই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শেষ দিকে লেখাপড়া করছেন। ধীরে ধীরে বন্ধুদের বলতে শুরু করেন, কারও বিয়ের প্ল্যানার দরকার হলে যেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র একদিন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বোনের বিয়ের আয়োজন করে দেওয়ার জন্য। খুব অল্প লাভে অনেক উৎসাহ নিয়ে কাজটা করেন বিতস্তা আর তাঁর বন্ধু। সেই সফল আয়োজন তাঁদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল।

সকালে গিয়ে ফুলের অর্ডার দেওয়া, কাঠের কাজ, ডিজাইন, ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের কাছে সব বুঝে নিয়ে নিজের পরিকল্পনা তাঁদের বোঝানো—সব কাজ একাই করতেন বিতস্তা। সঙ্গী ছিল সাইকেল। বিতস্তা বলেন, ‘আমার সাইকেলের অবস্থা একদম ভালো ছিল না। কষ্ট হতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে। তবে কাজ শুরু করার পর মা আমাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছিল। মা জানত, কষ্ট করে হলেও এই কাজই করব। তাই আমার কাজ সহজ করার জন্য সে আমাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছিল।’ মা কিংবা ভাই তাঁর কাজে কখনোই বাধা দেননি। তবে হ্যাঁ, প্রথম যখন বাসায় জানিয়েছিলেন, পরিবারের মানুষেরা একটু চিন্তিত হয়েছিলেন মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে। তবে ধীরে ধীরে সবার চিন্তা দূর হয়েছে।

২০১৩ সাল থেকে বিতস্তা একাই কাজ করছেন। প্রথম দিকে যখন সকাল সকাল তিনি একা যেতেন শাহবাগে, দোকানিরা আড়চোখে তাকাতেন। এখন বিতস্তার সঙ্গে তাঁদের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

বিতস্তা আহমেদ। ছবি: সংগৃহীতএকবার এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং, গুলশানে। বাইরে বৃষ্টি। মিটিং কিছুতেই পেছানো যাবে না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে দেখা করেন ক্লায়েন্টের সঙ্গে। তাঁকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত ক্লায়েন্ট। কথা বলার ফাঁকে তিনি বলেই ফেলেছিলেন, ‘তুমি পারবে একা গোটা অনুষ্ঠান সামলে নিতে?’ আত্মবিশ্বাসের কমতি কখনোই ছিল না বিতস্তার। বলেছিলেন, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’ সে ঘটনার অনেক দিন পর সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বিতস্তা হাসিমুখে জানান, এমন অনেকবারই হয়েছে তাঁর সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে পড়তে হয়েছিল অনলাইন বিড়ম্বনায়। ‘ওয়েডিং বিজ’ নামে তাঁর প্রতিষ্ঠানের একটি ফেসবুক পেজ আছে। কিছুদিন পর একই নামে আরও একটি পেজ খোলে কেউ। সে ঘটনায় বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন তাঁর ক্লায়েন্টরা। শেষে পেজের নামের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করে রাখেন ‘ওয়েডিং বিজ বাই বিতস্তা’। 

অনুষ্ঠানের ধরনে বদল
অনেক দিন ধরে বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বদল দেখেছেন বিতস্তা। আগে যেখানে তিন থেকে চারটা পর্বে বিয়ে শেষ হতো, সেখানে এখন ৯ থেকে ১০ ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে! বেড়েছে ডেসটিনেশন ওয়েডিং। বিতস্তা বলেন, ‘মানুষ তাঁদের খুব কাছের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঢাকার বাইরে ডেসটিনেশন ওয়েডিং করছেন। এটা তিন থেকে চার দিন হয়ে থাকে। অতিথিদের নিয়ে যাওয়া, প্রতিটি ইভেন্টের থিম বোঝানো, পোশাকের রং বলা—এর সবই করতে হয় এসব ক্ষেত্রে। ধারণাটা আমাদের দেশে নতুন।’

বাড়ছে প্রতিযোগিতা
বিয়ে ছাড়া অনেক পারিবারিক অনুষ্ঠানও প্ল্যানার দিয়ে আয়োজন করান অনেকে। তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। বিতস্তার ভাষায়, এটি অনেক বড় ইন্ডাস্ট্রি। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান আসছে কাজ করতে। দিন দিন বাড়ছে প্রতিযোগিতা। তাই তৈরি করতে হয়েছে কমিউনিটি ফোরাম। সেখানে নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করেন নিজেরাই। এই প্রতিযোগিতামূলক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে বিতস্তাও এখন বিভিন্ন করপোরেট প্রোগ্রাম, পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন। এসবের সঙ্গে মিল রাখতে নিজের পেজের নাম রেখেছেন ‘বিজ ইভেন্টস’। 

১২ জনের টিম
বিতস্তার সঙ্গে এখন কাজ করছে ১২ জনের একটি দল। সেখানে আছেন গ্রাফিকস, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টস ও ভেন্যু ইনচার্জ। সব কটি আয়োজন সফল করার পেছনে টিমের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি।

নতুন এই পেশার বিভিন্ন দিক সামলে এখন দারুণ অভিজ্ঞ বিতস্তা। নিকেতনের ৫ নম্বর সড়কের একটি পাঁচতলা ভবনে তাঁর অফিসে বসে দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে জানতে চাইলাম, এখনো সাইকেল চালান? বিতস্তা হেসে বললেন, ‘চালাই, তবে স্কুটি।’

সে হাসিতে ধরা পড়ল এক আত্মবিশ্বাসী নারীর অবয়ব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

র‍্যাবের গুলিতে নিহত কলেজছাত্র সিয়াম মাদক কারবারি নয়, দাবি পরিবারের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত