Ajker Patrika

কেমন আছেন পোশাকশিল্পের নারীরা

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
ছবি: আজকের পত্রিকা
ছবি: আজকের পত্রিকা

২৪ এপ্রিল ২০১৩ সাল। সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে বহুতল ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ে। পৃথিবীর কারখানা দুর্ঘটনার ইতিহাসে লেখা হয় এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এক যুগ পরেও সেই স্মৃতি শুধু আমাদের নয়, তাড়া করে ফেরে পুরো বিশ্বকে।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলওর হিসাব মতে, ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩২ জন নিহত হন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে। এই আহত কিংবা নিহত মানুষের বেশির ভাগই ছিলেন পোশাকশ্রমিক।

লিড সনদ

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার পর মানবাধিকারকর্মী, সচেতন মানুষ, দেশীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠান ও মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের পর তৈরি পোশাক খাতের অগ্নি, স্থাপনা এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার উন্নতিতে গুরুত্ব ও মনোযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে দেশের ২৩২টি পোশাক কারখানা পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন’ (লিড) সনদ পেয়েছে। এ প্যারামিটার বেশ উন্নতই বলা যায়।

রানা প্লাজার পর আর তেমন বড় কোনো ভবন ধসের দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে। সেই কারখানায় মৃতের সংখ্যাও ছিল অনেক। শ্রমিক ও নারী অধিকারকর্মী তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘বিল্ডিং ব্যবস্থা ভালো হলেও দুর্ঘটনা-পরবর্তী উদ্ধারকাজের ব্যবস্থার দিকে ভালোভাবে নজর দিতে হবে। এটি আমাদের দেশে এখনো দুর্বল। বেসরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ থাকলেও সরকারিভাবে এ খাতে ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

কমছে নারীর অংশগ্রহণ

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করলে দেশের তৈরি পোশাকের অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা তুলে নেওয়া হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হিসাবে এই সুবিধা ৭ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাজারে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ থেকে মোট রপ্তানি হয়েছে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে ১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ছিল তৈরি পোশাক। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থমূল্য বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শীর্ষ পণ্যগুলো হলো পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং পাট ও পাটজাত পণ্য। দেশের মোট রপ্তানির ৮৯ দশমিক ২১ শতাংশজুড়েই ছিল এসব পণ্য। আর মোট রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা পণ্য পোশাকের অংশ ছিল ৮১ শতাংশ।

মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা এবং নারীর নিরাপত্তাসংক্রান্ত ধারা থাকলেও বাস্তব প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে।

পোশাক খাতের এই বিপ্লবের মূল দাঁড়বাহক হলেন শ্রমিকেরা। পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তার তথ্য অনুযায়ী, এই শিল্পে ১৯৮০ সালে নারী শ্রমিকের হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা ২০২১ সালে কমে দাঁড়ায় ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, পোশাক খাতে নিযুক্ত মোট শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা কমে ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রথম দিকে কম বেতনের চাকরি হলেও অনেক নারী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। তবে নারীরা এখন পোশাক কারখানায় শ্রম দেওয়ার চেয়ে করপোরেট চাকরিতে বেশি আগ্রহী। অনেকে বলছেন, অটোমেশন ও অন্যান্য খাতের তুলনায় মজুরি এবং সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় এই খাতে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে।

অটোমেশন ও স্পিনিং, উইভিং, ডাইং এবং ফিনিশিং সেক্টরগুলো মূলত পুরুষ শ্রমিকেরা পরিচালনা করেন। ফলে নারী শ্রমিকদের প্রভাব সেখানেও কমে গেছে। অটোমেশনের সময় নারীদের সে বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠার মতো সময় ও সুযোগ নারীরা পাচ্ছেন না। শ্রমিক ও নারী অধিকারকর্মী তাসলিমা আক্তার বলেন, নারী শ্রমিকদের অটোমেশনে দক্ষ হতে যে মনোযোগ দিতে হয়—ঘরে-বাইরে কাজ করে তা দেওয়া সম্ভব হয় না। সে কারণেও নারী শ্রমিক এ খাতে কমে যাচ্ছেন। এ ছাড়া কর্মপরিবেশ, মাতৃকালীন ছুটি ও ডে কেয়ার ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন করা দরকার।

আইনের প্রয়োগে ঘাটতি

বাংলাদেশে শ্রম আইনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার ও বেতন-ভাতার বিষয়গুলো আইনের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছে। ছুটি কিংবা কর্মঘণ্টা ও বেতন নিয়ে শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়াই এই আইনের লক্ষ্য। নারীদের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি অনেক কারখানাই নিশ্চিত করেছে। তবে এখনো বেশির ভাগ কারখানায় ডে কেয়ার সেন্টার নেই। সেই কারণে একজন নারী শ্রমিক মা হওয়ার পর ছোট শিশু নিয়ে কাজ করতে থাকাটা কষ্টকর। সে ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়, নয়তো শিশুকে রেখে কাজে ফিরতে হয়। এ ছাড়া যেখানে থাকে বিভিন্ন ঝুঁকির আশঙ্কা।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইফফাত গিয়াস আরেফিন এ বিষয়ে বলেন, দেশের শ্রম আইন আংশিকভাবে নারীবান্ধব হলেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা এবং নারীর নিরাপত্তাসংক্রান্ত ধারা থাকলেও বাস্তব প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। নারীর কর্মস্থলে সমান সুযোগ, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য আরও কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক আইন প্রণয়ন এবং কঠোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে অংশ নিতে পারে।

পোশাক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে কমছে—এটি কোনো ইতিবাচক সংবাদ নয়। এর মূল কারণগুলো খুঁজে দেখা হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

চীনা পণ্যে শুল্ক ‘উল্লেখযোগ্য’ পরিমাণে কমিয়ে সুখে বসবাসের ঘোষণা ট্রাম্পের

২৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪১৪ কোটি টাকার অনিয়ম

কাশ্মীরে হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ না হলে মানবজাতির সামনে ‘চরম অন্ধকার’, ভ্যান্সের হুঁশিয়ারি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত