Ajker Patrika

‘চোখ বন্ধ করলেই বাচ্চাটার মুখ ভেসে ওঠে’

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
‘চোখ বন্ধ করলেই বাচ্চাটার মুখ ভেসে ওঠে’

মাসটা সেপ্টেম্বর। তবু জুলাইয়ের স্মৃতির রেশ যেন কাটছেই না। জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া হাজারো ঘটনা আজও আমাদের অগোচরে। ওই সময় কেউ গিয়েছিলেন রাজপথে, কেউ নিজের বাড়ি থেকে সহায়তা করেছেন সাধ্যমতো। এমবিবিএস পড়াকালীনই চিকিৎসকেরা শপথ নেন রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার। পেশাগত জায়গা থেকে এই শপথের প্রকৃত চর্চা যাঁরা করেন, ইতিহাসে তাঁদের নামই লেখা থাকে। তেমনই একজন ডা. অর্থী জুখরীফ।

রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিকেলে কর্মরত অর্থী। সেবা দেন হাসপাতালে আসা রোগীদের। জুলাইয়ের বাংলাদেশ যেমন নতুন ইতিহাস লিখেছে, তেমনই অর্থীও যেন অন্য এক অর্থীকে খুঁজে পেয়েছেন। উত্তাল সে সময়ে দেশের বাতাসে বারুদের গন্ধ, সবার মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। রক্তাক্ত দেশ দেখেছেন অসংখ্য মানুষ। কেউ দেখেছেন পত্রিকার পাতায়, কেউ টেলিভিশনের পর্দায়, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকাটা সম্ভব ছিল না। ক্রমশ দেশের পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছিল।

না ভোলা দিনগুলো
সেদিন ছিল ১৮ জুলাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সেদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নেমে আসেন রাস্তায়। ধানমন্ডির আশপাশের প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন রাজপথে। দুপুর নাগাদ হঠাৎ বাইরে গুলির শব্দ শুনতে পান অর্থী। সেই সঙ্গে খণ্ড খণ্ড মিছিল, স্লোগান। চারদিকে চিৎকার ও হুড়োহুড়ির শব্দ। ঘটনা বুঝতে অর্থী গিয়ে দাঁড়ান ধানমন্ডি ৯/এ সড়কের ১৩৫ নম্বর বাসার ব্যালকনিতে। সেখানেই থাকেন তিনি। সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে অর্থী বলেন, ‘স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ছুটছিল পুরো গলিতে। তাদের অনেকে নানাভাবে আহত, রক্তাক্ত অবস্থা। কারও মাথায় আঘাত, কারও চোখে, কারও হাত-পায়ে আঘাত, কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে। চারদিকে চিৎকার, আর্তনাদ। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিজের ভেতরে অস্থিরতা কেবল বাড়ছিল।’

একজন চিকিৎসক হিসেবে সেদিন আর বসে থাকতে পারেননি অর্থী। ভবনের প্রায় সবাই তখন নিচে। সেখানে ছিলেন আরও একজন চিকিৎসক—হৃতিশা আক্তার মিথেন। দুজনে মিলে ভাবতে লাগলেন, কীভাবে আহত শিক্ষার্থীদের অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যায়। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন সেখানেই। পাশে পেয়েছিলেন ভবনের অন্য বাসিন্দাদের। সবাই মিলে আহত শিক্ষার্থীদের জন্য ধানমন্ডি ৯/এ সড়কের ১৩৫ নম্বর বাসার গ্যারেজকে বানিয়ে ফেললেন একরকম অস্থায়ী হাসপাতাল।

একে একে সেখানে আসতে শুরু করলেন আহত শিক্ষার্থীরা। চিকিৎসা শুরু হয় অর্থী আর মিথেনের কাছে থাকা খুব অল্প সরঞ্জাম দিয়ে। শিক্ষার্থীদের কারও কারও প্রায় পুরো শরীরে ছররা গুলি। কারও চোখে লেগেছে গুলি, মাথা ফাটা। কারও হাত-পা থেকে ঝরছে রক্ত। দ্রুতই খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। বাড়তে থাকে আহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। একদিকে সীমিত সাধ্যের মধ্যেই চলছিল আহতদের চিকিৎসা, অন্যদিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়ছিল আন্দোলনকারীদের। সময়ের সঙ্গে বাড়ছিল আহতদের সংখ্যা। অর্থী বলেন, ‘সকল ভয়, ক্লান্তি ভুলে একটা বিষয় এল মাথায়—আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। আহত মানুষের সেবা করাই আমার ব্রত।’ টানা দুদিন গ্যারেজে চলে চিকিৎসা সহায়তা। সরাসরি আন্দোলনে যেতে না পারলেও এভাবেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকার পথ বেছে নেন অর্থী।

এ কাজ করতে গিয়ে কেবল বাসার লোকজন নয়, পুরো ভবনের বাসিন্দাদের সহায়তা পেয়েছেন অর্থী। প্রতিটি পরিবার এগিয়ে এসেছিল বাসায় থাকা প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে। তারপরেও ঘাটতি দেখা দিল সেই সরঞ্জামের। এলাকার সব ওষুধের দোকান বন্ধ। নিরুপায় হয়ে ওষুধের দোকানিদের বাসা থেকে অনুরোধ করে ডেকে এনে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসা হয়। এই গ্যারেজের কথা শিক্ষার্থীদের কাছে শুনে ১৯ জুলাই কয়েকজন মেডিকেল শিক্ষার্থী কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে যান। সেই কষ্ট আর ভয়ংকর স্মৃতির ভিড়ে অর্থী জানতে পারেন, তাঁদের কাছে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যাওয়া এক কিশোর পরদিন পুলিশের গুলিতে মারা যায়। অর্থী বলেন, ‘চোখ বন্ধ করলেই বাচ্চাটার মুখ ভেসে ওঠে।’

অর্থীর স্বপ্ন
‘আমাদের স্বপ্ন ছিল—একটা নতুন বাংলাদেশের। এতগুলো মানুষ জীবন দিল। নতুন বাংলাদেশ আমার কাছে রক্ত দিয়ে পাওয়া, দেশটা হবে ন্যায় আর সাম্যের। এখানে থাকবে না ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি। নতুন বাংলাদেশ হবে সমৃদ্ধির, সমতার। জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে দেশের প্রত্যেক নাগরিক বেঁচে থাকবে পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে।’

অর্থীর প্রত্যাশা, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হোক। উন্নত পরিবেশে চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ যেন সুচিকিৎসার আওতায় আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা চান অর্থী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত