Ajker Patrika

ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপে কি ড্রাগনদের বাস

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১৬: ১১
Thumbnail image

হাজার হাজার বছর ধরেই ভয়ানক এক প্রাণী ড্রাগনের গল্প আলোড়িত করে আসছে মানুষকে। সুমেরু অঞ্চলের কিংবদন্তি থেকে শুরু করে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং পরে চীন, মিসর, ভারত, গ্রিস এমনকি গ্রেট ব্রিটেনের মতো জায়গায় ড্রাগন নিয়ে ডালপালা মেলেছে কত হাজারও গল্প। বই, সিনেমা, টিভি শোতে নিয়মিতই ড্রাগনকে দেখি আমরা। 

কিন্তু ড্রাগন কি সত্যি আছে, নাকি পুরোটা আমাদের কল্পনা। সত্যি বলতে ড্রাগন নামধারী অনেক প্রাণীই আছে পৃথিবীতে। তবে মুখ দিয়ে আগুন বের হওয়া সেই ভয়াল দর্শন ড্রাগন পুরোপুরিই কল্পনা। এমনকি ড্রাগন নামধারী বেশির ভাগ প্রাণী ততটা বিপজ্জনকও নয়। তবে কমোডো ড্রাগনের কথা যদি বলেন তবে হিসাবটা একটু আলাদা। দশ ফুটি প্রাণীটা যখন লকলকে জিব বের করে আপনার দিকে এগিয়ে আসবে, তখন আমাদের কল্পনার ওই ড্রাগনের কথাই হয়তো মনে পড়ে যাবে। উল্টো দিকে খিঁচে দৌড় দেওয়াটাই হবে তখন একমাত্র লক্ষ্য। 

লিজার্ডদের মধ্যে কমোডো ড্রাগনই সবচেয়ে বড় ও ভারী। প্রাপ্তবয়স্ক একটি কমোডো ড্রাগন ১০ ফুট পর্যন্ত হয় লম্বায়। ওজনের হয় ১৪০ কেজি বা ৩০০ পাউন্ডের মতো। তবে সাধারণত এদের ওজন ৭০ কেজি বা ১৫০ পাউন্ডের আশপাশে হয়। 

আনুমানিক ১৫১০ সালের হান্ট-লেনক্স গ্লোবে প্রথম সম্ভবত ‘হিক সান্ট ড্রাকোনস’ বা ‘এখানে ড্রাগন আছে’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। এশিয়ার পূর্ব উপকূলকে চিহ্নিত করা হয় এটা দিয়ে। চীনা নাবিকদের কয়েকটি ছোট ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপে ড্রাগন দেখার গল্পের ভিত্তিতে সম্ভবত এটা করা হয়। 

ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপের পাশাপাশি রিনকা, ফ্লোরস দ্বীপে দেখা মেলে তাদের। কমোডো জাতীয় উদ্যান এদের মূল আস্তানা। পার্কটিতে তিনটি বড় দ্বীপ কমোডো, পাদার এবং রিনকা ছাড়াও ছোট ২৬টি দ্বীপ আছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) দেওয়া তথ্য বলছে বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে বুনো পরিবেশে টিকে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক কমোডো ড্রাগনের সংখ্যা ১ হাজার ৩৮৩। ছোট ও কিশোর বয়সী ড্রাগনের সংখ্যাটাও কম নয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানায় বেশ কিছু কমোডো ড্রাগন আছে। 

যতদূর জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার কমোডো দ্বীপে বাস করায় আর ভয়ানক চেহারা ও লম্বা হলুদ জিভ মিলিয়ে পৌরাণিক সেই ড্রাগনের সঙ্গে কিছুটি মিল খুঁজে পাওয়াতেই এর নাম রাখা হয় ‘কমোডো ড্রাগন’। 

ইতালির রোমের চিড়িয়াখানায় শিশু কমোডো ড্রাগন। ছবি: এএফপিস্থানীয়রা এদের কথা জানলেও পৃথিবীর মানুষের কাছে এরা পরিচিত হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে ১৯১০ সালে। ওই সময় ইন্দোনেশিয়া ছিল ডাচদের কলোনি। এখানকার ডাচ প্রশাসক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জ্যাক কেল হেনরি ভ্যান স্টেইন ভ্যান হেনসব্রুক। ডাঙায় বাস করে এমন বিশাল আকারের ‘কুমিরের’ গল্প শুনে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন তিনি। কমোডো দ্বীপে অভিযান চালিয়ে ফেরেন আশ্চর্য এই প্রাণীদের ছবি আর একটা চামড়া নিয়ে। 

যে দ্বীপগুলোয় কমোডো ড্রাগনের বাস সেখানে তারাই রাজা। মোটামুটি যা পায় তাই খায় এরা। ইতিমধ্যে মারা যাওয়া প্রাণী খেতেও তাদের আপত্তি নেই। হরিণ, মহিষ, শূকর এমনকি বাচ্চা বা কম বয়স্ক কমোডো ড্রাগনদেরও খায় এরা। তবে এসব বাচ্চা কমোডো ড্রাগনেরা খুব চটপটে। গাছে চড়ে বড়দের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার তরিকা খুব দ্রুতই শিখে নেয় তারা। 

কমোডো ড্রাগনের মানুষকে আক্রমণের ঘটনাও ঘটে, যদিও সংখ্যাটা বেশি নয়। বন্য এবং চিড়িয়াখানায় বন্দী দুই ধরনের কমোডো ড্রাগনের থেকেই এমন আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে কমোডো ন্যাশনাল পার্কের তথ্য অনুসারে, মানুষের ওপর ২৪টি আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে পাঁচজন নিহত হন। নিহতদের বেশির ভাগই কমোডো জাতীয় উদ্যানের আশপাশে বসবাসকারী স্থানীয় গ্রামবাসী। 

শিকারের সময় কমোডো ড্রাগন তাদের লুকিয়ে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা ও ধৈর্যের প্রমাণ দেয়। ঝোপ-জঙ্গল বা লম্বা ঘাসে ঘাপটি মেরে থাকে, যতক্ষণ না কোনো শিকার পাশ দিয়ে যায়। নাগালের মধ্যে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্তিশালী পা এবং ধারালো নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে। তারপর ধারালো দাঁত ডুবিয়ে দেয় শিকারের শরীরে। 

শুনে অবাক হবেন, স্ত্রী কমোডো ড্রাগন পুরুষ ড্রাগন ছাড়াই প্রজনন করতে সক্ষম। এটি পার্থেনোজেনেসিস নামে পরিচিত অযৌন প্রজননের একটি প্রক্রিয়ার কারণে হয়। ২০০৬ সালে প্রথম বিষয়টি জানা যায়, যখন ফ্লোরা নামক একটি ড্রাগন ইংল্যান্ডের চেস্টার চিড়িয়াখানায় পাঁচটি শিশু ড্রাগন জন্ম দেয়। অথচ কোনো পুরুষ কমোডো ড্রাগনের সঙ্গে কখনো তাকে রাখা হয়নি। 

লন্ডন চিড়িয়াখানার জো ক্যাপনের মতে, কমোডো ড্রাগনের উদ্ভব ৯ কোটি বছর আগে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা বিশালাকায় মনিটর লিজার্ড বা গুইসাপ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে এদের উদ্ভব। এতদিন ধরে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় একপর্যায়ে নিজেরাই একটি প্রজাতিতে পরিণত হয়। 

 ১৯২৬ সালে উইলিয়াম ডগলাস বার্ডেন নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানার জন্য এক জোড়া ড্রাগন ধরতে কমোডো দ্বীপে যান। বার্ডেনের বন্ধু, চলচ্চিত্র পরিচালক মেরিয়ান কুপার তাঁর ১৯৩৩ সালে মুক্তি পাওয়া কিং কং ছবিতে দুঃসাহসিক সেই অভিযানের অনেক উপাদানই ব্যবহার করেন। কুপার সব সময়ই চেয়েছিলেন দৈত্যাকার একটি গরিলা বা শিম্পাঞ্জিজাতীয় প্রাণীকে ঘিরে আবর্তিত হবে কাহিনি। তবে রহস্যময় দ্বীপ এবং বিশাল আকারের প্রাচীন দানব সরীসৃপগুলোর দৃশ্য চিত্রায়িত হয় বার্ডেনের ভ্রমণে অনুপ্রাণিত হয়ে। যতদূর নানা যায় কমোডো ড্রাগনদের নামটি দেন বার্ডেনই। 

স্পেনের এক চিড়িয়াখানায় ভয়াল দর্শন জিভ বের করে আছে একটি কমোডো ড্রাগন। ছবি: এএফপিএবার শক্তিশালী এ সরীসৃপদের চেহারার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। এদের মাথা চওড়া ও চ্যাপ্টা, নাক কিছুটা বৃত্তাকার, পা বাঁকানো এবং লেজটা বিশাল ও পেশিবহুল। তাদের হাঁটা অবশ্য খুব দ্রুতগতির নয়। ১০ মাইলের বেশি গতি তোলাটাই ওদের জন্য বেশ কঠিন। ততে এই ড্রাগনদের যে জিনিসটা আপনার নজর কাড়বে সেটি, লম্বা হলুদ জিব। ক্রমাগত এটা বাইরে বের করে আনে আবার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। এমনিতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাভানা বনে বাস করে। তবে দ্বীপের বিস্তৃত সৈকত এমনকি পাহাড়েও এরা বিচরণ করে। 

স্ত্রী কমোডো ড্রাগন একবারে ৩০টি ডিম পাড়তে পারে। এগুলো এরা কয়েক মাস ধরে পাহারা দেয়। শিশুদের সবুজাভ শরীরে হলুদ ও কালো বলয়ের মতো থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধূসর থেকে লালচে-বাদামি হয়ে যায় এই রং। ছোট ড্রাগনরা বড় কমোডো ড্রাগনসহ অন্য শিকারি প্রাণীদের এড়াতে আট মাস বয়স না হওয়া পর্যন্ত গাছেই থাকে। 

ভয়ংকর চেহারারা এই ড্রাগনদের শিকারের বেশির ভাগ প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তবে তাতে এদের বয়েই গেছে। একবার যদি শিকারকে কামড়াতে সক্ষম হয় তবেই হয়েছে। এদের লালায় থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং বিষ কয়েক দিনের মধ্যে শিকারকে মেরে ফেলবে। প্রাণীটি মারা যাওয়ার পরে, যার জন্য চার দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে, কমোডো তার শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে দেহটি শনাক্ত করে। প্রায়ই কোনো একটি শিকার অনেক কমোডো ড্রাগনকে মিলেমিশে খেতে দেখা যায়। এদের দৃষ্টিশক্তিও প্রখর, তাই অনেক দূর থেকেই শিকারকে দেখতে পারে। 

এই সরীসৃপদের বড়, বাঁকা ও ধারালো দাঁত এদের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। যেগুলো মাংস ছিঁড়ে খেতে সাহায্য করে। দাঁতের ফাঁকে সাম্প্রতিক খাওয়া মাংসের কণা রয়ে যায়। এই প্রোটিন-সমৃদ্ধ পচা মাংসে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া উপস্থিত থাকে। এদের লালায় প্রায় ৫০ ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যার মধ্যে অন্তত সাতটি খুব ক্ষতিকর। গবেষকেরা ড্রাগনের নিচের চোয়ালে একটি বিষ গ্রন্থিরও সন্ধান পেয়েছেন। এ বিষ রক্তকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, যা ব্যাপক রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে শিকারকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। 

তবে কমোডোর কামড় কিন্তু অন্য কমোডো ড্রাগনের জন্য মারাত্মক নয়। একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করার সময় আহত ড্রাগনেরা ব্যাকটেরিয়া এবং বিষে আক্রান্ত হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা কমোডো ড্রাগনের রক্তে এর বিষ বা ব্যাকটেরিয়ার প্রতিষেধক খুঁজছেন। এদের গলা এবং ঘাড়ের পেশি দ্রুত মাংসের বিশাল খণ্ড গিলে ফেলতে সাহায্য করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণী একবারে নিজের শরীরের ওজনের ৮০ শতাংশ খাবার গ্রহণ করতে সক্ষম। তবে যখন বিপদ দেখা দেয় তখন কমোডো ড্রাগন তাদের ওজন কমাতে তাদের পেটের ভেতরে জমা হওয়া খাবার ছুড়ে ফেলে দ্রুতগতিতে পালাতে পারে। 

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিডস, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, স্মিথসোনিয়ানস ন্যাশনাল জু, বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত