Ajker Patrika

অসুস্থ হয়ে পড়ছে কনটেন্ট মডারেটররা, মেটার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি

অনলাইন ডেস্ক
ছবি, ভিডিও ও পোস্ট পর্যালোচনা করার জন্য হাজার হাজার মডারেটরকে নিয়োগ দেয় ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। ছবি: বাম্বু নাইন
ছবি, ভিডিও ও পোস্ট পর্যালোচনা করার জন্য হাজার হাজার মডারেটরকে নিয়োগ দেয় ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। ছবি: বাম্বু নাইন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংস ও চরম আপত্তিকর কনটেন্ট মুছে ফেলতে গিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন কনটেন্ট মডারেটররা। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে আফ্রিকার দেশ ঘানায় আবারও আইনি জটিলতায় জড়াচ্ছে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। এ জন্য মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফক্সগ্লোভ।

প্রতিদিন কোটি কোটি ছবি, ভিডিও ও পোস্ট পর্যালোচনা করার জন্য হাজার হাজার মডারেটরকে নিয়োগ দেয় ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। তবে এঁরা মেটার সরাসরি কর্মী নন—তাঁদের কাজ করানো হয় বিভিন্ন তৃতীয় পক্ষের কোম্পানির মাধ্যমে। মেটার ব্যবহারকারীরা যখন কোনো কনটেন্ট রিপোর্ট করেন, তখন এই মডারেটররা সেটি খতিয়ে দেখেন এবং ঠিক করেন, সেটা সরিয়ে ফেলতে হবে কি না। তাদের কাজের মধ্যে থাকে—খুন, নির্যাতন, শিশু নিপীড়ন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা প্রভৃতি-সংক্রান্ত ভয়াবহ ভিডিও ও ছবি দেখা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও গুজব বিশ্লেষণ এবং পর্নোগ্রাফি ও যৌন সহিংসতার কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ। তবে এসব কনটেন্ট দেখার ফলে মডারেটররা নিজেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারেন।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘানার রাজধানী আক্রায় অবস্থিত একটি কোম্পানিতে প্রায় ১৫০ জন কনটেন্ট মডারেটর কাজ করছেন, যাঁদের নিয়োগ দিয়েছে ফরাসি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি টেলিপারফরম্যান্সের মালিকানাধীন মজোরেল। এই মডারেটররা দাবি করেন, কাজের চাপ এবং জঘন্য কনটেন্ট পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁরা বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অনিদ্রা ও মাদকাসক্তির মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

গার্ডিয়ান এবং ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের যৌথ অনুসন্ধানে জানা গেছে, মডারেটররা এমন ভয়াবহ ভিডিও দেখেছেন, যেখানে একজন মানুষকে জীবন্ত চামড়া তুলে ফেলা হচ্ছে কিংবা একজন নারীর শিরশ্ছেদ করা হচ্ছে। এমনকি এক ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করার পর চাকরি হারিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

এর আগে, কেনিয়াতে মেটার অন্য ঠিকাদার ‘সামাসোর্সের’ অধীনে কাজ করা ১৪০ জনের বেশি কনটেন্ট মডারেটর চরম মানসিক আঘাত ও পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) আক্রান্ত হন।

মজোরেলের বিরুদ্ধে এই দ্বিতীয় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফক্সগ্লোভ। এই সংগঠনটি ঘানার এজেন্সি ‘সেভেন সেভেন’-এর সঙ্গে কাজ করছে।

ফক্সগ্লোভের কো-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মার্থা ডার্ক বলেন, ‘গত ছয় বছরে বিশ্বের নানা প্রান্তে সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট মডারেটরদের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু এর মধ্যে ঘানার পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেটা তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাকর্মীদের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করছে। এসব কর্মীকে বস্তুর মতো ব্যবহার করছে। তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর যে স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে, তার প্রতি বিন্দুমাত্র দায়বোধ বা সহানুভূতিও নেই।’

প্রকাশিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী ঘানাতে মডারেটরদের মূল বেতন প্রায় ১ হাজার ৩০০ ঘানাইয়ান সেডি, যা পারফরম্যান্স বোনাসসহ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৯০০ সেডি পর্যন্ত হতে পারে। অথচ আক্রা শহরের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পরিমাণ যথেষ্ট নয়। মার্থা ডার্ক জানান, অনেকে বাঁচার জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হন, অথচ ওভারটাইমে পারিশ্রমিক কম দেওয়া হয়।

তবে টেলিপারফরম্যান্স দাবি করেছে, তারা ঘানাতে স্থানীয় কনটেন্ট মডারেটরদের গড় ন্যূনতম মজুরির চেয়ে ১০ গুণ এবং বিদেশ থেকে আগত কর্মীদের ক্ষেত্রে ১৬ গুণ পর্যন্ত বেতন দেয়। এই পারিশ্রমিকের মধ্যে প্রকল্প ভাতা, পরিবহন খরচ ও ভাষা দক্ষতার ভিত্তিতে বিশেষ ভাতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—যেগুলো কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে নয়, বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সকল কর্মীকেই দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, তারা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানে পূর্ণ সময়ের জন্য লাইসেন্সধারী মনোবিজ্ঞানী ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী কাউন্সেলর নিয়োগ দিয়েছে, যারা স্থানীয় স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিবন্ধিত সদস্য।

অন্যদিকে, ফক্সগ্লোভের গবেষক মিকায়েলা চেন বলেন, তিনি মডারেটরদের আবাসনের ছবি দেখেছেন যেখানে ‘একটি ফ্ল্যাটে পাঁচজন, একটি রুমে দুজন করে গাদাগাদি করে থাকেন’। তিনি বলেন, অফিসের পরিবেশে নজরদারি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ব্যবস্থাপকেরা মডারেটরদের টয়লেটে যাওয়া পর্যন্ত অনুসরণ করেন।

টেলিপারফরম্যান্স অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, মডারেটরদের আবাসনটি নিরাপদ। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, জিম এবং সুইমিং পুলসহ বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে।

এজেন্সি সেভেন সেভেনের একজন অংশীদার কার্লা অলিম্পিও বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে ঘানার আদালতে ব্যক্তিগত আঘাতের মামলা সফল হতে পারে এবং এটি একটি নজির স্থাপন করবে যে কর্মীদের সুরক্ষা শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি মানসিক ক্ষতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ফক্সগ্লোভের আরেক সহনির্বাহী পরিচালক রোজা কার্লিং জানান, তাঁরা আদালতের কাছে আবেদন করতে চান—যেন তাৎক্ষণিকভাবে কর্মপরিবেশের পরিবর্তন, যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়।

মেটার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা যেসব কোম্পানির সঙ্গে কাজ করে তাদের ‘চুক্তি ভিত্তিকভাবে’দেশের শিল্প মানের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দিতে বলে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও অন্যান্য সহায়তার শর্তও জুড়ে দেয়।

তারা আরও বলেছে, সব মডারেটরকে গ্রাহক তথ্যের নিরাপত্তার জন্য গোপনীয়তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়। তবে তাঁরা চিকিৎসক বা কাউন্সেলরের সঙ্গে নিজের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত