Ajker Patrika

মতানৈক্য রেখেই সংলাপ শেষ করল বিএনপি

  • জ্যেষ্ঠ তিনজন থেকে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব।
  • আইসিটির চার্জশিটভুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য করা মানেনি।
  • জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে অমত।
  • উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্যের বিষয়ে একমত।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
মতানৈক্য রেখেই সংলাপ শেষ করল বিএনপি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে মত–দ্বিমত জানানোর মাধ্যমে প্রথম ধাপের সংলাপ শেষ করলো বিএনপি। রাষ্ট্র পরিচালনায় ঝুঁকি এবং নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করতে পারে মনে করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে (এনসিসি) একমত হয়নি দলটি। ডকট্রিন অব নেসেসিটি (প্রয়োজনের নিরিখে) বিবেচনায় রেখে প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব দলটির। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের (আইসিটি) মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামীদের নির্বাচনে অযোগ্য করার প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে তারা।

রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে জাতীয় সংসদের এলডি হলে সংলাপ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেদিন সংবিধান ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শেষে বৈঠক মূলতবি হয়। এরপর রোববারের বৈঠকও একই বিষয়ে আলোচনার পর মূলতবি হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১ টায় আবার শুরু হওয়া বৈঠক দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে চলে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। এতে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা করে বিএনপি। সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের সুপারিশে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নির্বাচন কমিশন থেকে সরিয়ে আলাদা সংস্থা করা, আসন সীমানা নির্ধারনে স্বতন্ত্র কমিশন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও শপথ ভঙ্গের ক্ষেত্রে পরবর্তী সংসদীয় কমিটি তদন্ত এবং আইসিটি আদালতের মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামী হলেই নির্বাচনে অযোগ্য– এই চারটি বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। তাদের কথা হচ্ছে, প্রথম তিনটি বাস্তবায়ন হলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হবে এবং কমিশনের স্বাধীন সত্তায় আঘাত আসবে। এ তিনটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও চিঠি পাঠানো হয়েছিল।

সংস্কার কমিশন আইসিটি আদালতে সাজাপ্রাপ্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরপরই সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করার সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ এই সুপারিশ কার্যকর হলে কোনো ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হলেই আর প্রার্থী হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে আপিল করা না–করা কোনো ভূমিকা রাখবে না। এ বিষয়ে দ্বিমত জানিয়ে বিএনপি বলেছে, বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তিসঙ্গত নয়।

বিচার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে প্রবীণতম বিচারপতিকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি বিষয়টিতে দ্বিমত জানিয়ে বলেছে, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বিবেচনায় রেখে প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে... রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু অসঙ্গতি আগে দেখা গেছে। সর্বক্ষেত্রে আমরা যদি নির্দিষ্ট করে দিই, কোন বিকল্প না থাকলে, ভবিষ্যতে যেহেতু আমরা বিচারবিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে চাই, সেক্ষেত্রে আগের মত কোন বিতর্কিত ব্যক্তি (যদি) প্রধান বিচারপতি হন, এটা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না।’

একজন সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে দুইবারের পরে বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে রোববার মূলতবি হওয়া বৈঠকের আলোচনায় একজন সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন এমন কথা হয়েছিল। এ বিষয়টি বিএনপি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিকল্প প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করুন। আর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি দেয়নি।’

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য নির্বাচিত হবেন। বিএনপি উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্যের বিষয়ে একমত হলেও তা বিদ্যমান সংবিধানের নারী আসন মনোনয়ন পদ্ধতির মতো নির্বাচিত আসন সংখ্যার অনুপাতে ভাগ করার পক্ষে।

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবের সঙ্গেও বিএনপি একমত নয়। দলটি বলেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, সংসদীয় চর্চা এবং বাস্তবতার নিরিখে এটা সুবিবেচিত ধারণা নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন এই ধারণা ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। এটি নির্বাহী বিভাগকে একটি দুর্বল অঙ্গে পরিণত করার প্রয়াস বলে মনে হয়।

এ বিষয়ে সালাহ্উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এনসিসি ধারণাটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সংসদীয় ইতিহাসে একটা নতুন আইডিয়া। আমরা পরীক্ষা করে যতটুকু দেখলাম, এখানে দুইটা সময়ে যখন সংসদ থাকবে না অথবা সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে তখন মাত্র চারজন ব্যক্তি থাকবেন। তার মধ্যে একজন কেবল পরোক্ষভাবে নির্বাচিত থাকবেন। বাকি তিনজনের হাতে সুপ্রিম পাওয়ার (সর্বোচ্চ ক্ষমতা) থাকবে। তখন রাষ্ট্রের অবস্থা হয়তো ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া সংবিধানের সেন্স (ভাবধারা) হচ্ছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া।’

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাবেও একমত নয় বিএনপি। মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমানো, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পদের নাম পরিবর্তন ,উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু এবং পৌরসভা শক্তিশালী করণের মতো বিষয়গুলোতেও একমত নয় দলটি।

বিএনপি একমত হয়নি এমন অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস পদ সৃষ্টি করা, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের পাবলিক একাউন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি করা ইত্যাদি।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে নতুন নতুন প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেছেন, আলোচনায় নতুন প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কারণ এগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এসেছে কমিশনগুলোর কাছ থেকেই।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান।

বিএনপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান।

মে দিবসে ঢাকায় বড় সমাবেশ

আগামী ১ মে মহান মে দিবস ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে রাজধানীতে বড় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেলা ২টায় জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের উদ্যোগে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল বিকেলে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। এর আগে মে দিবস উদ্‌যাপন নিয়ে দলের যৌথ সভা হয়। সংবাদ সম্মেলনে নজরুল ইসলাম খান বলেন, সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন। এতে ঢাকার পাশাপাশি আশপাশের জেলাগুলোর নেতা-কর্মীরাও অংশ নেবেন। ঢাকার পাশাপাশি দেশের সব মহানগর ও জেলা শহরে স্থানীয় শ্রমিক দলের উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান নজরুল ইসলাম খান। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রম সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তা বিএনপি সমর্থন করে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত