Ajker Patrika

একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান-প্রধানমন্ত্রী-সংসদ নেতা হওয়ায় সমস্যা দেখছে না বিএনপি

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২১ জুলাই ২০২৫, ১০: ২৯
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গতকাল রোববার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় ধাপের ১৫ তম দিনের বৈঠকে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছে। ঐকমত্য কমিশনের কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি স্পষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে তারা আদালতের ওপর আস্থা রাখতে চাচ্ছেন। তবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রশ্নে বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই থাকতে চায় বিএনপি। বিশেষ করে সরকার, সংসদ ও রাজনৈতিক দলে একই ব্যক্তির প্রধান থাকাটাকে কোনো সমস্যা মনে করছে না দলটি।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের গতকালের বৈঠকে একটি মৌলিক বিতর্ক উঠে এসেছে: একই ব্যক্তি কি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে একসঙ্গে থাকতে পারবেন কিনা?

এ ক্ষেত্রের বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, একই ব্যক্তি এই তিন পদে থাকতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা রাখার পক্ষে নয় বিএনপি। তাঁদের যুক্তি হলো, এটি একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। তিনি বলেন, ‘একই ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে কি না, এটাতে কোনো বাধ্যবাধকতা রাখার পক্ষে না আমরা। কারণ এটি একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার।’

সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিএনপি মনে করে, দলীয় প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন এমন কোনো কথা নেই; কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা সংসদীয় দলের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় ঠিক হবে। তিনি যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানেও দলের প্রধান ব্যক্তিই প্রধানমন্ত্রী হন, যা সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। বিএনপির মতে, শুধু দলীয় প্রধান হওয়ার কারণে কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা গণতন্ত্রবিরোধী এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চার পরিপন্থী।

এর বিপরীতে, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। তাঁকে যে কোনো একটিতে থাকতে হবে এবং তিনটি পদে তিনজন আলাদা ব্যক্তি থাকবেন। এই প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য হলো, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন রোধ করে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ তৈরি করা।

স্পষ্টত, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ও দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের এই মতভিন্নতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং দলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। বিএনপি দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর জোর দিচ্ছে, যদিও দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। দলের অভ্যন্তরে কীভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা করবে সে ব্যাপারে কখনোই সুস্পষ্ট রূপরেখা জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি কার্যত পরিবার কেন্দ্রিক চক্রেই আটকে আছে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকেরা।

এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন ও অন্যান্য পক্ষ ক্ষমতার সুষম বণ্টন এবং নেতৃত্বের বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। ঐকমত্য কমিশন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মতো দলগুলো সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) এবং দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি না হওয়ার পেছনে যে যুক্তিগুলো তুলে ধরেছে তা এ রকম—

একজন ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ একসঙ্গে ধারণ করলে, দল এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে ওঠা ব্যাহত হয়। এটি অন্যান্য যোগ্য ব্যক্তিদের উঠে আসার এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগকে সীমিত করে।

ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন দলীয় আদর্শকে রাষ্ট্রের কাঠামো এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে, যার মধ্যে বিচার বিভাগ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা অন্তর্ভুক্ত, অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি দল ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দেয়, এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।

অন্যান্য দলীয় সদস্যদের নেতৃত্ব পদে, যার মধ্যে সংসদীয় পদও অন্তর্ভুক্ত, আকাঙ্ক্ষা করা এবং অর্জন করার সুযোগকে সীমিত করে, কারণ মনোনয়ন প্রায়শই সেই একক ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছ থেকে আসে।

একক ব্যক্তিকে ‘বিকল্পহীন’ ভাবার সংস্কৃতি ভাঙতে তিন পদ পৃথক করার উদ্যোগ সহায়ক হতে পারে। বর্তমান নেতার কোনো বিকল্প নেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে। এটি একটি আরও গতিশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে।

একজন ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কেন্দ্রীভূত করে এবং দলের মধ্যে ভিন্নমত বা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমিত করে অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে পারে।

যখন দলীয় প্রধান একই সঙ্গে সরকার প্রধান হন, তখন দলীয় আনুগত্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশ করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে তাদের নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা এবং সুশাসন ও আইনের শাসনের নীতিগুলোকে দুর্বল করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নতুন রূপরেখা

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দীর্ঘদিনের বিতর্কিত বিষয়। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এই ব্যবস্থা বাতিল হলেও, এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে আদালতের রায়ের ওপর আস্থা রাখছে। তাঁরা আশা করেন, আপিল বিভাগের রিভিউ পর্যায়ে বিচারাধীন এই বিষয়টি আদালতের রায়ের মাধ্যমেই আবার চালু হবে। তবে, সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেছেন, আদালতের রায়ে যদি ব্যবস্থা পুনর্বহাল না-ও হয়, সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদেরও সম্পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে নতুন করে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার।

আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যের বিষয় হলো, বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে। এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে। ঐকমত্য কমিশন এই বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে এবং দলগুলোকে আগামী মঙ্গলবার মতামত জানাতে বলা হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগে একটি নতুন রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধী দলীয় হুইপ এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন। এই কমিটি বিভিন্ন দল বা জনগণের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নাম আহ্বান করতে পারবে এবং শর্টলিস্ট করার পর প্রয়োজনে র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করা হবে।

প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের জন্য নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে আরও ৩০ দিন সময় বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যকর হলে প্রধান উপদেষ্টার ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর মতোই হবে, তবে সীমিত পরিসরে—রুটিন দায়িত্বে সীমাবদ্ধ থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত