Ajker Patrika

অবরুদ্ধ দেশের সাংবাদিকতা

প্রেক্ষিত একাত্তর-৭

জাহীদ রেজা নূর
Thumbnail image
জাহীদ রেজা নূর

‘বেআইনি ঘোষিত’ কথাটি এখনো একটি মুখরোচক আলোচনা হিসেবে রয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকার। প্রবল সেন্সরশিপের মধ্যেই চলছিল পত্রিকাগুলো। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন এই স্থবিরতা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে লাগলেন। আজকের লেখায় ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের কিছু ঘটনা দিয়ে কীভাবে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমানকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনা হলো, তা নিয়ে আলোকপাত করব।

ইরানে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রস্তাব রেখেছিলেন, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করার। এ প্রস্তাবে মর্মাহত হয়েছিলেন পিডিবি নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান।

পিপিআই পরিবেশিত খবরটি ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল ১২ জুলাই। খবরের শিরোনাম ছিল ‘নবাবজাদা নসরুল্লাহ মর্মাহত হইয়াছেন’। শোল্ডার ছিল ‘বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার জন্য ভুট্টোর প্রস্তাবে’।

১২ জুলাই ইত্তেফাকের মূল শিরোনাম ছিল মরক্কো বিষয়ে। মূলত মরক্কোয় সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে এসে বাদশাহ হাসান ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার ডান দিকের তিন কলাম জুড়ে ছাপা হয়েছিল কিসিঞ্জারের (ইত্তেফাক লিখেছিল কিসিংগার) পাকিস্তান সফর নিয়ে একটি রিপোর্ট। তিন দিন পাকিস্তানে অবস্থানের পর কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। পাকিস্তানি পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন যে কিসিঞ্জার তথ্যানুসন্ধান মিশনে এসেছিলেন, কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আসেননি।

এই খবরটির নিচেই ছাপা হয়েছিল নবাবজাদা নসরুল্লাহর খবরটি।

নসরুল্লাহ বলেছিলেন, একটি আপস ফর্মুলা উদ্ভাবনের জন্য বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বর্তমান সরকারের আলোচনা করা উচিত বলিয়া জনাব ভুট্টো যে প্রস্তাব দিয়াছেন তাহাতে তিনি মর্মাহত হইয়াছেন।

নবাবজাদা বলেন, পাকিস্তানের যে কেহ বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা চালানোর প্রস্তাব দিলে তিনি আমাদের জাতীয় স্বার্থের চরম ক্ষতি করিবেন।

ভুট্টো ইরানি একটি পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা নিয়া নসরুল্লাহ বলেন, এই সাক্ষাৎকারে জনাব ভুট্টো আরো বলেন যে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যার সমাধান করিতে পারিবে না বিধায় যথা শীঘ্র বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।

পিডিপি নেতা আরো বলেন, ইতিমধ্যে রাশিয়া ও অন্যান্য পশ্চিমি দেশ আমাদের উপর প্রবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করিয়াছে এবং ভারতীয় প্রচারণায় চালিত হইয়া তাহারা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য হইচই করিতেছে। এমতাবস্থায় বিদেশের মাটিতে বসিয়া জনৈক পাকিস্তানি নেতা যে দুর্ভাগ্যজনক উক্তি করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের দুশমনদের হাতই শুধু শক্তিশালী হইবে না, সেই সাথে বাংলা দেশ দুষ্কৃতিকারীদের মনোবল বৃদ্ধি পাইবে।

তিনি আরো বলেন যে, ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিকরাও হতাশ হইয়া পড়িবেন। অথচ ইহারাই জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ফিরাইয়া আনার জন্য অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে প্রদেশের সর্বত্র শান্তি কমিটি গঠন করিয়াছেন এবং আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতক ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাজাকার বাহিনী গঠনের কাজে নিয়োজিত রহিয়াছেন।

নবাবজাদা নসরুল্লাহ বলেন, ভাবিতে আশ্চর্য লাগে ইনি কি সেই ভুট্টো যিনি সামরিক ব্যবস্থা ও শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পর করাচি বিমানবন্দরে বলেন, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ পাকিস্তান বাঁচিয়া গিয়াছে।’

কিসিঞ্জারের সঙ্গে বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেনের বৈঠক হয়েছে—এ রকম একটি খবর ছড়িয়ে পড়লে ইসলামাবাদ থেকে এপিপি জানায় যে খবরটি সত্য নয়। এই খবরটিও ছাপা হয় ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায়। ইত্তেফাক এই খবর দুটি এত গুরুত্ব দিয়ে কেন ছাপল? যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার যে অনন্য নজির এইসব সংবাদে দেখা যাবে, তা ক্রমেই আলোচিত হবে।

আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব, বাংলাদেশ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল তখন। নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এই শব্দগুলো উচ্চারণ করায় তা লুফে নিল ইত্তেফাক। সিরাজুদ্দীন হোসেন ঠিক করলেন এই কথাগুলো রাখতে হবে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়।

মজার ব্যাপার হলো, ইরানি সংবাদ সংস্থার এই খবরটি বিবিসি প্রচার করলে ভুট্টো তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার আহ্বান তিনি জানাননি। এই খবরটিও ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। রিপোর্টটি ছিল এ রকম—

পিপিপি প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ইরানে অবস্থানকালে পাকিস্তান সরকারকে বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সহিত আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানাইয়াছেন বলিয়া বিবিসি যে রিপোর্ট প্রচার করে, জনাব ভুট্টো উহার সত্যতা অস্বীকার করেন।

গতকাল সন্ধ্যায় এখানে সাংবাদিকদের সহিত আলোচনাকালে তিনি বলেন যে, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী অংশের সহিত আলোচনার প্রশ্নই উঠে না এবং উহার কোন অবকাশই থাকিতে পারে না। তিনি বলেন, তাহার অভিমত হইল এই যে, বিচ্ছিন্নতাবাদের সহিত যাহাদের কোন সম্পর্ক নাই এই রূপ আওয়ামী লীগারের সহিত আলোচনা চলিতে পারে। বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত ঢাকায় বহু ঘন্টা আলোচনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া জনাব ভুট্টো বলেন যে, তিনি তাহাকে (শেখ মুজিবুর রহমানকে) স্বমতে আনয়নের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু শেখ সাহেব বাস্তববাদী মনোভাবের পরিচয় প্রদানে ব্যর্থ হন। উপরন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাতীয় পরিষদকে দ্বিধাবিভক্ত করার আহ্বান জানান, তখনই দেশকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট হইয়া ওঠে।

অতঃপর সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করেন আর এই ব্যাপারে পিপলস পার্টির ভাষ্য হইল জাতীয় পরিষদের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকিবে এবং শুধু ওই সকল আওয়ামী লীগ সদস্য আসন হারাইবে যাহারা বিচ্ছিন্নতাবাদের সহিত জড়িত রহিয়াছে।

এই রিপোর্ট থেকেও পরিষ্কার হয় যে ভুট্টো-ইয়াহিয়া যুক্তি করেই আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দিতে চেয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানিরাই যে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, সেটাও পরিষ্কার হলো।

দৈনিক ইত্তেফাক জুলাই মাস থেকেই বিভিন্নভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ-বাংলাদেশ-শেখ মুজিব’ ইত্যাদি শব্দ প্রকাশ করতে শুরু করল এবং অবরুদ্ধ বাংলার পাঠকেরা এই সাংকেতিক ভাষা থেকে সত্য খুঁজে নিতে লাগল।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত