Ajker Patrika

সাবেকি ব্যবস্থায় বাজার বাগে আসবে না

আজাদুর রহমান চন্দন
Thumbnail image
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসা তো দূরের কথা, আগের চেয়ে বরং আরও বেড়েছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাসার কাছের সুপারশপে গত মাসে দুই বা তিন লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল খুঁজে না পেয়ে ম্যানেজারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের স্টোরে আছে কি না। নিয়মিত ক্রেতা হওয়ার সুবাদে সুপরিচিত ম্যানেজার জানালেন, সয়াবিন তেলের সরবরাহ নেই। দাম বাড়ানোর কারসাজির অংশ হিসেবে বড় কোম্পানিগুলো বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন যেটুকু আছে তা-ও দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। তাই পাঁচ লিটার তেল কিনে নিতে পরামর্শ দিয়ে ভদ্রলোক বলেছিলেন, দাম বেড়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই। বাস্তবেও কিছুদিন পরই (৯ ডিসেম্বর) সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আট টাকা বেড়ে যায়। ফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫৭ টাকা। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা।

ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয় নভেম্বর মাসের শুরু থেকিই। বড় ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে সরকার ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ছাড়ের মেয়াদ তিন মাস বাড়িয়েছে। অর্থাৎ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পাম তেল, অপরিশোধিত সানফ্লাওয়ার তেল, অপরিশোধিত ক্যানোলা তেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি থাকবে বলেও জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চলতি মাসের প্রথমার্ধে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানিও করা হয়েছে। কিন্তু বাজারে সরবরাহের সংকট রয়েই গেছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকারিভাবে দাম আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন বড় ব্যবসায়ীরা। এর অংশ হিসেবে মিল থেকে ডিলারদের কাছে পর্যাপ্ত তেল দেওয়া হচ্ছে না। ফলে খুচরা পর্যায়ে সরবরাহে টান পড়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল বাজারে সিন্ডিকেটের অবসান ঘটবে, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসা তো দূরের কথা, আগের চেয়ে বরং আরও বেড়ে গিয়ে মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ কঠিন অবস্থার মুখে ছিল। বর্তমানে আরও কয়েক দফা মূল্য বাড়ার কারণে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা কতটা চাপে পড়েছে তা কেবল তাঁরাই ভালো জানেন। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমেছে। জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এর ফলে দেশে আমদানি ব্যয় অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু দেশের বাজারে এর কোনো ছাপ দেখা যাচ্ছে না।

আগেই উল্লেখ করেছি, অন্তর্বর্তী সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি চাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল, ডিম, চিনিসহ কিছু পণ্যে শুল্ক-কর কমানো হয়েছে। কেবল সাতটি নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানোয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ছাড় দিতে হচ্ছে। পণ্য পরিবহনে এবং হাট-বাজারে চাঁদাবাজিও নেই আগের মতো। অথচ এসবের কোনো সুবিধা পাচ্ছে না জনগণ। শুল্ক কমানোয় আমদানিজাত পণ্যের দাম কমে যাওয়ার কথা থাকলেও উল্টো আরও বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। নতুন আলুতে বাজার সয়লাব, তবু খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে মানভেদে কেজিপ্রতি ৫০-৭০ টাকায়। বাজারে সরবরাহ বাড়লেও প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ কিনতে গুনতে হচ্ছে ৯০-১২০ টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নিয়মিত ঢাকা মহানগরীর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দৈনিক খুচরা বাজারদর-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। টিসিবির ১৫ ডিসেম্বরের খুচরা বাজারদর-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের একই দিনের তুলনায় সরু চালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম ১৩ দশমিক ০৮ শতাংশ আর মোটা চালের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ আর বোতলজাত ২ লিটার ও লিটার সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ০১ ও ১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সমালোচনা করছেন রাজনীতিবিদেরাও। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা সিন্ডিকেট করতেন আওয়ামী লীগের লোকজন দিয়ে। এখন তো বাজারে সেই সিন্ডিকেট নেই। তাহলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কেন?’ যদিও ক্ষমতা কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বলছেন, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা বাজারে সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলছে। এককথায়, বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি মূলত বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্ক ছাড় আর সিন্ডিকেটকে দোষারোপের পুরোনো ঘেরাটোপেই আটকে আছে।

সাবেকি সাপ্লাই চেইন ও বাজারব্যবস্থা বহাল রেখে যতই আমদানি শুল্ক ছাড় দেওয়া হোক আর সিন্ডিকেট ভাঙার বাগাড়ম্বর করা হোক না কেন, বাজারে তার প্রভাব পড়বে সামান্যই। মাস দেড়েক আগেও এক নিবন্ধে বলেছি, সর্বজনীন স্থায়ী রেশন পদ্ধতি এবং কৃষিপণ্যের সমবায়ভিত্তিক বাজারব্যবস্থা চালু করা হলে সমাজে বৈষম্য যেমন কমবে, তেমনি বাজারে সিন্ডিকেট বানানোর প্রয়োজনীয়তাও ফুরাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এই যে এত এত সংস্কার কমিশন করা হলো, বাজার সংস্কার কমিশন কোথায়? অথচ বাজারব্যবস্থা সংস্কার না করে আর যা-ই হোক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে না।

গ্রামের যে কৃষক ১০-১২ টাকায় এক কেজি আলু বিক্রি করেন, সেই টাকা দিয়ে হয়তো ২৫ গ্রাম ওজনের চিপস কিনে নাতিকে দেন। ২৫ টাকায় এক কেজি কাঁচা হলুদ বিক্রি করে কোনো কৃষককে নামী ব্র্যান্ডের ৫০ গ্রাম ওজনের গুঁড়া হলুদ কিনতে হয় ৩০ টাকায়। লাভের টাকা পুরোটাই যায় সিন্ডিকেটের পকেটে। গ্রামের একজন কৃষক যে সবজি বিক্রি করছেন ১০-১৫ টাকা কেজি দরে, সেই সবজি শহরের ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। দুই-আড়াই টাকা কেজিতে কৃষকের বেচা পটোল, বেগুন, শসা কয়েক হাত ঘুরে হয়ে যাচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। মাঝখানে পাঁচ থেকে দশ গুণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাদের কাছে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই জিম্মি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বড় সহায়ক হতে পারে কৃষকের সমবায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কৃষকের উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ।

কৃষকেরা যত বেশি সমবায়ী হবেন, বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ততই কমে আসবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য আর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও কৃষকের সমবায়ী হওয়াটা জরুরি। জমিতে কৃষকের মালিকানা অক্ষুণ্ণ রেখেই শুধু দেশে জমির মাঝখানে থাকা আইল তুলে দিলে একটি জেলার সম-আয়তনের নতুন আবাদি জমি পাওয়া সম্ভব। এতে উৎপাদন বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। এর জন্য দরকার সমবায়। কিন্তু সমবায়ের কথা উঠলেই অনেকে আবার কৃষকের মনে নানা ধরনের অমূলক ভয় ধরিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। অথচ কুয়েত, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুরের মতো অনেক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও কৃষকদের শক্তিশালী সমবায় আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ৯০ শতাংশ কৃষক সমবায়ী। কুয়েতে খুচরা বাজারে পণ্যের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সমবায়ের মাধ্যমে। ভারতেও কৃষকদের অসংখ্য সমবায় সমিতি আছে যেগুলো স্থানীয়, আঞ্চলিক, রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ে কৃষিপণ্যের বিপণনে সহায়তা করে থাকে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে ২ শতাংশ। ফলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মানুষকে আয়-ব্যয়ের এই ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে ঋণ করে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে সাধারণ মানুষের অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। এ ছাড়া সবার জন্য রেশন সুবিধা থাকলে পরিস্থিতি এমন হতো না। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষেত্রেও এক মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা। এ দেশে তো অনেক সরকারি চাকুরেও পানির দামে রেশন সুবিধা পাচ্ছেন। এই সুবিধাটা সবাইকে না দিলে বৈষম্যমুক্ত সমাজ আদৌ হবে কি?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত