Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

স্বপ্ন না থাকলে সংগ্রাম অর্থহীন হয়ে যায়

ফওজিয়া মোসলেম।

ফওজিয়া মোসলেম বাংলাদেশের নারী মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন নিরলস যোদ্ধা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি। পেশায় চিকিৎসক ছিলেন।’ ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। একসময় সিপিবিতেও সক্রিয় ছিলেন। মৃদুভাষী, সদালাপি ফওজিয়া মোসলেমের সঙ্গে নারীর অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার

আপডেট : ২৫ মে ২০২৫, ১১: ০৭

আপনার জীবনের শুরু এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পেছনের প্রেরণা কী ছিল?

আমার বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ষাটের দশকে যখন ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ গড়ে উঠছিল, চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমি ভর্তি হই ১৯৬৪ সালে। তখন চারদিকে উত্তাল সময়—ভাষা, স্বাধিকার, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সেই পরিবেশে রাজনৈতিক চেতনা জন্মানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে আমার ছোট মামা ডাক্তার সৈয়দ খলিলউল্লাহ বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেন।

তৎকালীন পাকিস্তানে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের নৈতিক দায়বোধ থেকেই আমি রাজনীতিতে সক্রিয় হই। সময়ের পরিক্রমায় আমিও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। এখন অবশ্য আমার কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ততা নাই।

আপনি বহু বছর ধরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই সময়কালে কী পরিবর্তন দেখেছেন?

হ্যাঁ, মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আমি এর সঙ্গে যুক্ত। প্রথম দিকে আমাদের মূল লড়াই ছিল সাংবিধানিক অধিকার, নারী শিক্ষা, যৌতুকবিরোধী আইন, বাল্যবিবাহের অভিঘাত বিষয়ে নারী সমাজকে সচেতন করা ও সংগঠিত করা। পরের দশকে আমরা নারী নির্যাতনবিরোধী আইন, পারিবারিক আইন সংস্কার, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আন্দোলনে অগ্রসর হই। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারীর অধিকার মানব অধিকার হিসেবে পরিচিতি পায়।

নারীর জীবনে পরিবর্তন অবশ্যই এসেছে। মূল পরিবর্তন ঘটেছে নারীর চিন্তা জগতে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের নারীর মধ্যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী মুক্তি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জন্মেছে এবং নারীর শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, মিডিয়া ও সামাজিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতা বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতাও বেড়েছে। যেমন এখন নারী শিক্ষা বাড়লেও কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা কঠিন; আইন থাকলেও প্রয়োগ হয় না। সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা আগের তুলনায় সহিংস ও আরও নিষ্ঠুর রূপ নিচ্ছে, যা ঘটছে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো আবার পরোক্ষভাবে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী বিদ্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক সমাজের মধ্যে নারী বিদ্বেষ প্রচারের অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে ঘিরে সাম্প্রতিক যে ধর্মীয় বিরোধিতা দেখা গেছে, আপনি সেটিকে কীভাবে দেখছেন?

এটি নতুন নয়। আমরা যখনই নারীর অধিকার নিয়ে কোনো আইনি সংস্কারের কথা বলি, তখন একটি গোষ্ঠী ধর্মের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নারী আন্দোলনকে আঘাত করার চেষ্টা করে। নারী সংস্কার কমিশন মূলত বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সুপারিশ করেছে, বিশেষ করে নারীর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অধিকার বিষয়ে আইনের অসামঞ্জস্যতা দূর করে মানবিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন: উত্তরাধিকার, বিবাহ ও তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। কিন্তু কিছু সংগঠন একে ‘ধর্মবিরোধী’ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং অত্যন্ত অশোভন, অশ্লীল ও কুৎসিতভাবে তা প্রকাশ করছে যা কখনো রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। এইসব দলের বক্তব্য সংবিধানের সমতা ও মর্যাদার লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তাহলে আপনি বলছেন, ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া কেবল মতভিন্নতা নয়, বরং সাংগঠনিকভাবে অধিকার হরণ?

সাংগঠনিক অধিকার হরণ এভাবে আমি বলতে চাই না, কিন্তু নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিগত অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। যারা নারী সংস্কার কমিশনের বিরোধিতা করছে তারা কেবল নারীর বিরুদ্ধে নয়, প্রগতিশীল সমাজের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছে। আমরা বলি, ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে মানবাধিকারের বিরোধ নেই। আপনি যখন বলছেন, মেয়েরা সমান উত্তরাধিকার পাবে, কিংবা বিবাহে যৌক্তিক শর্ত থাকবে, তখন আপনি মূলত সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। আপনি মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করুন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে রাষ্ট্রীয় আইনে একজন নারী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক থাকবে। সংবিধানও সমতার কথাই বলে। এই কথাটিই আমরা আবার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি।

কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে। এটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

প্রশ্নটি বর্তমান সময়োপযোগী। আজকে যে নারী বিভিন্ন অফিসে ব্যাংকে, স্কুলে, মেডিকেল বা আইটি সেক্টরে কাজ করছেন তাঁকে দেখে মনে হতে পারে যে ‘সব ঠিক আছে’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁকে প্রতিদিন প্রমাণ করতে হয় যে সে ‘পুরুষের সমান’ কাজ করতে পারে। এই প্রমাণের চাপ পুরুষদের ওপর থাকে না।

নারীরা সমান কাজে কম মজুরি পাওয়া বৈশ্বিক সমস্যা হলেও বাংলাদেশে তা আরও প্রকট। ২০২৩ সালের একটি জরিপ বলছে, বেসরকারি সেক্টরে নারীরা পুরুষদের তুলনায় গড়ে ২১% কম পারিশ্রমিক পান। এ ছাড়া কর্মস্থলে যৌন হয়রানির ভয়, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে চাকরি হারানোর ঝুঁকি, পদোন্নতিতে বঞ্চনা ইত্যাদি তো আছেই।

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যে নীতিমালা আছে, তাও কি কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না?

২০০৯ সালে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, সব প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে খুব কম প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি গঠিত হয়েছে। তদুপরি কমিটি গঠিত হলেও পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও সংস্কৃতির কারণে সেগুলো নিরপেক্ষ ও যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। এ ছাড়া হাইকোর্টের নীতিমালার ভিত্তিতে এখনো কোনো আইন প্রণয়ন করা হয় নাই। নারী আন্দোলন এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়ে আসছে। ফলে অনেক নারী অভিযোগ করেও বিচার পান না, বরং উল্টো হেনস্তার শিকার হন। এই অবস্থায় নারী আত্মরক্ষার ও চাকরির স্বার্থে চুপ করে থাকার সংস্কৃতি অনুসরণ করে। এটা ভীষণ ভয়ংকর পরিস্থিতি। আমরা চাই এই নীতিমালাকে আইন হিসেবে প্রণয়ন করা হোক এবং বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠিত হোক।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নারীকে পদায়ন করার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ইতিবাচক নীতি-সক্ষমতা এগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত। নারী বলতে আমরা শুধু সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী বুঝি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, ব্যাংকের বোর্ড, স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক দলের কার্যনির্বাহী কমিটিতে কোথাও নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণ নেই।

সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন আছে, কিন্তু সেটা মনোনয়ননির্ভর। রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের মাঠে ব্যবহার করে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষদেরই আধিপত্য। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করছি, দলীয় পদে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সংবিধানের ১৯ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটি রাষ্ট্রের দায়।

নারীর চলাচলে, নিরাপত্তায় যে প্রতিবন্ধকতা, আপনি কি মনে করেন তা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা?

খুব পরিষ্কারভাবে বলি হ্যাঁ, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। আপনি যদি একটি মেয়ে হয়ে বাসে উঠে নিরাপদ না বোধ করেন, রাতের শহরে হাঁটতে ভয় পান, এতে নারীর ব্যক্তিগত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় যা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সংস্কৃতি এবং নারীর অভিযোগকে তুচ্ছ করার প্রবণতা এসব মিলে নারীর চলাচল, আত্মবিশ্বাস, কর্মপরিসর সংকুচিত করে ফেলেছে।

তাহলে ভবিষ্যৎটা আপনি কেমন দেখছেন?

আমি আশাবাদী। কারণ, তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে এ প্রজন্মের নারী মানসিকভাবে অগ্রসর, শক্তিশালী। ধারাবাহিক নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারীর মধ্যে যে শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে তা নারীকে সাহসী করে তুলেছে। বর্তমান প্রজন্মের নারীরা সব কাজে অংশগ্রহণে আগ্রহী, দক্ষ। আর এখনকার মেয়েরা টেকনোলজি, ব্যবসা, সাংবাদিকতা, খেলাধুলা সব জায়গায় আত্মপ্রকাশ করছে। তবে আমাদের এই পথচলা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা যদি রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার এই ত্রিপক্ষীয় কাঠামোয় সমতা না আনতে পারি, তাহলে ব্যক্তি অর্জন সমাজে প্রভাব ফেলবে না।

নারী শিক্ষা এখন অনেক এগিয়েছে। তাহলে শিক্ষার এই বিস্তৃত সুযোগ নারীর অবস্থানকে কতটা বদলাতে পেরেছে?

আমাদের সময়ে, বিশেষ করে ষাট-সত্তরের দশকে, মেয়েদের মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করাটাই ছিল বিশেষ কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সাহস কিংবা সুযোগ অনেকেই পেত না। এখন গ্রামের মেয়েরাও কলেজে যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি।

কিন্তু শুধু শিক্ষার পরিসংখ্যান দিয়ে নারীর অবস্থান নির্ধারণ করা যায় না। আজকে আপনি একজন নারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্রী হিসেবে দেখবেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সে যখন পদোন্নতির সময় নিজের যোগ্যতার বদলে ‘নারী হওয়া’কে বাধা হিসেবে পায়, তখন বুঝতে পারবেন, শিক্ষা সমাজের চেতনাকে কতটুকু বদলাতে পেরেছে। শিক্ষা মানেই ক্ষমতায়ন নয়, যদি সেই শিক্ষায় নারীর আত্মমর্যাদা, সমতা ও অধিকারবোধ না থাকে। আর এটিই হলো আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।

তাহলে আপনি বলছেন, শিক্ষা সত্ত্বেও নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না?

ঠিক সেটাই। আপনি মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন, সে পড়ালেখা করল কিন্তু তার কর্মস্থলে যেতে নিরাপত্তা নেই, বাসে উঠে হয়রানির শিকার হয়, পরিবারে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাহলে এই শিক্ষার সুফল কোথায়? দীর্ঘকালব্যাপী আমরা যে যে সামাজিক প্রথা কাঠামো গড়ে তুলেছি, আইন প্রণয়ন করেছি তা নারীর ক্ষমতায়নের অনুকূলে না। সুতরাং আমরা যখন ‘নারী উন্নয়ন’ বলি, তখন শুধু সংখ্যার উন্নয়ন দিয়ে কাজ হবে না, প্রয়োজন নারীবান্ধব সামাজিক কাঠামো, যা নারীর অধিকার।

বাংলাদেশের নগর জীবনে নারীর চলাচলের ওপর যেসব প্রতিবন্ধকতা, বিশেষত গণপরিবহনে, তা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন চিন্তার বড় ত্রুটি। আপনি নগরায়ণের কথা বলছেন, কিন্তু নগরবাসীর চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন হয় না। সেখানে নারী আরও প্রান্তিক। নারীর নিরাপদ চলাচল এই মৌলিক বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয় না। আজকে একজন মেয়ে সকালে অফিসে যাবে, সন্ধ্যায় ফিরবে, সে জানে না সে কোন বাসে উঠলে নিরাপদ থাকবে।

গণপরিবহনে যৌন হয়রানি এখন একটি নিরন্তর বাস্তবতা। শুধু শারীরিক হেনস্তা নয়, মানসিক যন্ত্রণাও প্রচণ্ড। আমরা বহু মেয়েকে পেয়েছি যারা হয়রানির ভয়ে পড়ালেখা বা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এটা কেবল একজন ব্যক্তির ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয়।

এ ছাড়া, নারীর চলাচলের জন্য শহরে নারীবান্ধব অবকাঠামো নেই। না আছে নারীবান্ধব ফুটপাত, না পর্যাপ্ত আলো বা নিরাপত্তাব্যবস্থা। এটা রাষ্ট্রীয় অবহেলার নমুনা।

রাজনৈতিক দলগুলো নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটা দেখছেন?

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নারীর প্রশ্নে এখনো দায়বদ্ধতার নিদর্শন দেখা যায় না। নির্বাচনের আগে তারা নারী ভোটের কথা বলে, সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা নিয়ে গর্ব করে, কিন্তু বাস্তবে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিসরে নারীর ভূমিকা নেই।

দলীয় কাউন্সিল, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কমিটি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাংগঠনিক পদে নারীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। শুধু পোস্টারে মুখ থাকলেই ‘উন্নয়ন’ হয় না। আমরা চাই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রকৃত, নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক নারী নেতৃত্ব।

আর সংরক্ষিত আসনের নারী এমপিদের আমরা শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তাঁরা যদি দলনির্ভর হন এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না থাকেন, তবে তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যায়। এটা শুধু একটি প্রতীক হয়ে থাকে। সেই কারণে আমরা সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন চাই।

আপনি একাধিকবার বলেছেন, রাষ্ট্র নারীকে দয়া নয়, অধিকার দিক। এই বার্তাটা যদি আপনি সরাসরি রাষ্ট্রকে দিতে চান, কী বলবেন?

আমি রাষ্ট্রকে আহ্বান জানাব নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দায়বদ্ধ হওয়ার জন্য। সংবিধানে সমতার যে কথা বলা হয়েছে, তা যেন কাগজে না থাকে, বাস্তবেও প্রতিফলিত হয়। একটি মেয়ে শিশুকে জন্মের পর থেকেই যেন রাষ্ট্রীয় সমান মর্যাদার আশ্বাস দিতে পারে—এই হোক রাষ্ট্রের নৈতিক দায়।

আমাদের নারীসুলভ কাজ বা ‘মা-বোন’ ভেবে সহানুভূতির দরকার নেই, আমাদের নাগরিক, সামাজিক ও পারিবারিক অধিকার চাই। একজন পুরুষের মতো একজন নারীও মানুষ হিসেবে পরিচিত হবে, রাষ্ট্রের নাগরিক হবে এবং সেই মর্যাদায় বাঁচবে এটাই রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। নারী ও পুরুষ উভয়কে মানবিক সমান অধিকার দিতে হবে।

তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ নারীরা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়, ফিল্ম, লেখালেখিতে, প্রতিবাদে অনেক দৃঢ় অবস্থানে আসছে। আপনি এটাকে কীভাবে দেখছেন?

আমি এটা অনেক ইতিবাচকভাবে দেখি। একসময় নারীরা সাহস করত না প্রতিবাদ করার, কিন্তু এখন তারা শুধু প্রতিবাদ করছে না, নিজের কণ্ঠও নির্মাণ করছে। তারা লিখছে, ছবি তুলছে, গান বানাচ্ছে, প্রতিবাদ করছে।

তবে এই চেতনার বিস্তার যেন শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। গ্রাম, শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা যেন এই আন্দোলনের আওতায় আসে, এই সংযোগটা আমাদের করতে হবে।

আপনি যে সংগ্রাম করেছেন, যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে কোনো বার্তা দিতে চান?

আমরা যারা আগের প্রজন্ম, তারা শুধু একটা কাঠামো তৈরি করে দিয়েছি। নতুন প্রজন্মকে তার গঠন, নির্মাণ ও পুনর্গঠন করতে হবে। তাদের বলব, পিছিয়ে পড়া নারীকে খুঁজে নাও, তাকে সঙ্গে নাও। নিজের উন্নয়নে আত্মতুষ্ট না হয়ে, অন্য নারীর অনুপস্থিতি বা সমস্যা চিহ্নিত করে সেখানেই কাজ শুরু করো। আর রাষ্ট্রের কাছে দাবি করতে শেখো—দয়া নয়, অধিকার চাও। একই সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়ে উঠতে হবে। অধিকার এবং দায়িত্ব একে অপরের সহযোগী। যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অধিকার হাতছাড়া হয়ে যায়।

আপনি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে অভিজ্ঞতা নারী প্রশ্নে কেমন ছিল?

কমিউনিস্ট রাজনীতি আমাকে শিখিয়েছে সংগ্রাম করতে, সংহতি গড়তে। কিন্তু সত্য বলতেই হয়, বাম রাজনীতির ভেতরেও নারীর প্রশ্ন সব সময় প্রাধান্য পায়নি। অনেক সময় ‘বৃহত্তর বিপ্লব’-এর কথা বলতে গিয়ে নারী বিষয়কে গৌণ করা হয়েছে। এখনো তাদের কমিটিগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্ত হয় নাই।

তবুও বলব, সেখান থেকে আমি রাজনৈতিক চেতনা পেয়েছি, বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি গড়েছি। পরবর্তী সময়ে যখন আমি মহিলা পরিষদে কাজ শুরু করি, তখন সেই চেতনা কাজে লেগেছে।

আপনি যখন মহিলা পরিষদে কাজ শুরু করেন, তখন কি ভেবেছিলেন এই পথটা এত দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ হবে?

শুরুতে বুঝি নাই যে নারী মুক্তির পথ এতটাই দীর্ঘ, জটিল ও বন্ধুর। আমাদের মানব সভ্যতার আদিতে যখন শ্রমের বিভাজন এবং সম্পদের মালিকানা ছিল না, তখন সমাজ ছিল নারীপ্রধান। পরবর্তী সময়ে শ্রমের এবং সম্পদের মালিকানাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠল পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে প্রোথিত নারীবিরোধী আইন, কাঠামো, প্রথার অবসান ঘটিয়ে সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে নারী মুক্তির পথ। সেই পথে নারী ও পুরুষকে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। এই কাঠামো পুরুষে-পুরুষেও বৈষম্য সৃষ্টি করে। অতীতের আন্দোলন এবং বর্তমান আন্দোলনকে এক ধারায় গ্রথিত করতে হবে। তাই আজও আমি আশাবাদী। এই যে এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও মেয়েরা লড়ছে, নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসছে, তাদের দেখে মনে হয়, পথটা কণ্টকাকীর্ণ হলেও, হাঁটতে হবেই।

আপনি নিজে একজন চিকিৎসক, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক। এত পরিচয়ের ভেতর নারী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন?

খুব স্পষ্ট করে যদি বলি অবশ্যই আমার পরিচয় আমি একজন নারী, একজন চিকিৎসক, একজন শিক্ষক এবং একজন রাজনৈতিক কর্মী। তবে আমার কর্মজীবনের সব ক্ষেত্রে আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে। আমার কাজ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা। আমার পরিবার এবং সহকর্মীরা আমার যাত্রায় যেভাবে সহায়তা করেছেন, তার জন্য আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

আপনি কি মনে করেন, এই দেশ একদিন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সত্যিকারের রাষ্ট্র হবে?

আমি স্বপ্ন দেখি সে স্বপ্ন ঘুমিয়ে নয়, জাগরণে, কর্মজগতে। আমি মনে করি, স্বপ্ন না থাকলে সংগ্রাম অর্থহীন হয়ে যায়। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম একটা রাষ্ট্রের, যেখানে নারী স্বাধীনভাবে হাঁটবে, সিদ্ধান্ত নেবে এবং নিজের চাহিদা ও জীবনের অধিকার নিজেই স্থির করবে। সেই রাষ্ট্র এখনো আসেনি, তবে তার দিগন্ত দেখা গেছে। যদি নতুন প্রজন্ম এই স্বপ্নকে ধারণ করে, প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তবে একদিন এই দেশ নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিষাক্ত গ্যাস

সম্পাদকীয়
বিষাক্ত গ্যাস

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?

চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।

আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?

এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রশ্নবিদ্ধ উপদেষ্টারা ও সরকারের নিরপেক্ষতা

অরুণ কর্মকার
প্রশ্নবিদ্ধ উপদেষ্টারা ও সরকারের নিরপেক্ষতা

না, সব উপদেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ নন। তবে সংখ্যাটা যে নেহাত কম হবে না, তা অনুমান করা যায় যখন প্রধান তিনটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলই আলাদা আলাদাভাবে উপদেষ্টাদের দলঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তোলে। অবশ্য এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একই অভিযোগ তোলা হয়েছে, যখন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম কোনো কোনো উপদেষ্টার সেফ এক্সিটের প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। আর এবার তো জানা গেল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দৃষ্টিতে দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের নামধামের তালিকাই নিয়ে গিয়েছিল। তবে ওই দিন সেই তালিকা তারা প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়নি। প্রয়োজন হলে পরে দেবে। এবার শুধু বিষয়টি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেছে।

শুধু উপদেষ্টা নয়, জামায়াত সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিল প্রায় ৪০ জন আমলারও, যাঁরা তাদের দৃষ্টিতে কোনো না কোনো দলের হয়ে, বিশেষত বিএনপির হয়ে কাজ করছেন। আর বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ ব্রিফিংয়ে জামায়াতের নেতারা উল্লেখ করেছেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকই বিএনপির। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জামায়াত বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। এ জন্য সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে রদবদল আনতে হবে। বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের আরও অভিযোগ, বিএনপি রাজনৈতিক চাপে পড়ে গণভোটে রাজি হলেও এখন জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

ওই দিনই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধিদলও পৃথকভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, তাঁরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন ও পুলিশে নিজেদের মতো ভাগ-বাঁটোয়ারা শুরু করেছে। ডিসি-এসপিদের তালিকা করে সরকারকে দিচ্ছে এবং সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্য থেকেও এ ব্যাপারে তারা সহযোগিতা পাচ্ছে।

এনসিপির আরও বড় অভিযোগ নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে। প্রধান উপদেষ্টাকে তারা বলেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। কোনো কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। শাপলা প্রতীক পাওয়া প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলামের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, যে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন এবং প্রতীকের বিষয়ে এনসিপির সঙ্গে ন্যায়বিচার করে না, তার অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ন্যায়বিচার এবং নিরপেক্ষতা বা সঠিক ফলাফল পাওয়ার ব্যাপারে ভরসা করা যায় না। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি হলো, নির্বাচন কমিশনের কারণে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়, সেই দায়ও সরকারের ওপরই পড়বে।

উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রশ্ন আছে বিএনপিরও। জামায়াত ও এনসিপির এক দিন আগে, গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। সেই বৈঠকে তারাও কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছে। কারও নাম উল্লেখ না করেই বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছে দলটি। এর আগেও বিএনপির পক্ষ থেকে এমন আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল বলেও খবর বেরিয়েছে। তবে তাঁরা তখনই তাতে রাজি হননি। উপদেষ্টাদের ছাড়াও প্রশাসন নিয়েও অন্য দুই দলের মতোই উদ্বেগ আছে বিএনপিরও। মঙ্গলবারের বৈঠকে তারা এই বলে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে প্রশাসন, পুলিশ এবং বিচার বিভাগের প্রায় ৫০ ভাগ ফ্যাসিস্টের দোসর।

তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠকেই প্রধান উপদেষ্টা সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি; সামনে আরও অনেক উদ্যোগ আপনারা দেখতে পাবেন।’

তা প্রধান উপদেষ্টা যতই নিশ্চয়তা দিন না কেন, যেখানে সব দলের কাছেই উপদেষ্টাদের (সবার নয়) এবং প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা স্পষ্ট, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে উল্লেখ করে যখন প্রকাশ্যে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নিশ্চিন্তে নিশ্চিত থাকতে পারে! তা ছাড়া, মাঝেমধ্যেই তো দলগুলোর পরস্পরের প্রতি বৈরী বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যেমন কিছুদিন আগে এনসিপির আহ্বায়ক তাঁর ফেসবুক পোস্টে বললেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) নিয়ে জামায়াতের আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। কিংবা জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের আগে-পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি। তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি। কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বললেন আরও একটু শক্ত কথা—‘জন্মের পরই বাপের সাথে পাল্লা দিতে যেও না।’ সরকার ভাবতে পারে যে এগুলো তো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার বাহাস। এটা নিয়ে তাদের অতটা না ভাবলেও চলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাহাসগুলো তো রাজনৈতিক বাস্তবতা। এগুলো তো রাজনৈতিক অঙ্গনকে অস্থিতিশীল করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশেও প্রভাব ফেলতে পারে।

তারপর উল্লেখ করা যায় মঙ্গলবারের বৈঠকে বিএনপি যে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, সে সম্পর্কে এনসিপির প্রতিক্রিয়ার কথা। এনসিপি বলল হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শটি দুরভিসন্ধিমূলক। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি তাদের ম্যান্ডেট। অথচ বিএনপির বক্তব্যটি ছিল—নিরপেক্ষতার নিরিখে এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিতে হবে।

এইসব রাজনৈতিক টানাপোড়েন ছাড়াও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। যেমন জামায়াতের কাছে অমীমাংসিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, ওই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরে গণভোট। এই দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এনসিপির কাছে অমীমাংসিত বিষয় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং তাদের দাবিকৃত নির্বাচনী প্রতীক শাপলা বরাদ্দ দেওয়া। বিএনপির কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচন। এ ছাড়া এই তিনটি দলের কাছেই (হয়তো আরও অনেক দলের কাছে) সাধারণ ইস্যু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে বেশ কিছু বিষয় প্রতিটি দল চায় না। এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেই ভূমিকা নিরপেক্ষ হিসেবেই প্রতীয়মান হওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জই বটে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাঠকের লেখা /স্বার্থের সমাজে বন্ধুত্ব

হেনা শিকদার
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১১
স্বার্থের সমাজে বন্ধুত্ব

সমাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে, পৃথিবী প্রবেশ করেছে এক নতুন যুগে। এই গতিময় সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা হয়তো অনেক কিছু পাচ্ছি, কিন্তু হারিয়ে ফেলছি আরও বেশি কিছু। আজ আমরা এক অদ্ভুত স্বার্থপর সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রতিটি সম্পর্কের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি। এমন এক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে যে সম্পর্কটি, মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকে—বন্ধুত্ব।

একসময় বন্ধুত্ব ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক দারুণ উদাহরণ। সেখানে লেনদেনের কোনো হিসাব ছিল না, ছিল শুধু একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা এবং নির্ভরতা। শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা মনে করলে আজও অনেকের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। টিফিনের খাবার ভাগ করে খাওয়া, বন্ধুর দুঃখে নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়ানো, কিংবা সামান্য কারণে অহেতুক ঝগড়া করে আবার মুহূর্তেই সব ভুলে গিয়ে একে অপরের হাত ধরার মধ্যে যে পবিত্রতা ছিল, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায় তা যেন এক দুর্লভ বস্তু।

বর্তমান সমাজব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে সবকিছুকে ব্যক্তিগত লাভের নিরিখে বিচার করতে হয়। আমরা এখন বন্ধু বানানোর আগেও অবচেতন মনে বিচার করে নিই—এই সম্পর্কটি আমার জীবনে কতটা মূল্য যোগ করবে? তার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, কিংবা তার মাধ্যমে আমার কোনো উপকার হবে কি না—এইসব প্রশ্নই এখন বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, একধরনের ‘শর্তাধীন’ বন্ধুত্বের জন্ম হচ্ছে, যেখানে স্বার্থের লেনদেন শেষ হলেই সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়। এই ধরনের বন্ধুত্ব অনেকটা ব্যবসায়িক চুক্তির মতো, যেখানে একে অপরকে ব্যবহার করে নিজের আখের গোছানোই মূল উদ্দেশ্য।

এই স্বার্থপরতার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। প্রথমত, আধুনিক জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং প্রতিযোগিতা মানুষকে এতটাই আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে যে, সে নিজের জগৎ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তার এক মায়াবী জগতের সৃষ্টি করেছে। এখানে মানুষের বন্ধুর সংখ্যা হাজার হাজার, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভরসা করার মতো বন্ধুর সংখ্যা প্রায় শূন্য। লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব আসলে একধরনের লোকদেখানো সম্পর্ক, যার গভীরে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই। এখানে সবাই যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে—কার কত বন্ধু, কে কতটা জনপ্রিয়। এই জাঁকজমকপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের সত্যিকারের আবেগ এবং অনুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তবে এই হতাশাজনক চিত্রের মধ্যেও আশার আলো রয়েছে। স্বার্থের এই ঝোড়ো হাওয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়েও কিছু মানুষ এখনো সত্যিকারের বন্ধুত্বের পতাকা উড়িয়ে চলেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, বন্ধুত্ব মানে শুধু দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক নয়, বরং এটি একটি আত্মিক টান, যা কোনো স্বার্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় না। একজন সত্যিকারের বন্ধু আয়নার মতো, যে কেবল আমাদের ভালো দিকগুলোই তুলে ধরে না, বরং আমাদের ভুলগুলোও দেখিয়ে দেয়। সে আমাদের বিপদের দিনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় এবং আনন্দের দিনে মন খুলে হাসে।

এই স্বার্থপর সময়ে সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পাওয়া হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে যদি আমরা লাভ-ক্ষতির হিসাব থেকে মুক্ত করতে পারি, তবেই এর আসল সৌন্দর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। বন্ধুত্ব কোনো পণ্য নয় যে তাকে ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে। এটি একটি চারা গাছের মতো, যাকে যত্ন, বিশ্বাস এবং সময় দিয়ে বড় করে তুলতে হয়। যখন একজন মানুষ সব ধরনের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আরেকজন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তখনই জন্ম নেয় এক নির্মল বন্ধুত্ব।

স্বার্থের এই সমাজে বন্ধুত্বের মানে হলো এক নিঃস্বার্থ আশ্রয়। এমন এক সম্পর্ক, যেখানে আপনি কোনো মুখোশ ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, যেখানে আপনার দুর্বলতাগুলো নিয়ে কেউ উপহাস করবে না, বরং আপনাকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এই বন্ধুত্ব আপনাকে শেখাবে যে পৃথিবীতে এখনো এমন কিছু সম্পর্ক আছে, যা অর্থ বা ক্ষমতার বিনিময়ে কেনা যায় না, যা কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। তাই এই যান্ত্রিক সভ্যতায় হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের উচিত জীবনের সেই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে খুঁজে বের করা এবং পরম মমতায় সেগুলো আগলে রাখা। কারণ, দিন শেষে এই সম্পর্কগুলোই আমাদের বেঁচে থাকার আসল প্রেরণা জোগায়।

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাঠকের লেখা /বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব

রিয়াদ হোসেন
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ৪৩
বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিক্ষয় রোধসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে আসছে। এই সুন্দরবনের এক অনন্য প্রজাতির প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

সাধারণ মানুষের মতো বাঘেরও প্রধান দুটি মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য ও বাসস্থান। বিশেষ করে খাদ্যের জোগান এবং আবাসস্থল নিরাপদ করতে পারলে বাঘ বাঁচিয়ে রাখা কিংবা তাদের প্রজনন বৃদ্ধিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এ জন্য সুন্দরবনকে বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণের জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বাঘসহ অন্য প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন বাঘের অস্তিত্ব আছে। বাঘ বাঁচাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সেসব দেশের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় অন্য প্রজাতির প্রাণী থেকে বাঘ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সুন্দরবনে চোরা শিকারি বাঘের প্রধান হুমকি। কিছু অতিলোভী চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের জন্য দিন দিন বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সবশেষ তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি। কয়েক বছর আগে বড় বড় বনদস্যু দলের আত্মসমর্পণের ফলে বাঘনিধন কিছুটা কমে এসেছে। দুই বছর আগেও খাদ্যসংকটে বাঘ লোকালয়ে এলে হত্যা করা হতো। এখন সেটিও অনেকটা বন্ধ হয়েছে। বন সংরক্ষণে বন মন্ত্রণালয়ের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে সুন্দরবনসংলগ্ন স্থানীয় মানুষ আগের থেকে অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে। এ জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর জীবিকায় সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়ে আরও বেশি কাজ করতে হবে।

সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে বাঘ সংরক্ষণের বিকল্প নেই। আর এ জন্য বন বিভাগ কিংবা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে সুন্দরবন বা বাঘ কোনোটাই রক্ষা করা সম্ভব হবে না; যদি আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন না হই। পাশাপাশি বাঘনিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য ২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যে আইনের ৩৬ ধারায় বাঘশিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ সাত বছর সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ড ও ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ আইনটিও অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে সুন্দরবন বাঁচানোর পাশাপাশি বাঘ, হরিণসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত