বিভুরঞ্জন সরকার
বাংলাদেশকে বলা হয় আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ। রাজনীতি নিয়ে মানুষের আগ্রহ-কৌতূহল প্রবল। তবে রাজনীতিতে এখন দুষ্ট ও নষ্ট মানুষের আধিপত্য চলছে। ফলে রাজনীতিতে খারাপের সঙ্গে ভালোর প্রতিযোগিতা না হয়ে খারাপের সঙ্গে খারাপের প্রতিযোগিতা চলছে। একজন অধম হলে অন্য জন উত্তম হওয়ার চেষ্টা না করে অধমের খাতায়ই নাম লিখছে। আস্থা-বিশ্বাসের পরিবর্তে হিংসা-বিদ্বেষ এখন রাজনীতির উপজীব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে প্রতিহিংসার পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতি এখন আদর্শ থেকে সরে এসে অনেকটাই বাণিজ্যিক আকার ধারণ করেছে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। রাজনীতি এখন পরিণত হয়েছে এক লাভজনক ব্যবসায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো প্রধান দলগুলো ক্ষমতায় থেকে বা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যেসব ভুল করেছে বা করছে, তার পেছনে কাঠামোগত সমস্যাগুলো গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। দখল, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি—এ সবই রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তথা শেখ হাসিনার বিদায়ের পর রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে যে আশাবাদ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, ৬ মাস পরে এসে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। শাসক বদল হলেও শাসনব্যবস্থা বদলের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে যাঁরা ক্ষমতায় বসেছেন অথবা যাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তাঁরা কথায় বড় হওয়ার প্রতিযোগিতায় থাকলেও কাজে বড় হওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারছে বলে মনে হয় না। নানা রকম সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে। খাওয়া ও পাওয়ার জন্য নতুন করে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
নানা বিষয়ে সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। কয়েকটি কমিশন গঠন করে বিভিন্ন সুপারিশ করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, দেখার বিষয় সেটাই। দেশের রাজনীতির একজন দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ আকর্ষণের গরজ বোধ করছি।
প্রথমত, রাজনীতিতে অর্থায়ন ও রাজনৈতিক ব্যয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে যে অভিযোগ, তা বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের অর্থায়নের পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে। এবং এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যাতে কালোটাকা ব্যবহার করতে না পারে, তা আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা মনে রেখেই বর্তমান ধারার ছাত্ররাজনীতি সংস্কার অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদর্শিক ও নেতৃত্বগুণ তৈরির চর্চা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ছাত্ররাজনীতি হয়েছে রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্তদের ‘চাকরি’ নিশ্চিত করার মাধ্যম। তাই এখন ছাত্ররাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হবে।
তৃতীয়ত, ভালো নেতৃত্ব তুলে আনার জন্য রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবর্তন যদি দলের অভ্যন্তর থেকেই শুরু না হয়, তবে মাঠের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। সব রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটি ভোট ও জনমত বিবেচনা করার মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব।
চতুর্থত, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অসৎ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এখানে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব বরদাস্ত করা উচিত নয়। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের মধ্যে আত্মসমালোচনা করতে হবে। দখলদার ও চাঁদাবাজ নেতাদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যোগ্য ও নির্লোভ ব্যক্তিদের সামনে আনতে হবে।
তা ছাড়া, রাজনীতিকে পেশা বা ‘খাওয়া-পাওয়ার’ জায়গা থেকে সেবার জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বড় সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে এই পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকে এও বোঝাতে হবে যে, তারা যদি দুর্নীতিবাজ নেতাদের সমর্থন করে, তাহলে সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব।
রাজনীতি থেকে লালসা দূর করার জন্য সমষ্টিগত উদ্যোগ প্রয়োজন। রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং রাজনীতির প্রতিযোগিতাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক না রেখে গণকল্যাণমুখী করতে হবে। এটি এক দিনের কাজ নয়; এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া, কিন্তু শুরু করতে হবে এখনই। বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনের জন্য চাই জাতীয় ঐক্য ও গভীরতর জনসচেতনতা, যা একমাত্র সর্বস্তরের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব।
আমার একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ছে। সত্তর দশকের মধ্যভাগে শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে একজন ছাত্রনেতা বললেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক ঢেলে সাজানোর সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রশ্ন করলেন, ঢালবে কে এবং সাজাবে কে?
প্রবীণ শিক্ষাবিদের উক্তিটি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং বাস্তবিক। ‘ঢালবে কে আর সাজাবে কে?’ এই প্রশ্নটি আসলে বাংলাদেশের দীর্ঘকাল ধরে চলা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার গভীরে আঘাত করে। সমস্যার মূলে আছে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব, নৈতিক সাহস এবং একটি সৎ ও কর্মক্ষম ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার অক্ষমতা।
সত্যি বলতে, তেমন সৎ ও নির্মোহ মানুষ হয়তো সংখ্যায় খুব বেশি নেই, কিন্তু একেবারেই নেই, তা নয়। আমাদের চারপাশে এখনো কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা তাঁদের সীমিত সাধ্য অনুযায়ী সমাজে ভালো কিছু করার চেষ্টা করছেন। তবে সমস্যা হলো, এঁদের অনেকেই মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে বা সেখান থেকে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন না। কারণ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলো এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যা ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে সত্যিকারের সৎ ব্যক্তি এগোতে গেলে হয় তাঁদের প্রতিহত করা হয়, নয়তো তাঁরা নিজেরাই হতাশ হয়ে সরে দাঁড়ান।
তাহলে সমাধানের উপায় কী? এ ক্ষেত্রে সবার বিবেচনার জন্য কয়েকটি প্রস্তাব:
১. আমাদের তরুণ প্রজন্মকে পরিবর্তনের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। তরুণদের মধ্যে সৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি তৈরি করতে হবে, যাতে কেবল রাজনৈতিক শিক্ষাই নয়, নৈতিকতা এবং দায়িত্বশীলতা সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া যায়।
২. দলের অভ্যন্তরে সত্যিকার গণতন্ত্র আনতে হবে, যেখানে যোগ্য ব্যক্তি সুযোগ পাবেন। বিশেষত প্রাইমারি লেভেল থেকে, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় নির্বাচন, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব ও টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে।
৩. যাঁরা নিজেদের পরিচ্ছন্ন জীবন এবং সৎ কার্যকলাপের জন্য সমাজে স্বীকৃত, তাঁদের রাজনীতিতে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর এই জনসচেতনতা চাপ তৈরি করবে এবং সৎ মানুষের এগিয়ে আসা আরও সহজ হবে।
৪. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই পেশাভিত্তিক এবং দক্ষতাকেন্দ্রিক। কিন্তু নৈতিকতা, সেবা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের চর্চা তাতে নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ছোটবেলা থেকেই মানবিক গুণাবলির চর্চা শুরু করতে হবে।
৫. একজন সৎ ব্যক্তি তখনই রাজনীতি বা প্রশাসনে থাকতে পারবেন, যদি তিনি জানেন যে তাঁর নিরাপত্তা এবং ন্যায়ের পক্ষে রাষ্ট্র আছে। দুর্নীতি, দখলদারি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়া নজরদারি এবং দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
৬. সমাজের বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব সত্যিকারের সৎ মানুষ চিহ্নিত করা এবং তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানো।
অন্যভাবে বললে, পুরো ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হলে প্রথমে আমাদের ঢালতে হবে মানুষ, যাঁদের ভেতরে সততা, সেবার মনোভাব এবং সাহস আছে। বর্তমান অবস্থা পাল্টাতে হলে এই সৎ মানুষদের খুঁজে বের করে তাঁদের সুযোগ করে দিতে হবে। একজন সৎ ও সাহসী ব্যক্তি পুরো ব্যবস্থা বদলে দিতে পারেন—শুধু যদি তাঁকে জায়গা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সমস্যা যত গভীরই হোক, এই জনপদে সাহসী ও নির্মোহ মানুষের অভাব নেই। দরকার শুধু তাঁদের খুঁজে বের করা এবং সামনে নিয়ে আসা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশকে বলা হয় আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ। রাজনীতি নিয়ে মানুষের আগ্রহ-কৌতূহল প্রবল। তবে রাজনীতিতে এখন দুষ্ট ও নষ্ট মানুষের আধিপত্য চলছে। ফলে রাজনীতিতে খারাপের সঙ্গে ভালোর প্রতিযোগিতা না হয়ে খারাপের সঙ্গে খারাপের প্রতিযোগিতা চলছে। একজন অধম হলে অন্য জন উত্তম হওয়ার চেষ্টা না করে অধমের খাতায়ই নাম লিখছে। আস্থা-বিশ্বাসের পরিবর্তে হিংসা-বিদ্বেষ এখন রাজনীতির উপজীব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে প্রতিহিংসার পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতি এখন আদর্শ থেকে সরে এসে অনেকটাই বাণিজ্যিক আকার ধারণ করেছে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। রাজনীতি এখন পরিণত হয়েছে এক লাভজনক ব্যবসায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো প্রধান দলগুলো ক্ষমতায় থেকে বা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যেসব ভুল করেছে বা করছে, তার পেছনে কাঠামোগত সমস্যাগুলো গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। দখল, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি—এ সবই রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তথা শেখ হাসিনার বিদায়ের পর রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে যে আশাবাদ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, ৬ মাস পরে এসে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। শাসক বদল হলেও শাসনব্যবস্থা বদলের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে যাঁরা ক্ষমতায় বসেছেন অথবা যাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তাঁরা কথায় বড় হওয়ার প্রতিযোগিতায় থাকলেও কাজে বড় হওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারছে বলে মনে হয় না। নানা রকম সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে। খাওয়া ও পাওয়ার জন্য নতুন করে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
নানা বিষয়ে সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। কয়েকটি কমিশন গঠন করে বিভিন্ন সুপারিশ করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, দেখার বিষয় সেটাই। দেশের রাজনীতির একজন দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ আকর্ষণের গরজ বোধ করছি।
প্রথমত, রাজনীতিতে অর্থায়ন ও রাজনৈতিক ব্যয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে যে অভিযোগ, তা বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের অর্থায়নের পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে। এবং এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যাতে কালোটাকা ব্যবহার করতে না পারে, তা আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা মনে রেখেই বর্তমান ধারার ছাত্ররাজনীতি সংস্কার অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদর্শিক ও নেতৃত্বগুণ তৈরির চর্চা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ছাত্ররাজনীতি হয়েছে রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্তদের ‘চাকরি’ নিশ্চিত করার মাধ্যম। তাই এখন ছাত্ররাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হবে।
তৃতীয়ত, ভালো নেতৃত্ব তুলে আনার জন্য রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবর্তন যদি দলের অভ্যন্তর থেকেই শুরু না হয়, তবে মাঠের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। সব রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটি ভোট ও জনমত বিবেচনা করার মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব।
চতুর্থত, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অসৎ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এখানে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব বরদাস্ত করা উচিত নয়। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের মধ্যে আত্মসমালোচনা করতে হবে। দখলদার ও চাঁদাবাজ নেতাদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যোগ্য ও নির্লোভ ব্যক্তিদের সামনে আনতে হবে।
তা ছাড়া, রাজনীতিকে পেশা বা ‘খাওয়া-পাওয়ার’ জায়গা থেকে সেবার জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বড় সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে এই পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকে এও বোঝাতে হবে যে, তারা যদি দুর্নীতিবাজ নেতাদের সমর্থন করে, তাহলে সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব।
রাজনীতি থেকে লালসা দূর করার জন্য সমষ্টিগত উদ্যোগ প্রয়োজন। রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং রাজনীতির প্রতিযোগিতাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক না রেখে গণকল্যাণমুখী করতে হবে। এটি এক দিনের কাজ নয়; এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া, কিন্তু শুরু করতে হবে এখনই। বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনের জন্য চাই জাতীয় ঐক্য ও গভীরতর জনসচেতনতা, যা একমাত্র সর্বস্তরের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব।
আমার একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ছে। সত্তর দশকের মধ্যভাগে শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে একজন ছাত্রনেতা বললেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক ঢেলে সাজানোর সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রশ্ন করলেন, ঢালবে কে এবং সাজাবে কে?
প্রবীণ শিক্ষাবিদের উক্তিটি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং বাস্তবিক। ‘ঢালবে কে আর সাজাবে কে?’ এই প্রশ্নটি আসলে বাংলাদেশের দীর্ঘকাল ধরে চলা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার গভীরে আঘাত করে। সমস্যার মূলে আছে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব, নৈতিক সাহস এবং একটি সৎ ও কর্মক্ষম ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার অক্ষমতা।
সত্যি বলতে, তেমন সৎ ও নির্মোহ মানুষ হয়তো সংখ্যায় খুব বেশি নেই, কিন্তু একেবারেই নেই, তা নয়। আমাদের চারপাশে এখনো কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা তাঁদের সীমিত সাধ্য অনুযায়ী সমাজে ভালো কিছু করার চেষ্টা করছেন। তবে সমস্যা হলো, এঁদের অনেকেই মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে বা সেখান থেকে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন না। কারণ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলো এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যা ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে সত্যিকারের সৎ ব্যক্তি এগোতে গেলে হয় তাঁদের প্রতিহত করা হয়, নয়তো তাঁরা নিজেরাই হতাশ হয়ে সরে দাঁড়ান।
তাহলে সমাধানের উপায় কী? এ ক্ষেত্রে সবার বিবেচনার জন্য কয়েকটি প্রস্তাব:
১. আমাদের তরুণ প্রজন্মকে পরিবর্তনের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। তরুণদের মধ্যে সৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি তৈরি করতে হবে, যাতে কেবল রাজনৈতিক শিক্ষাই নয়, নৈতিকতা এবং দায়িত্বশীলতা সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া যায়।
২. দলের অভ্যন্তরে সত্যিকার গণতন্ত্র আনতে হবে, যেখানে যোগ্য ব্যক্তি সুযোগ পাবেন। বিশেষত প্রাইমারি লেভেল থেকে, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় নির্বাচন, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব ও টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে।
৩. যাঁরা নিজেদের পরিচ্ছন্ন জীবন এবং সৎ কার্যকলাপের জন্য সমাজে স্বীকৃত, তাঁদের রাজনীতিতে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর এই জনসচেতনতা চাপ তৈরি করবে এবং সৎ মানুষের এগিয়ে আসা আরও সহজ হবে।
৪. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই পেশাভিত্তিক এবং দক্ষতাকেন্দ্রিক। কিন্তু নৈতিকতা, সেবা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের চর্চা তাতে নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ছোটবেলা থেকেই মানবিক গুণাবলির চর্চা শুরু করতে হবে।
৫. একজন সৎ ব্যক্তি তখনই রাজনীতি বা প্রশাসনে থাকতে পারবেন, যদি তিনি জানেন যে তাঁর নিরাপত্তা এবং ন্যায়ের পক্ষে রাষ্ট্র আছে। দুর্নীতি, দখলদারি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়া নজরদারি এবং দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
৬. সমাজের বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব সত্যিকারের সৎ মানুষ চিহ্নিত করা এবং তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানো।
অন্যভাবে বললে, পুরো ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হলে প্রথমে আমাদের ঢালতে হবে মানুষ, যাঁদের ভেতরে সততা, সেবার মনোভাব এবং সাহস আছে। বর্তমান অবস্থা পাল্টাতে হলে এই সৎ মানুষদের খুঁজে বের করে তাঁদের সুযোগ করে দিতে হবে। একজন সৎ ও সাহসী ব্যক্তি পুরো ব্যবস্থা বদলে দিতে পারেন—শুধু যদি তাঁকে জায়গা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সমস্যা যত গভীরই হোক, এই জনপদে সাহসী ও নির্মোহ মানুষের অভাব নেই। দরকার শুধু তাঁদের খুঁজে বের করা এবং সামনে নিয়ে আসা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২ ঘণ্টা আগেদেশে প্রতিবছর বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বাস্তবায়নের সময় মাঝে মাঝে সংবাদ চোখে পড়ে যে প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কাটা পড়ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, খাল ও জলাভূমি ভরাট হচ্ছে, নির্মাণস্থলে নির্মাণকাজের ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো প্রকল্প গ্রহণের ফলে পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব...
৩ ঘণ্টা আগেপাহাড় রক্ষা করা যখন খুবই জরুরি, তখন সে পাহাড় কেটে গোটা অঞ্চলের জন্য বিপদ ডেকে আনছে একদল দুর্বৃত্ত। খাগড়াছড়ির পানছড়ি এলাকায় অবাধে পাহাড় কাটা হচ্ছে, অথচ সরকারি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছেন।
৩ ঘণ্টা আগে১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন, তাঁকে করা হয়েছিল দলের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে শামসুল হক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১ দিন আগে