Ajker Patrika

তত্ত্বাবধায়ক ভালো, কিন্তু এখনই নয়!

মাসুদ কামাল
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি ফিরে এসেছে। কিন্তু আসলেই কি ফিরে এসেছে? ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। ১৪ বছর পর বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ আগের সে রায়কে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যায়িত করে বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে ফিরে এসেছে দেশের সাধারণ ভোটারদের প্রিয় সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তাহলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেটা হওয়ার কথা, সেটা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হচ্ছে? না, তা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? আদালত বলেছেন, এবার হবে না, তাই হচ্ছে না। আদালত কেন বললেন? এ প্রশ্নের আর জবাব নেই।

আদালত যেহেতু নিজে থেকে কারণটা বলেননি, তাই আইনজীবীদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। রায়ে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে পুনর্বহাল হলেও তার প্রয়োগ কার্যকর হবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮ খ(১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮ গ(২)-এর বিধান অনুযায়ী। বিষয়টি বুঝতে আগে এই দুটি অনুচ্ছেদ সম্পর্কে জানতে হবে। ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত ৫৮ খ(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর বা মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে যে তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই তারিখ থেকে সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টা নিয়োগ ইত্যাদি সংক্রান্ত ৫৮ গ(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন।

এখনই কার্যকর করতে গেলে এখানে বলা বিধান অনুযায়ী কিছু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু এবার সংসদ তো ভেঙে দেওয়া হয়েছে আরও অনেক আগে, এক বছর তিন মাস সময় আগে। এভাবে দেখতে গেলে বিষয়টি আসলেই জটিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধানকে হুবহু মানতে গেলে অনেক কিছুই তো জটিল। সে জটিলতাগুলো এড়ানো যাচ্ছে কীভাবে? তখন বলা হচ্ছে, সময়ের প্রয়োজনে সেগুলো করা হচ্ছে।

‘সময়ের প্রয়োজন’—এটা কেবল একটা কথার কথা নয়। আসলেই গত বছরের আগস্ট থেকে অনেক কিছুই এ দেশে আর সংবিধান মেনে হয়নি। সংবিধান মেনে গণ-আন্দোলন হয়নি; কিংবা শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাননি। সংবিধান মেনে সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়নি। শুরুতে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে চলে গেছেন, তাই রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। পরে দেখা গেল, অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই ‘পদত্যাগপত্র’ আর পাওয়া যাচ্ছে না। সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতি একবার জানালেন পর্যন্ত, সে রকম কোনো পদত্যাগপত্র তিনি পাননি। আবার এই যে অন্তর্বর্তী সরকার, সংবিধানে তো ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ বিষয়টিই নেই। তারপরও তারা আছে তো? দেশও চালাচ্ছে। সবই হচ্ছে ‘সময়ের প্রয়োজনে’।

সময়ের দোহাই দিয়ে যদি এত কিছু হতে পারে, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে এত আইন আর সংবিধানের দোহাই কেন? তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গিয়েছিল সেই ২০১১ সালে। তার পর থেকে, ১৪টি বছর ধরে বিএনপি-জামায়াতসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের প্রধান দাবি ছিল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর। এই দাবি আদায় করতে গিয়ে তাদের অগণিত নেতা-কর্মী-সমর্থক জীবন দিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। এই যে এত ত্যাগ, এত ভোগান্তি, সেটা কি এখন মূল্যহীন হয়ে গেল? সামনে নির্বাচন; কিন্তু সেই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া দরকার, এটাই এখন সময়ের দাবি, এ কথাটা কোনো রাজনৈতিক দল বলছে না কেন?

তাহলে কি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রকারান্তরে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারই? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল নীতিটা কী? সেটা হচ্ছে, নির্বাচনের সময় দেশে এমন একটা সরকার থাকবে, যে সরকারের কোনো উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন না। নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁদের কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। সরকার চালাতে গিয়ে তাঁরা কোনো নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ নেবেন না, কেবল দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করবেন। কিন্তু এই সরকারের দুজন উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, এটা এখন স্পষ্ট। একজন উপদেষ্টা এরই মধ্যে তো জানিয়েই দিয়েছেন, তিনি ধানমন্ডি এলাকা থেকে নির্বাচন করছেন। তিনি এনসিপি, বিএনপি নাকি জামায়াত—কোন দলের প্রার্থী হবেন, কাদের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করবেন?

আমাদের মতো দেশে ক্ষমতার শীর্ষে থাকলে সব সময় একটি বলয় চারপাশ ঘিরে থাকে। তাদের কারণে শীর্ষে থাকা ব্যক্তিটি বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারেন না। আমার কেন যেন মনে হয়, প্রধান উপদেষ্টাও এখন সে রকম বলয় দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।

এত কিছুর পরও বিএনপি বা জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলগুলো কেন এবারের নির্বাচন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটা তুলছে না? রায়ের পর বিএনপি বা জামায়াতপন্থী সব আইনজীবীকেই দেখা গেছে, পাঁচ বছর পর থেকে চালুর বিষয়টি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন। এটা আমার কাছে কিছুটা বিস্ময়কর ঠেকেছে। মনে হয়েছে, তাঁরা এতটা স্বার্থপর হতে পারেন! তাঁদের কাছে ক্ষমতাটাই আসল, জনগণ কী চায় বা না চায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁরা মনে করছেন, বর্তমান সরকারই তাঁদের ক্ষমতায় পৌঁছে দিতে পারবে। তাই তাঁরা সরকারকে চটাতে চান না। কিন্তু জনগণের মতামত বা চাহিদার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেন না।

মানুষ কিন্তু হতাশ। অন্তত আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি। আমার কেন যেন মনে হয়, এবারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে, ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এমন সরকারের অধীনে ভোট দেওয়ার সুযোগ আর না-ও পেতে পারি। সামনে কোন সরকার আসবে, তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তারাও আওয়ামী লীগ সরকারের মতো এ ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেবে কি না, কে জানে। দীর্ঘ ১৪ বছর যে তত্ত্বাবধায়কের জন্য তারা এত ব্যাকুল ছিল, সেটা পাওয়ার পরও পাঁচ বছর পর থেকে বাস্তবায়নের বিষয়টি তারা এত সহজে কীভাবে মেনে নেয়, সেটিও আমার বুঝে আসে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ