Ajker Patrika

দুবাই দুর্ঘটনা: তেজস রপ্তানির স্বপ্ন ফিকে ভারতের, জে–১৭ বিক্রির চুক্তি বাগাল পাকিস্তান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ২৭
দুবাই এয়ার শোতে তেজস বিধ্বস্ত হওয়ায় ভারতের রপ্তানির স্বপ্ন ফিকে হলেও একই মঞ্চে জে–১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি বিক্রির চুক্তি করেছে পাকিস্তান। ছবি: সংগৃহীত
দুবাই এয়ার শোতে তেজস বিধ্বস্ত হওয়ায় ভারতের রপ্তানির স্বপ্ন ফিকে হলেও একই মঞ্চে জে–১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি বিক্রির চুক্তি করেছে পাকিস্তান। ছবি: সংগৃহীত

দুবাই এয়ার শোতে ভারতের তেজস যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে অস্ত্রক্রেতাদের সামনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতীকের আস্থায় নতুন আঘাত হেনেছে। দীর্ঘ চার দশকের লড়াই পেরিয়ে ভারত এই যুদ্ধবিমান তৈরিতে সফল হয়। কিন্তু দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই যুদ্ধবিমানের বেশির ভাগেরই ক্রেতা ভারতীয় সামরিক বাহিনী।

ওই দুর্ঘটনার কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এটি এমন এক সময়ে এবং এমন এক স্থানে ঘটেছে যেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানও তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনে হাজির হয়েছিল। মাত্র ছয় মাস আগেই দুই প্রতিবেশী মুখোমুখি হয়েছিল বহু দশকের সবচেয়ে বড় আকাশযুদ্ধে।

জনসমক্ষে ভারতের প্রযুক্তিগত গর্বের এমন পতন নিঃসন্দেহে দেশটির রপ্তানি পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলবে—বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দুর্ঘটনায় নিহত উইং কমান্ডার নমনশ সিয়ালের প্রতি দেশ সম্মান জানালেও এ ঘটনা তেজসের বিশ্ব-পরিচিতির প্রচেষ্টাকে নতুন প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

দুবাইয়ের এই প্রদর্শনীই ছিল ভারতের স্বপ্নের অগ্রগতির মঞ্চ। কিন্তু সেখানেই হোঁচট খেল ভারত। মার্কিন মিচেল ইনস্টিটিউট ফর অ্যারোস্পেস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ডগলাস এ বারকি বলেন, ‘দৃশ্যটা অত্যন্ত কঠোর।’ ইতিহাস বলছে, বড় বড় এয়ার শোতে যেখানে দেশ এবং শিল্পখাত নিজেদের অর্জন দেখাতে চায়, সেখানে এমন দুর্ঘটনা উল্টো বার্তাই দেয়। তাঁর ভাষায়, ‘একটা দুর্ঘটনা মানে একেবারে প্রকাশ্য ব্যর্থতা।’ তবে নেতিবাচক প্রচারের ধাক্কা সাময়িক হবে এবং তেজস আবারও গতি ফিরে পাবে—বলে তিনি মনে করেন।

প্যারিস ও ব্রিটেনের ফার্নবরোর পর দুবাই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এয়ার শো। এমন দুর্ঘটনা খুব বিরল। ১৯৯৯ সালে প্যারিস এয়ার শোতে এক রুশ সু-৩০ যুদ্ধবিমান নিচে নামার সময় বিধ্বস্ত হয়, আর তার এক দশক আগে সোভিয়েত মিগ-২৯ একই স্থানে ভেঙে পড়ে। দুই ক্ষেত্রেই পাইলটরা বেঁচে যান। তারপরও ভারত পরবর্তী সময়ে এই দুই ধরনের বিমানই কিনেছিল। বারকির মতে, যুদ্ধবিমান কেনাবেচা ‘যে রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে, তা সাধারণত এমন এক-একটা ঘটনার প্রভাব ছাপিয়ে যায়।’

ভারত ১৯৮০–এর দশকে তেজস প্রকল্প শুরু করে। উদ্দেশ্য—পুরোনো সোভিয়েত মিগ-২১ প্রতিস্থাপন। মিগ-২১–এর শেষ বিমানটি অবসর নিয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (এইচএএল) যথাসময়ে ডেলিভারি ব্যর্থ হওয়ায় এই বিমানগুলোর অবসর বারবার বিলম্ব হয়েছে। মিগ–২১ বহরকে আরও আগেই অবসরে পাঠানোর কথা ছিল ভারতের।

রাষ্ট্রায়ত্ত এইচএএল দেশে উন্নত এমকে-১এ সংস্করণের ১৮০টি যুদ্ধবিমান তৈরির অর্ডার পেয়েছে। কিন্তু জিই (জেনারেল ইলেকট্রিক) অ্যারোস্পেসের ইঞ্জিন সরবরাহ শৃঙ্খলে জটিলতার কারণে এখনো ডেলিভারি শুরু করতে পারেনি এইচএএল। সম্প্রতি অবসর নেওয়া এইচএএলের এক সাবেক নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুবাইয়ের দুর্ঘটনা ‘এই মুহূর্তে রপ্তানির সম্ভাবনাকে শূন্যে নামিয়ে এনেছে।’

ভারতের লক্ষ্য ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বাজার। ২০২৩ সালে মালয়েশিয়ায় অফিসও খুলেছিল এইচএএল। সাবেক ওই নির্বাহীর মন্তব্য, আগামী কয়েক বছর পুরো মনোযোগ যাবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়ানোর কাজে।

এদিকে, ভারতীয় বিমান বাহিনী উদ্বিগ্ন। তাদের স্কোয়াড্রন সংখ্যা অনুমোদিত ৪২ থেকে নেমে এসেছে ২৯–এ। শিগগিরই অবসর নেবে প্রাথমিক সংস্করণের মিগ-২৯, অ্যাংলো–ফরাসি জাগুয়ার ও ফরাসি মিরেজ–২০০০। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এগুলোর জায়গা নেওয়ার কথা ছিল তেজসের। কিন্তু উৎপাদন সমস্যা চলছে।’

ফলে ভারত তাড়াহুড়োর মধ্যে বিকল্প খুঁজছে। দেশটির কর্মকর্তাদের মতে, অবিলম্বে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ফরাসি রাফাল কেনার বিষয়টি আবার বিবেচনায় আছে। পাশাপাশি, দেশে ইতিমধ্যে থাকা প্রায় ৪০টি তেজসের সংখ্যাও বাড়ানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ এবং রাশিয়ার সু-৫৭ যুদ্ধবিমানের প্রস্তাবও ভারত বিবেচনা করছে। দুবাইয়ে একই মঞ্চে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির এই দুই উন্নত মডেলকে দেখা খুবই বিরল ঘটনা।

ভারত বহু বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি নিজস্ব সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে তেজস যুদ্ধবিমানকে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই ওই বিমানে উড়াল দিয়ে সেই বার্তা আরও জোরালো করেছিলেন।

লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সহযোগী গবেষক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ জানানা, অন্য অনেক যুদ্ধবিমান কর্মসূচির মতো তেজসও প্রযুক্তি আর কূটনীতির সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নজর কাড়ার লড়াই চালিয়েছে। ১৯৯৮ সালের পরমাণু পরীক্ষার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, সঙ্গে স্থানীয়ভাবে ইঞ্জিন তৈরিতে জটিলতা—এসব কারণে শুরুতে উন্নয়ন কাজ আটকে ছিল।

ল্যাডউইগের মতে, তেজসের দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্ব বিদেশে বিক্রির চেয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিমান কর্মসূচির জন্য যে শিল্প-প্রযুক্তিগত ভিত তৈরি করছে, সেখানেই।

ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই শক্ত উপস্থিতি নিয়ে হাজির হয়েছিল ওই প্রদর্শনীতে। প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সামনে তেজস আকাশে কয়েক দফা কসরত দেখিয়েছে। পাকিস্তান জানায়, তাদের জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-থ্রি যুদ্ধবিমান রপ্তানির জন্য একটি ‘বন্ধু দেশের’ সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে। এই বিমানটি তারা চীনের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেছে।

শো-এর র্যাম্পে জেএফ-১৭–এর পাশে সাজানো ছিল বিভিন্ন অস্ত্র, যার মধ্যে ছিল পিএল-১৫ ই। চীনা এই ক্ষেপণাস্ত্র পরিবারের রপ্তানি সংস্করণটি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, এটি নাকি গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে ভারতের ব্যবহৃত একটি ফরাসি রাফালকে ভূপাতিত করেছিল।

প্রদর্শনীর আরেক পাশে পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স (পিএসি) জেএফ-১৭–কে ‘যুদ্ধে পরীক্ষিত’ বলে প্রচারপত্র বিতরণ করছিল। এই মডেলই ওই চার দিনের সংঘর্ষে পাকিস্তানের ব্যবহৃত দুই ধরনের বিমানের একটি। ভারত তেজসকে নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, গত মে মাসের চার দিনের সংঘাতে তেজসকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে কারণ জানানো হয়নি।

এ বছর ২৬ জানুয়ারি দিল্লির প্রজাতন্ত্র দিবসের আকাশ প্রদর্শনীতেও তেজস অংশ নেয়নি। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, একক ইঞ্জিনের বিমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ভারতের তেজস মূলত হালকা, এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট মাল্টিরোল ফাইটার জেট বা লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট। ডেল্টা-উইং নকশার কারণে উচ্চ গতিতেও এটি স্থিতিশীল থাকে। বিমানটিতে আছে জেনারেল ইলেকট্রিকের জিই–এফ ৪০৪–জিই–আইএন ২০ টার্বোফ্যান ইঞ্জিন, যেটি ৮৫ থেকে ৯০ কিলোনিউটন পর্যন্ত থ্রাস্ট দিতে পারে। ভারতের নিজস্ব কাবেরি ইঞ্জিন ব্যর্থ হওয়ায় এখনও বিদেশি ইঞ্জিন ব্যবহারই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

তেজস সর্বোচ্চ মাক ১.৬ বা শব্দের গতির চেয়েও ১.৬ গুণ বেশি গতিতে উড়তে পারে এবং প্রায় ৫২ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে পারে। মিশনের ধরন অনুযায়ী এর কমব্যাট রেঞ্জ সাধারণত ৫০০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার। বিমানের আটটি হার্ডপয়েন্টে সাড়ে তিন থেকে চার টন পর্যন্ত অস্ত্র বহন করা যায়, যার মধ্যে আছে ডার্বি, আস্ত্রা ও পাইথন-৫ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল, লেজার-গাইডেড বোমা, অ্যান্টি-শিপ মিসাইল এবং ২৩ মিমি কামান।

এভিয়নিক্সের দিক থেকেও তেজস বেশ আধুনিক; এতে আছে ফ্লাই-বাই-ওয়্যার সিস্টেম, মাল্টি-মোড রাডার, উন্নত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট, স্যাটেলাইটভিত্তিক নেভিগেশন, গ্লাস ককপিট আর হোলোগ্রাফিক হুড। কার্বন-ফাইবার কম্পোজিট ব্যবহারের কারণে রাডারে বিমানের প্রতিফলন তুলনামূলক কম, যদিও এটাকে পুরোপুরি স্টেলথ বলা যায় না। তেজসের কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট আছে, যেমন মার্ক–১, উন্নত এভিয়নিক্স-সমৃদ্ধ মার্ক–১ এ, আর বড় পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে মার্ক–২।

বিপরীতে জেএফ–১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি হলো পাকিস্তান ও চীনের যৌথভাবে তৈরি হালকা বহুমুখী যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ। বিমানটিতে আছে চীনের ডব্লিউএস–১৩ বা উন্নততর কেএলজে–৭এ এইএসএ রাডার, যা লক্ষ্য শনাক্তে আগের মডেলের তুলনায় অনেক দ্রুত ও নির্ভুল। ব্লক থ্রি সর্বোচ্চ ম্যাক ১.৬ গতিতে উড়তে পারে এবং প্রায় ৫০ হাজার ফুট পর্যন্ত ওঠে। এতে ফ্লাই-বাই-ওয়্যার সিস্টেম, হেলমেট-মাউন্টেড ডিসপ্লে, গ্লাস ককপিট আর উন্নত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট রয়েছে।

এটি প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজির মতো অস্ত্র ধারণ করতে পারে। এর প্রধান আকর্ষণ পিএল-১৫ লং-রেঞ্জ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল, যার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি বলে দাবি করা হয়। সঙ্গে পিএল-১০ শর্ট-রেঞ্জ মিসাইল, বিভিন্ন লেজার-গাইডেড বোমা, স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র আর ২৩ মিমি কামানও বহন করতে পারে। কার্বন-কম্পোজিট উপাদান থাকার কারণে রাডার সিগনেচার আগের ব্লকের চেয়ে কম, তবে এটিকে স্টেলথের কাতারে ফেলার মতো নয়।


রয়টার্স অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ