Ajker Patrika

একটি মার্কিন ভাড়াটে বাহিনী যেভাবে গাজায় যুদ্ধাপরাধে জড়িয়েছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ০৪
নিজেদের নতুন যুগের ক্রুসেডার বলে বর্ণনা করেন সাবেক মার্কিন সেনাদের এই সংস্থার সদস্যরা।  ছবি: সংগৃহীত
নিজেদের নতুন যুগের ক্রুসেডার বলে বর্ণনা করেন সাবেক মার্কিন সেনাদের এই সংস্থার সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি বিতর্কিত মডেলের ব্যবহার এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সামরিক কর্মীদের একটি সংস্থার জড়িত থাকার ঘটনা বিশ্বজুড়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইউজি সলিউশনস’ নামের একটি সংস্থা, যারা নিজেদের একটি ‘মহান উদ্দেশ্যে পরিচালিত মানবিক লজিস্টিকস ও হুমকি মূল্যায়ন সংস্থা’ হিসেবে পরিচয় দেয়, তারা বর্তমানে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির হাতে আসা ড্রোন ফুটেজে দেখা গেছে, উর্দি থেকে সামরিক প্রতীক সরিয়ে ফেলা হলেও রাইফেল হাতে থাকা সাবেক মার্কিন সেনারা স্থানীয় কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং সাঁজোয়া ট্রাক থেকে বিশাল আকারের খাবারের কার্টন নামাচ্ছেন।

জিএইচএফের এই সামরিকীকৃত ত্রাণ মডেলটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ১৫০টির বেশি মানবিক সাহায্য সংস্থা, যার মধ্যে অক্সফাম ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও রয়েছে, তারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, এই ফাউন্ডেশন ‘মূল মানবিক মানদণ্ড মেনে চলে না’। তাদের মতে, আগে যেখানে ৪০০টি সাধারণ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ছিল, সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করে মাত্র চারটি সামরিকীকৃত বিতরণ সাইট স্থাপন করায় লাখ লাখ মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) এই এলাকাগুলোকে ‘মানবিক সহায়তার মুখোশে গণহত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণের এই এলাকাগুলোতে বহু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ড্রপ সাইটের রিপোর্ট অনুযায়ী, মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ইউজি সলিউশনসের নিরাপত্তা চলাকালে ত্রাণ বিতরণের স্থানগুলোর কাছাকাছি ইসরায়েলি বাহিনী বা নিরাপত্তা ঠিকাদারদের হাতে ২ হাজার ৬০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৯ হাজারের বেশি আহত হয়েছে।

ইউজি সলিউশনস দাবি করে, তারা কোনো প্রাইভেট মিলিটারি কন্ট্রাক্টর (পিএমসি) নয়, বরং নিরাপত্তা ও মানবিক সাহায্য সরবরাহের মধ্যে একটি ‘সেতু তৈরি’ করছে। সংস্থাটি আসলে মার্কিন শিশু পাচারবিরোধী অলাভজনক সংস্থা ‘দ্য সেন্টিনেল ফাউন্ডেশন’ থেকে জন্ম নিয়েছে। সেন্টিনেলের কর্মীরা বেসরকারি খাত থেকে একের পর এক প্রস্তাব পেতে শুরু করলে তাঁরা আলাদা সংগঠনই খুলে ফেলেন। ফলে, সংস্থাটিতে সাবেক মার্কিন সামরিক কর্মীদের একটি বড় অংশ রয়েছে।

ইউজি সলিউশনসের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনাদের একটি কোম্পানি এটি, যা বৃহত্তর কল্যাণে কাজ চালিয়ে যেতে চায়। ইউনিফর্মে বহু বছর কাটানোর পর সংস্থাটির কর্মীদের সংঘাতপূর্ণ ও সংঘাতপরবর্তী এলাকায় কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু কঠিন সময়ে মানুষকে সাহায্য করার প্রেরণা তাদের সব সময় তাড়া করে। তাই কোম্পানিটি কেবল নিরাপত্তা ঠিকাদার হিসেবে কাজ না করে নিরাপত্তা ও মানবিক কাজের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করছে।

ইউজি সলিউশনসের সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি আসে বিবিসির একটি অনুসন্ধানে। এতে জানা যায়, গাজায় মোতায়েন করা ৩২০ জন ঠিকাদারের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ জন ‘ইনফিডেলস মোটরবাইক ক্লাব’ নামের একটি মার্কিন বাইকার গ্যাংয়ের বর্তমান বা সাবেক সদস্য, যারা প্রকাশ্যে নিজেদের ‘আধুনিক ক্রুসেডার’ সংস্থা হিসেবে প্রচার করে। তারা নিয়মিত অনলাইনে মুসলিমবিদ্বেষী কনটেন্ট পোস্ট করে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্যাংয়ের অন্তত ১০ জন সদস্য গাজায় ইউজি সলিউশনসের হয়ে কাজ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গাজা কান্ট্রি টিম লিডার জনি ‘ট্যাজ’ মালফোর্ড (যাঁর শরীরে ক্রুসেডার ‘ক্রস’ ও ‘১০৯৫’ ট্যাটু), ইনফিডেলস এমসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ল্যারি ‘জে-রড’ জ্যারেট (লজিস্টিকসের দায়িত্বে) এবং গ্যাংয়ের জাতীয় কোষাধ্যক্ষ বিল ‘সেন্ট’ সিব (একটি বিতরণ কেন্দ্রের সিকিউরিটি প্রধান)।

সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে গ্যাং সদস্যদের রাইফেল হাতে পোজ দিতে এবং ‘মেক গাজা গ্রেট অ্যাগেইন’ লেখা ব্যানার প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।

একাধিক সাবেক ঠিকাদার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কিছু মার্কিন কর্মী ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ‘জম্বি হোর্ডস’ বলে উল্লেখ করতেন। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদনে গোলাগুলি ও বিশৃঙ্খলার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে একজন গার্ড ১৫ রাউন্ড গুলি চালানোর পর অন্যজন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘হেল, ইয়া, ডুড!’ এ ছাড়া সাবেক ইউএস স্পেশাল ফোর্সের ভেটেরান অ্যান্টনি আগুইলার হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ করেছেন।

অবশ্য ইউজি সলিউশনস এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, প্রত্যেক কর্মীকে কঠোর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক ও পেশাদার মান পূরণ করেই মোতায়েন করা হয়েছে।

ইউজি সলিউশনসের গাজা মিশনের সবচেয়ে সংবেদনশীল দিকটি হলো, হামাস ও ইসরায়েল (আইডিএফ) উভয়ের সঙ্গে কাজ করা। সংস্থাটি দাবি করেছে, যখন তারা চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসআরএসের ঠিকাদার হিসেবে গাজায় পৌঁছায়, তখন যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েল সরকার এবং হামাস উভয়েই তাদের ভূমিকাকে অনুমোদন করেছিল।

তারা ‘ব্যাটলস্পেস ওনার’ আইডিএএফের সঙ্গে চলাচল এবং সংঘাত এড়ানোর ক্ষেত্রে সমন্বয় করত। আর ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরের বিষয়গুলোতে মিসরীয় নিরাপত্তা পেশাদারদের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে সমান্তরাল সমন্বয় ছিল।

ইউজি সলিউশনস আরও দাবি করেছে, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণের মডেলটি হামাসের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ উপার্জনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে হামাস জিএইচএফের স্থানীয় কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করে।

ইউজি সলিউশনস দাবি করেছে, তারা সেফ রিচ সলিউশনস (এসআরএস) ও জিএইচএফের সঙ্গে যৌথভাবে ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ তৈরি করেছে, যাতে জেনেভা কনভেনশনের কোনো লঙ্ঘন না ঘটে।

তারা ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য অ-প্রাণঘাতী সরঞ্জাম যেমন: বুলহর্ন, সাউন্ড গ্রেনেড (শব্দ সৃষ্টিকারী, কোনো প্রাণঘাতী ক্ষমতা নেই) এবং পেপার স্প্রে ব্যবহার করে।

প্রত্যেক নিরাপত্তাকর্মীর জন্য একটি রাইফেল (এম-৪) ও একটি পিস্তল বরাদ্দ আছে। সংস্থাটি দাবি করে, একটি ‘বিনা মূল্যের খাবারের বক্সের’ জন্য কাউকে গুলি করা উচিত নয় এবং তাদের কর্মীরা কেবল নিজেদের জীবন বিপন্ন মনে হলেই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন।

তবে, একাধিক সাবেক ঠিকাদার জানিয়েছেন, ভিড় যখন জিএইচএফ বিতরণ গেটের দিকে এগিয়ে আসত, তখন তাদের প্রাণঘাতী অস্ত্র চালানোর জন্য উসকানি দেওয়া হয়েছিল।

গাজা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে ‘শিল্প ও অবকাঠামো সুরক্ষার’ জন্য তারা কাজ করতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে ইউজি সলিউশনস।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, জেটিও, এনডিটিভি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দুবাই দুর্ঘটনা: তেজস রপ্তানির স্বপ্ন ফিকে ভারতের, জে–১৭ বিক্রির চুক্তি বাগাল পাকিস্তান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৭
দুবাই এয়ার শোতে তেজস বিধ্বস্ত হওয়ায় ভারতের রপ্তানির স্বপ্ন ফিকে হলেও একই মঞ্চে জে–১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি বিক্রির চুক্তি করেছে পাকিস্তান। ছবি: সংগৃহীত
দুবাই এয়ার শোতে তেজস বিধ্বস্ত হওয়ায় ভারতের রপ্তানির স্বপ্ন ফিকে হলেও একই মঞ্চে জে–১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি বিক্রির চুক্তি করেছে পাকিস্তান। ছবি: সংগৃহীত

দুবাই এয়ার শোতে ভারতের তেজস যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে অস্ত্রক্রেতাদের সামনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতীকের আস্থায় নতুন আঘাত হেনেছে। দীর্ঘ চার দশকের লড়াই পেরিয়ে ভারত এই যুদ্ধবিমান তৈরিতে সফল হয়। কিন্তু দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই যুদ্ধবিমানের বেশির ভাগেরই ক্রেতা ভারতীয় সামরিক বাহিনী।

ওই দুর্ঘটনার কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এটি এমন এক সময়ে এবং এমন এক স্থানে ঘটেছে যেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানও তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনে হাজির হয়েছিল। মাত্র ছয় মাস আগেই দুই প্রতিবেশী মুখোমুখি হয়েছিল বহু দশকের সবচেয়ে বড় আকাশযুদ্ধে।

জনসমক্ষে ভারতের প্রযুক্তিগত গর্বের এমন পতন নিঃসন্দেহে দেশটির রপ্তানি পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলবে—বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দুর্ঘটনায় নিহত উইং কমান্ডার নমনশ সিয়ালের প্রতি দেশ সম্মান জানালেও এ ঘটনা তেজসের বিশ্ব-পরিচিতির প্রচেষ্টাকে নতুন প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

দুবাইয়ের এই প্রদর্শনীই ছিল ভারতের স্বপ্নের অগ্রগতির মঞ্চ। কিন্তু সেখানেই হোঁচট খেল ভারত। মার্কিন মিচেল ইনস্টিটিউট ফর অ্যারোস্পেস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ডগলাস এ বারকি বলেন, ‘দৃশ্যটা অত্যন্ত কঠোর।’ ইতিহাস বলছে, বড় বড় এয়ার শোতে যেখানে দেশ এবং শিল্পখাত নিজেদের অর্জন দেখাতে চায়, সেখানে এমন দুর্ঘটনা উল্টো বার্তাই দেয়। তাঁর ভাষায়, ‘একটা দুর্ঘটনা মানে একেবারে প্রকাশ্য ব্যর্থতা।’ তবে নেতিবাচক প্রচারের ধাক্কা সাময়িক হবে এবং তেজস আবারও গতি ফিরে পাবে—বলে তিনি মনে করেন।

প্যারিস ও ব্রিটেনের ফার্নবরোর পর দুবাই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এয়ার শো। এমন দুর্ঘটনা খুব বিরল। ১৯৯৯ সালে প্যারিস এয়ার শোতে এক রুশ সু-৩০ যুদ্ধবিমান নিচে নামার সময় বিধ্বস্ত হয়, আর তার এক দশক আগে সোভিয়েত মিগ-২৯ একই স্থানে ভেঙে পড়ে। দুই ক্ষেত্রেই পাইলটরা বেঁচে যান। তারপরও ভারত পরবর্তী সময়ে এই দুই ধরনের বিমানই কিনেছিল। বারকির মতে, যুদ্ধবিমান কেনাবেচা ‘যে রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে, তা সাধারণত এমন এক-একটা ঘটনার প্রভাব ছাপিয়ে যায়।’

ভারত ১৯৮০–এর দশকে তেজস প্রকল্প শুরু করে। উদ্দেশ্য—পুরোনো সোভিয়েত মিগ-২১ প্রতিস্থাপন। মিগ-২১–এর শেষ বিমানটি অবসর নিয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (এইচএএল) যথাসময়ে ডেলিভারি ব্যর্থ হওয়ায় এই বিমানগুলোর অবসর বারবার বিলম্ব হয়েছে। মিগ–২১ বহরকে আরও আগেই অবসরে পাঠানোর কথা ছিল ভারতের।

রাষ্ট্রায়ত্ত এইচএএল দেশে উন্নত এমকে-১এ সংস্করণের ১৮০টি যুদ্ধবিমান তৈরির অর্ডার পেয়েছে। কিন্তু জিই (জেনারেল ইলেকট্রিক) অ্যারোস্পেসের ইঞ্জিন সরবরাহ শৃঙ্খলে জটিলতার কারণে এখনো ডেলিভারি শুরু করতে পারেনি এইচএএল। সম্প্রতি অবসর নেওয়া এইচএএলের এক সাবেক নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুবাইয়ের দুর্ঘটনা ‘এই মুহূর্তে রপ্তানির সম্ভাবনাকে শূন্যে নামিয়ে এনেছে।’

ভারতের লক্ষ্য ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বাজার। ২০২৩ সালে মালয়েশিয়ায় অফিসও খুলেছিল এইচএএল। সাবেক ওই নির্বাহীর মন্তব্য, আগামী কয়েক বছর পুরো মনোযোগ যাবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়ানোর কাজে।

এদিকে, ভারতীয় বিমান বাহিনী উদ্বিগ্ন। তাদের স্কোয়াড্রন সংখ্যা অনুমোদিত ৪২ থেকে নেমে এসেছে ২৯–এ। শিগগিরই অবসর নেবে প্রাথমিক সংস্করণের মিগ-২৯, অ্যাংলো–ফরাসি জাগুয়ার ও ফরাসি মিরেজ–২০০০। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এগুলোর জায়গা নেওয়ার কথা ছিল তেজসের। কিন্তু উৎপাদন সমস্যা চলছে।’

ফলে ভারত তাড়াহুড়োর মধ্যে বিকল্প খুঁজছে। দেশটির কর্মকর্তাদের মতে, অবিলম্বে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ফরাসি রাফাল কেনার বিষয়টি আবার বিবেচনায় আছে। পাশাপাশি, দেশে ইতিমধ্যে থাকা প্রায় ৪০টি তেজসের সংখ্যাও বাড়ানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ এবং রাশিয়ার সু-৫৭ যুদ্ধবিমানের প্রস্তাবও ভারত বিবেচনা করছে। দুবাইয়ে একই মঞ্চে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির এই দুই উন্নত মডেলকে দেখা খুবই বিরল ঘটনা।

ভারত বহু বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি নিজস্ব সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে তেজস যুদ্ধবিমানকে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই ওই বিমানে উড়াল দিয়ে সেই বার্তা আরও জোরালো করেছিলেন।

লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সহযোগী গবেষক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ জানানা, অন্য অনেক যুদ্ধবিমান কর্মসূচির মতো তেজসও প্রযুক্তি আর কূটনীতির সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নজর কাড়ার লড়াই চালিয়েছে। ১৯৯৮ সালের পরমাণু পরীক্ষার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, সঙ্গে স্থানীয়ভাবে ইঞ্জিন তৈরিতে জটিলতা—এসব কারণে শুরুতে উন্নয়ন কাজ আটকে ছিল।

ল্যাডউইগের মতে, তেজসের দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্ব বিদেশে বিক্রির চেয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিমান কর্মসূচির জন্য যে শিল্প-প্রযুক্তিগত ভিত তৈরি করছে, সেখানেই।

ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই শক্ত উপস্থিতি নিয়ে হাজির হয়েছিল ওই প্রদর্শনীতে। প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সামনে তেজস আকাশে কয়েক দফা কসরত দেখিয়েছে। পাকিস্তান জানায়, তাদের জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-থ্রি যুদ্ধবিমান রপ্তানির জন্য একটি ‘বন্ধু দেশের’ সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে। এই বিমানটি তারা চীনের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেছে।

শো-এর র্যাম্পে জেএফ-১৭–এর পাশে সাজানো ছিল বিভিন্ন অস্ত্র, যার মধ্যে ছিল পিএল-১৫ ই। চীনা এই ক্ষেপণাস্ত্র পরিবারের রপ্তানি সংস্করণটি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, এটি নাকি গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে ভারতের ব্যবহৃত একটি ফরাসি রাফালকে ভূপাতিত করেছিল।

প্রদর্শনীর আরেক পাশে পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স (পিএসি) জেএফ-১৭–কে ‘যুদ্ধে পরীক্ষিত’ বলে প্রচারপত্র বিতরণ করছিল। এই মডেলই ওই চার দিনের সংঘর্ষে পাকিস্তানের ব্যবহৃত দুই ধরনের বিমানের একটি। ভারত তেজসকে নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, গত মে মাসের চার দিনের সংঘাতে তেজসকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে কারণ জানানো হয়নি।

এ বছর ২৬ জানুয়ারি দিল্লির প্রজাতন্ত্র দিবসের আকাশ প্রদর্শনীতেও তেজস অংশ নেয়নি। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, একক ইঞ্জিনের বিমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ভারতের তেজস মূলত হালকা, এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট মাল্টিরোল ফাইটার জেট বা লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট। ডেল্টা-উইং নকশার কারণে উচ্চ গতিতেও এটি স্থিতিশীল থাকে। বিমানটিতে আছে জেনারেল ইলেকট্রিকের জিই–এফ ৪০৪–জিই–আইএন ২০ টার্বোফ্যান ইঞ্জিন, যেটি ৮৫ থেকে ৯০ কিলোনিউটন পর্যন্ত থ্রাস্ট দিতে পারে। ভারতের নিজস্ব কাবেরি ইঞ্জিন ব্যর্থ হওয়ায় এখনও বিদেশি ইঞ্জিন ব্যবহারই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

তেজস সর্বোচ্চ মাক ১.৬ বা শব্দের গতির চেয়েও ১.৬ গুণ বেশি গতিতে উড়তে পারে এবং প্রায় ৫২ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে পারে। মিশনের ধরন অনুযায়ী এর কমব্যাট রেঞ্জ সাধারণত ৫০০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার। বিমানের আটটি হার্ডপয়েন্টে সাড়ে তিন থেকে চার টন পর্যন্ত অস্ত্র বহন করা যায়, যার মধ্যে আছে ডার্বি, আস্ত্রা ও পাইথন-৫ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল, লেজার-গাইডেড বোমা, অ্যান্টি-শিপ মিসাইল এবং ২৩ মিমি কামান।

এভিয়নিক্সের দিক থেকেও তেজস বেশ আধুনিক; এতে আছে ফ্লাই-বাই-ওয়্যার সিস্টেম, মাল্টি-মোড রাডার, উন্নত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট, স্যাটেলাইটভিত্তিক নেভিগেশন, গ্লাস ককপিট আর হোলোগ্রাফিক হুড। কার্বন-ফাইবার কম্পোজিট ব্যবহারের কারণে রাডারে বিমানের প্রতিফলন তুলনামূলক কম, যদিও এটাকে পুরোপুরি স্টেলথ বলা যায় না। তেজসের কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট আছে, যেমন মার্ক–১, উন্নত এভিয়নিক্স-সমৃদ্ধ মার্ক–১ এ, আর বড় পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে মার্ক–২।

বিপরীতে জেএফ–১৭ থান্ডার ব্লক থ্রি হলো পাকিস্তান ও চীনের যৌথভাবে তৈরি হালকা বহুমুখী যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ। বিমানটিতে আছে চীনের ডব্লিউএস–১৩ বা উন্নততর কেএলজে–৭এ এইএসএ রাডার, যা লক্ষ্য শনাক্তে আগের মডেলের তুলনায় অনেক দ্রুত ও নির্ভুল। ব্লক থ্রি সর্বোচ্চ ম্যাক ১.৬ গতিতে উড়তে পারে এবং প্রায় ৫০ হাজার ফুট পর্যন্ত ওঠে। এতে ফ্লাই-বাই-ওয়্যার সিস্টেম, হেলমেট-মাউন্টেড ডিসপ্লে, গ্লাস ককপিট আর উন্নত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট রয়েছে।

এটি প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজির মতো অস্ত্র ধারণ করতে পারে। এর প্রধান আকর্ষণ পিএল-১৫ লং-রেঞ্জ এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল, যার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি বলে দাবি করা হয়। সঙ্গে পিএল-১০ শর্ট-রেঞ্জ মিসাইল, বিভিন্ন লেজার-গাইডেড বোমা, স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র আর ২৩ মিমি কামানও বহন করতে পারে। কার্বন-কম্পোজিট উপাদান থাকার কারণে রাডার সিগনেচার আগের ব্লকের চেয়ে কম, তবে এটিকে স্টেলথের কাতারে ফেলার মতো নয়।


রয়টার্স অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ডেটা সেন্টার বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে ভারত, পানি-বিদ্যুৎ সংকটে ভোগান্তি বাড়বে সাধারণ মানুষের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতের অনেক এলাকার অসংখ্য মানুষ পানীয় জলের তীব্র সংকটে ভুগছে। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের অনেক এলাকার অসংখ্য মানুষ পানীয় জলের তীব্র সংকটে ভুগছে। ছবি: সংগৃহীত

এশিয়া মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এখন ভারত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অবিশ্বাস্য এবং দ্রুতগতির উত্থান ডেটা সেন্টার শিল্পে এক বিশাল জোয়ার এনেছে এই দেশে। ফলে দেশটি একটি বৈশ্বিক ডিজিটাল কেন্দ্রে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল জীবনের মেরুদণ্ড এই ডেটা সেন্টারগুলো মূলত কম্পিউটার সার্ভার, আইটি পরিকাঠামো এবং নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম হোস্ট করে। এই ডেটা সেন্টারগুলোই চ্যাটজিপিটি-এর জটিল প্রশ্ন থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক যান (ইভি) পরিচালনা এবং স্ট্রিমিং পরিষেবার মতো সবকিছুর শক্তি জোগায়।

গত মাসে এই খাতের সবচেয়ে বড় খবর আসে যখন প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগল ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তমে একটি অত্যাধুনিক এআই ডেটা সেন্টারে রেকর্ড ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এটি ভারতে গুগলের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক বিনিয়োগ।

এই বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রেখে আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডব্লিউএস) এবং মেটা-এর মতো জায়ান্ট এবং স্থানীয় সংস্থা যেমন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজসহ বহু সংস্থা ভারতের ডেটা সেন্টার বাজারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছে। এমনকি বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররাও এখন এই বিশাল কম্পিউটিং অবকাঠামোগুলো তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

গ্লোবাল রিয়েল এস্টেট উপদেষ্টা জেএলএল (জেএলএল)-এর মতে, এই শিল্প বিশাল উত্থানের জন্য প্রস্তুত। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতের ডেটা সেন্টারের সক্ষমতা ৭৭ শতাংশ বেড়ে ১.৮ গিগাওয়াটে পৌঁছাবে। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য ২৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেটা সেন্টারের জন্য ভারতের আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার পেছনে একাধিক শক্তিশালী অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে, যেমন:

কম পরিচালন ব্যয়: কোটা রিসার্চ (Kotak Research)-এর তথ্য অনুসারে, ভারতে ডেটা সেন্টার স্থাপনের খরচ বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন, শুধু চীনের চেয়ে সামান্য বেশি। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের তুলনায় ভারতে বিদ্যুতের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

বিশাল ডেটার চাহিদা: যদিও বিশ্বে মোট ডেটা তৈরির প্রায় ২০ শতাংশ ভারতের অবদান, বিশ্বব্যাপী ডেটা সেন্টার সক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ ভারতে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যবহারের কারণে ২০২৮ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ ডেটা ব্যবহারকারী দেশে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে—ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে।

এআই-এর প্রভাব: এআই চ্যাটবটগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবহারকারী রয়েছে ভারতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের জন্য অতিরিক্ত কম্পিউটিং সক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা ডেটা সেন্টারের চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

প্রযুক্তিগত মানবসম্পদ: এই শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বমানের প্রযুক্তিগত প্রতিভা ও দক্ষ জনবল এ দেশে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক বিভূতি গর্গ বলেন, ‘যেমন আমরা নব্বই এবং দুই হাজারের দশকে আইটি পরিষেবার উত্থানকে কাজে লাগিয়েছিলাম, এটিও আমাদের জন্য আরেকটি বিশাল অর্থনৈতিক সুযোগ।’

এই বিপুল বিনিয়োগ দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ডেটা সেন্টারগুলো যেহেতু বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ এবং পানি ব্যবহার করে, তাই এটি ভারতের ডিকার্বনাইজেশন (কার্বনমুক্ত অর্থনীতি) পরিকল্পনা এবং পরিবেশের জন্য গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে পানির সংকট এবং বিদ্যুতের ঘাটতি থাকা ভারতে এই চ্যালেঞ্জ আরও প্রকট।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ ভারতে বাস করলেও, এখানে রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ পানিসম্পদ, যা ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে পানি-সংকটপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে।

ডেটা সেন্টারগুলোর পানির ব্যবহার ২০২৫ সালের ১৫০ বিলিয়ন লিটার থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৩৫৮ বিলিয়ন লিটারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এটি ভারতের ভূগর্ভস্থ পানিস্তরকে তীব্র চাপের মুখে ফেলবে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, এই দশকের মধ্যেই ভারতের ৬০-৮০ শতাংশ ডেটা সেন্টারকে সীমিত পানি সরবরাহের চাপে পড়তে হবে।

অ্যাডভোকেসি গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ফোরাম অন্ধ্র প্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গুগলের ডেটা সেন্টারের জন্য ‘সরকারি সম্পদ শোষণ’ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ বিশাখাপত্তম শহর ইতিমধ্যেই তীব্র পানি-সংকটে ভুগছে বলে জানিয়েছে তারা।

আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ)-এর মতে, ডেটা সেন্টারগুলোর জন্য ভারতের বিদ্যুৎ ব্যবহার দেশের মোট বিদ্যুতের চাহিদার ০.৫-১ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১-২ শতাংশ হবে।

বিভূতি গর্গ সতর্ক করেন, ‘এর অর্থ হতে পারে জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি। কারণ বর্তমানে এমন কোনো নিয়ম বা বিধি নেই যা ডেটা সেন্টারগুলোকে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে বাধ্য করে।’

ওয়াটার রিসার্চ অর্গানাইজেশন ডব্লিউআরআই ইন্ডিয়ার সাহানা গোস্বামী জানান, ডেটা সুরক্ষা এবং ডেটা সেন্টার নিয়ন্ত্রণের জন্য সুস্পষ্ট নীতি থাকলেও, পানির ব্যবহার এই নীতিগুলোর মধ্যে প্রধানভাবে স্থান পায়নি, এটা বলতে গেলে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্লাইন্ড স্পট। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে এই সেন্টারগুলোর কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটার ঝুঁকি রয়েছে। গ্রীষ্মকালে পানির অভাবে ডেটা সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংকিং, হাসপাতাল বা পরিবহন ব্যবস্থার মতো জরুরি পরিষেবাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এসব সংকট মোকাবিলায় বিশেজ্ঞরা কিছু বিকল্প পরামর্শ দিয়েছেন:

পানির পুনর্ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা: বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের বিশেষজ্ঞ প্রবীণ রামমূর্তি বলেন, ডেটা সেন্টার ঠান্ডা করার প্রয়োজনের জন্য অবশ্যই অ-পানীয় বা পরিশোধিত বর্জ্য পানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত।

শূন্য-পানি প্রযুক্তি: বিশ্বব্যাপী উন্নত হওয়া শূন্য-পানি শীতলকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং নতুন প্রকল্পগুলোর জন্য ‘কম চাপযুক্ত পানি অববাহিকা’ নির্বাচন করা উচিত। অর্থাৎ যেসব এলাকায় প্রাকৃতিক পানির ব্যবহার কম সেসব স্থানে ডেটা সেন্টার স্থাপনে জোর দিতে হবে।

সবুজ জ্বালানি বাধ্যতামূলক করা: বিভূতি গর্গ জোর দেন, ডেটা সেন্টারগুলোর কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করলেও, ‘সবুজ জ্বালানি ব্যবহার আনুষ্ঠানিকভাবে বাধ্যতামূলক’ করলে তবেই এই ডিজিটাল উন্নয়ন আরও টেকসই হবে।

বিভূতি গর্গ উপসংহারে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে একটি ভালো জিনিসের জন্য অন্য ভালো জিনিস যেন বলি না হয়।’

সূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ২৮ দফা প্রস্তাবে কী আছে, কে কী পাবে, কী হারাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পারলেও ইউক্রেনে ব্যর্থ হচ্ছেন মূলত অঞ্চলটিতে তাঁর প্রভাব বলয়ের ব্যর্থতার কারণে। ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পারলেও ইউক্রেনে ব্যর্থ হচ্ছেন মূলত অঞ্চলটিতে তাঁর প্রভাব বলয়ের ব্যর্থতার কারণে। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ২৮ দফা শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব অনুসারে, কিয়েভকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিশাল একটি অংশ রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে, সেনাবাহিনীর আকার কমাতে হবে এবং ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম এই ২৮ দফা পরিকল্পনার একটি খসড়া পেয়েছে। পরে তা তা এক ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা, এক মার্কিন কর্মকর্তা এবং প্রস্তাবটির সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র যাচাই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ‘দ্রুততর সময়সীমার’ মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাপ দিচ্ছে। আর পরিকল্পনায় এমন সব প্রস্তাব রয়েছে, যা ইউক্রেন বহুবার প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে এবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পরিকল্পনাটিকে সরাসরি বাতিল করছেন না।

হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, পরিকল্পনাটি ইউক্রেনের জন্য ‘সহজ নয়।’ তবে তাঁর দাবি, যুদ্ধ থামাতেই হবে, আর তা না হলে ইউক্রেন আরও বেশি এলাকা হারাতে পারে।

ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এই খসড়া তৈরি করেছেন এবং এতে পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিও ও ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের মতামতও ছিল। উইটকফ পরিকল্পনাটি নিয়ে রাশিয়ার দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দিমিত্রিয়েভ অ্যাক্সিওসকে বলেন, তিনি আশাবাদী, কারণ এ বার ‘রাশিয়ার অবস্থান সত্যিই গুরুত্ব পাচ্ছে।’ যদিও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখনো পরিকল্পনাটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেননি।

দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে বৈঠকের পর উইটকফ ও কুশনার ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রুস্তেম উমেরভের সঙ্গেও পরিকল্পনাটি নিয়ে আলোচনা করেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর সচিব ড্যান ড্রিসকল গতকাল বৃহস্পতিবার পরিকল্পনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জেলেনস্কির হাতে তুলে দেন। এর পর জেলেনস্কি জানান, তিনি ট্রাম্প ও তাঁর দলের সঙ্গে এটি নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত।

জেলেনস্কি বলেছেন, এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ‘চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গি’, চূড়ান্ত প্রস্তাব নয়। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তাঁর অবস্থানের চূড়ান্ত রেখা স্পষ্ট করেছে এবং বলেছে পরিকল্পনাটিকে ‘বাস্তব অর্থবহ’ করতে নিজেদের প্রস্তাব দেবে। এক মার্কিন কর্মকর্তা অ্যাক্সিওসকে বলেছেন, পরিকল্পনাটিকে তারা ‘জীবন্ত নথি’ হিসেবে দেখছেন, আলোচনার ভিত্তিতে যা পরিবর্তিত হতে পারে। ওই কর্মকর্তার দাবি, আলোচনার সময় ইউক্রেন বেশ কিছু পয়েন্ট নিয়ে ইতিবাচক ছিল এবং তাতে তাদের কিছু অবস্থান যুক্ত করতেও পেরেছে।

ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে পরিকল্পনাটিকে সমর্থন দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর জন্য গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছি, ঠিক যেমন গাজা যুদ্ধ শেষ করেছি। আমরা মনে করি পরিকল্পনাটি সহজ নয়, কিন্তু ইউক্রেনের জন্য ভালো।’

ইউক্রেনে ভূখণ্ড ছাড়ার পাশাপাশি খসড়ায় বলা আছে, ইউক্রেনের ভূখণ্ডে আবার রুশ অনুপ্রবেশ হলে ‘সুনির্দিষ্ট সমন্বিত সামরিক প্রতিক্রিয়া’ দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র এতে কী ভূমিকা নেবে, তা স্পষ্ট নয়। পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও রয়েছে—জমে থাকা রুশ সম্পদের একটি অংশ দিয়ে ইউক্রেন পুনর্গঠনের তহবিল গঠন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব (যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও খনন খাতে) এবং রাশিয়ার জি–৮–এ ফিরে আসা।

যুদ্ধ চলাকালে যে সব পক্ষ যা করেছে—সবাইকে সাধারণ ক্ষমা দেওয়া হবে। অর্থাৎ রুশ কর্মকর্তাদের ও সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা চলবে না। ইউক্রেনকে চুক্তির ১০০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। জেলেনস্কি সেপ্টেম্বর মাসে অ্যাক্সিওসকে বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি হলেই তিনি নির্বাচন চান।

নিচে ছাড়া বর্তমান ২৮ দফা পরিকল্পনাটি হুবহু তুলে ধরা হলো। অ্যাক্সিওস স্পষ্টতার জন্য কিছুস্থানে ইটালিকে ব্যাখ্যা যোগ করেছে।

১. ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা হবে।

২. রাশিয়া, ইউক্রেন ও ইউরোপের মধ্যে একটি সমন্বিত অনাক্রমণ চুক্তি সম্পন্ন হবে। গত ৩০ বছরের সব ধোঁয়াশা নিষ্পত্তি হবে।

৩. রাশিয়া প্রতিবেশী দেশগুলোতে আক্রমণ করবে না এবং ন্যাটো আর সম্প্রসারিত হবে না।

৪. রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সংলাপ হবে, যাতে সব নিরাপত্তা ইস্যু সমাধান, উত্তেজনা প্রশমনের পরিবেশ তৈরি এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা বাড়ানো যায়।

৫. ইউক্রেন নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাবে।

ব্যাখ্যা: এক মার্কিন কর্মকর্তা অ্যাক্সিওসকে বলেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হবে, যা এর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় তোলা হয়নি। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা খসড়ায় নেই।

৬. ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬ লাখে সীমাবদ্ধ থাকবে।

  • ব্যাখ্যা: বর্তমানে ইউক্রেনের সেনাসংখ্যা ৮ লাখ থেকে সাড়ে ৮ লাখের মধ্যে, আর যুদ্ধের আগে ছিল প্রায় আড়াই লাখ।

৭. ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না, এটি দেশটির সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ন্যাটোও নিজেদের বিধিতে যুক্ত করবে যে, ইউক্রেনকে ভবিষ্যতেও নেওয়া হবে না।

৮. ন্যাটো ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করবে না।

  • ব্যাখ্যা: ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনে অল্পসংখ্যক সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব বিবেচনা করছিল। এই পরিকল্পনায় তা উপেক্ষা করা হয়েছে।

৯. ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান পোল্যান্ডে মোতায়েন করা হবে।

১০. যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টি—

  • যুক্তরাষ্ট্র এই গ্যারান্টির জন্য ক্ষতিপূরণ পাবে।
  • ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় আক্রমণ করে, সে ক্ষেত্রে এই গ্যারান্টি বাতিল হবে।
  • রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ চালায়, তাহলে সমন্বিত ও কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সমস্ত বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হবে, নতুন দখলকৃত অঞ্চলকে দেওয়া স্বীকৃতি ও এই চুক্তির অধীনে পাওয়া সব সুবিধা প্রত্যাহার হবে।
  • ইউক্রেন কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে নিরাপত্তা গ্যারান্টি অবৈধ বলে গণ্য হবে।

১১. ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্যতা—

  • ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে এবং বিষয়টি বিবেচনায় থাকা অবস্থায় ইউরোপীয় বাজারে স্বল্পমেয়াদি বিশেষ সুবিধা পাবে।

১২. ইউক্রেন পুনর্গঠনের শক্তিশালী বৈশ্বিক উদ্যোগ—

  • দ্রুত বর্ধনশীল খাতে (প্রযুক্তি, ডেটা সেন্টার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি) বিনিয়োগের জন্য একটি ইউক্রেন ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠন করা হবে।
  • যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সঙ্গে একযোগে দেশটির গ্যাস অবকাঠামো (পাইপলাইন, সংরক্ষণাগারসহ) পুনর্নির্মাণ, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও পরিচালনায় সহযোগিতা করবে।
  • যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলো পুনর্বাসন করে শহর ও আবাসিক অঞ্চল পুনর্নির্মাণ ও আধুনিকায়নের কাজ করা হবে।
  • অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
  • খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন।
  • বিশ্বব্যাংক এসব উদ্যোগের গতি বাড়াতে বিশেষ অর্থায়ন প্যাকেজ তৈরি করবে।

১৩. রাশিয়াকে পুনরায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্ত করা—

  • নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে, প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদাভাবে আলোচনার মাধ্যমে তুলে নেওয়া হবে।
  • যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সেন্টার, আর্কটিকে দুর্লভ খনিজ উত্তোলন প্রকল্প এবং অন্যান্য পারস্পরিক লাভজনক করপোরেট খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তিতে প্রবেশ করবে।
  • রাশিয়াকে জি-৮ এ ফিরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে।

১৪. জব্দ রুশ সম্পদ ব্যবহারের প্রস্তাব

  • বিভিন্ন দেশে জব্দ করা রুশ সম্পদের ১০০ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউক্রেন পুনর্নির্মাণে বিনিয়োগ করা হবে।
  • যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগ থেকে ৫০ শতাংশ মুনাফা পাবে।
  • ইউরোপ আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করবে, যাতে ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য মোট বিনিয়োগ বাড়ানো যায়।
  • ইউরোপে জব্দ রুশ সম্পদ মুক্ত করা হবে।
  • বাকি রুশ সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার যৌথ বিনিয়োগ তহবিলে রাখা হবে, যা নির্দিষ্ট খাতে যৌথ প্রকল্প পরিচালনা করবে। এর লক্ষ্য হবে দুই পক্ষের স্বার্থ বাড়িয়ে ভবিষ্যতে সংঘাতে না ফেরার প্রণোদনা সৃষ্টি করা।

১৫. যৌথ নিরাপত্তা ওয়ার্কিং গ্রুপ

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নিরাপত্তা বিষয়ক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করবে, যারা এই চুক্তির প্রতিটি ধারার বাস্তবায়ন তদারকি করবে।

১৬. রাশিয়ার অনাক্রমণনীতি—

  • রাশিয়া আইন করে ইউরোপ ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অনাক্রমণের নীতি নিশ্চিত করবে।

১৭. পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ—

  • নিউ স্টার্টসহ পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধবিষয়ক সব চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একমত হবে। (নোট: নিউ স্টার্ট, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার শেষ বড় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, ফেব্রুয়ারিতে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কথা।)

১৮. ইউক্রেনের অ-পারমাণবিক অবস্থান

  • ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র অ–প্রসারণ চুক্তি অনুযায়ী নিজেকে একটি অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে বজায় রাখবে।

১৯. জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

  • আইএইএর তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রটি চালু করা হবে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাশিয়া ও ইউক্রেন সমান হারে পাবে (৫০:৫০)।

২০. সংস্কৃতি ও সহনশীলতা বিষয়ক শিক্ষা

  • দুই দেশ ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি বোঝাপড়া, সহনশীলতা বাড়ানো এবং বর্ণবাদ ও কুসংস্কার দূরীকরণের লক্ষ্যে স্কুল ও সমাজে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করবে।
  • ইউক্রেন ধর্মীয় সহনশীলতা ও ভাষাগত সংখ্যালঘু সুরক্ষায় ইইউর নিয়ম গ্রহণ করবে।
  • দুই দেশই বৈষম্যমূলক সব ব্যবস্থা বাতিল করবে এবং ইউক্রেনীয় ও রুশ গণমাধ্যম ও শিক্ষার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করবে। (নোট—ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২০ সালের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি পরিকল্পনায়ও এমন ধারণা ছিল।)
  • নাৎসি মতাদর্শ ও সংশ্লিষ্ট সব কর্মকাণ্ড অস্বীকার ও নিষিদ্ধ করা হবে।

২১. ভূখণ্ড—

  • ক্রিমিয়া, লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিকভাবে বাস্তবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
  • খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চল নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে স্থির করা হবে, যা কার্যত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হবে।
  • রাশিয়া পাঁচ অঞ্চলের বাইরে নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য সম্মত ভূখণ্ড ত্যাগ করবে।
  • ইউক্রেন দোনেৎস্কের যে অংশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। এই এলাকা নিরস্ত্রীকৃত বাফার জোন হিসেবে গণ্য হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তবে রুশ সেনা এই নিরস্ত্রীকৃত এলাকায় প্রবেশ করবে না।

২২. বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধকরণ

  • ভবিষ্যৎ ভূখণ্ড ব্যবস্থা নিয়ে সম্মত হওয়ার পর রাশিয়া ও ইউক্রেন কোনোভাবেই বলপ্রয়োগ করে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবে না। এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে কোনো নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রযোজ্য হবে না।

২৩. দিনিপ্রো নদী ও কৃষ্ণ সাগর

  • রাশিয়া ইউক্রেনকে দিনিপ্রো নদী ব্যবহার করে বাণিজ্য পরিচালনায় বাধা দেবে না। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে শস্য পরিবহনে অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে দুই পক্ষ চুক্তিতে পৌঁছাবে।

২৪. মানবিক কমিটি

  • অমীমাংসিত বিষয়ে একটি মানবিক কমিটি গঠন করা হবে।
  • সব বন্দী ও মৃতদেহ ‘সবার বিনিময়ে সবাই’ নীতিতে বিনিময় করা হবে।
  • সব বেসামরিক আটক ব্যক্তি ও জিম্মিদের, এমনকি শিশুদেরও, ফেরত পাঠানো হবে।
  • পরিবার পুনর্মিলন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
  • সংঘাতের শিকার মানুষের দুঃখ কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২৫. ইউক্রেনে নির্বাচন

  • ইউক্রেন ১০০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবে।

২৬. সাধারণ পূর্ণ ক্ষমা

  • যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ পূর্ণ ক্ষমা পাবে এবং ভবিষ্যতে কোনো দাবি বা অভিযোগ উত্থাপন না করার অঙ্গীকার করবে।

২৭. চুক্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা

  • এই চুক্তি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হবে। এর বাস্তবায়ন তদারকি ও নিশ্চয়তা দেবে পিস কাউন্সিল, যার প্রধান থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প।
  • চুক্তিভঙ্গের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। (নোট: গাজা শান্তি পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ট্রাম্প একই কাঠামো প্রস্তাব করেছিলেন।)

২৮. চূড়ান্ত ধাপ

  • সব পক্ষ এই স্মারক চুক্তিতে সম্মত হলে, উভয় পক্ষ নির্ধারিত স্থানে সরে যাওয়ার পরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে এবং চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হবে।
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ট্রাম্পের কাছে চেয়ে প্রায় সবই পেলেন সৌদি যুবরাজ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সফররত সৌদি যুবরাজ। ছবি: সিএনএন
হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সফররত সৌদি যুবরাজ। ছবি: সিএনএন

মাত্র তিন বছর আগেই সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে কি না, পুনর্বিবেচনা করছিল যুক্তরাষ্ট্র। তখনকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের দায়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে তিনি ‘পরিত্যাজ্য’ করে তুলবেন। এমনকি ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ সামরিক মিত্রদের অন্যতম হওয়ার পরও সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত ছিল।

কিন্তু এই সপ্তাহেই এক ভিন্ন দৃশ্য দেখা গেল। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যখন হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে এতটাই সুরক্ষা দিলেন যে, খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করায় এক সাংবাদিককে তিনি ভর্ৎসনা করলেন—‘আমাদের অতিথিকে বিব্রত করবেন না।’

নাটকীয় ওই মুহূর্ত ছাড়াও ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণাগুলোই বলে দিচ্ছে, কীভাবে ওয়াশিংটনে বিন সালমানের ভাবমূর্তি দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং ট্রাম্প কতটা আগ্রহ দেখিয়েছেন সম্পর্ক গভীর করতে—এমন এক রাজ্যের সঙ্গে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং যাদের সঙ্গে ট্রাম্প পরিবারেরও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে।

ইসরায়েল-সৌদি স্বাভাবিকীকরণ ছাড়াই বড় চুক্তি

বিন সালমানের সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত এটাই যে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক না করেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই ধরনের চুক্তি করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের প্রতি শর্ত ছিল, দেশটিকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পূর্ণ স্বাভাবিকীকরণ করতে হবে। ট্রাম্প সেই শর্তটি বাদ দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের সময় তিন স্তরের কাঠামো—যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি, সৌদি-ইসরায়েল স্বাভাবিকীকরণ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বিষয়ে ইসরায়েলি প্রতিশ্রুতি—একসঙ্গে এগোনোর কথা ছিল। কিন্তু ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে অনড় থাকায় এবং সৌদি আরব অবস্থান নরম করতে রাজি না হওয়ায় আলোচনা থেমে গিয়েছিল।

ট্রাম্প এখন সেই তিনটি বিষয়ের যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। ফলে প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই সৌদি আরব যা যা চেয়েছিল তার প্রায় সবই পেতে যাচ্ছে।

এই সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সৌদি আরবকে ন্যাটোর বাইরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ (মেজর) মিত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির কাছে ইসরায়েলের ব্যবহৃত মডেলের মতো উন্নত এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির প্রক্রিয়া এগিয়েছে। এ ছাড়া নতুন কৌশলগত প্রতিরক্ষা সমঝোতাও সই হয়েছে।

তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অর্থনীতি পুনর্গঠনের সৌদি পরিকল্পনার প্রতি সম্মান জানিয়ে দেশটির কাছে উন্নত চিপ বিক্রি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ চুক্তি এবং পারমাণবিক শক্তি নিয়ে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিন সালমানের লক্ষ্যের অংশ হিসেবে সুদান যুদ্ধ শেষ করতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ট্রাম্প।

যা পায়নি সৌদি আরব

এত কিছুর পরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে সৌদি আরবকে ছাড় দেননি ট্রাম্প। প্রথমত, নিজস্ব ভূখণ্ডে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অনুমোদন পায়নি সৌদি আরব। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতিও পায়নি।

মার্কিন কর্তৃপক্ষ বহুদিন ধরেই সৌদি আরবের পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণের বিষয়ে সতর্ক। কারণ এটি উচ্চমাত্রায় পরিশোধিত হলে অস্ত্র তৈরির ঝুঁকি থাকে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নতুন চুক্তিতে এমন কোনো অনুমতি নেই।

আর প্রতিরক্ষা গ্যারান্টির ক্ষেত্রে, কাতার যেভাবে শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, সৌদি আরবও তেমন কিছু চেয়েছে। এমনকি ট্রাম্প–পরবর্তী সময়ও এটি বহাল থাকবে—এমন একটি চুক্তি। কিন্তু হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে এই বিষয়ে কোনো অঙ্গীকার নেই।

এদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব দেখিয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র যদি দৃঢ়ভাবে পাশে না দাঁড়ায়, তবে তারা বিকল্প নিরাপত্তা অংশীদার খুঁজতে প্রস্তুত। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাড়তে থাকা সম্পর্ক তারই ইঙ্গিত।

তবুও বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় এখন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্ক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি কৌশলগত।

ওভাল অফিসে ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ বিষয়ে বিন সালমান ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, যদিও তিনি এ ক্ষেত্রে ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাননি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত