Ajker Patrika

ডেটা সেন্টার বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে ভারত, পানি-বিদ্যুৎ সংকটে ভোগান্তি বাড়বে সাধারণ মানুষের

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতের অনেক এলাকার অসংখ্য মানুষ পানীয় জলের তীব্র সংকটে ভুগছে। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের অনেক এলাকার অসংখ্য মানুষ পানীয় জলের তীব্র সংকটে ভুগছে। ছবি: সংগৃহীত

এশিয়া মহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এখন ভারত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অবিশ্বাস্য এবং দ্রুতগতির উত্থান ডেটা সেন্টার শিল্পে এক বিশাল জোয়ার এনেছে এই দেশে। ফলে দেশটি একটি বৈশ্বিক ডিজিটাল কেন্দ্রে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল জীবনের মেরুদণ্ড এই ডেটা সেন্টারগুলো মূলত কম্পিউটার সার্ভার, আইটি পরিকাঠামো এবং নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম হোস্ট করে। এই ডেটা সেন্টারগুলোই চ্যাটজিপিটি-এর জটিল প্রশ্ন থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক যান (ইভি) পরিচালনা এবং স্ট্রিমিং পরিষেবার মতো সবকিছুর শক্তি জোগায়।

গত মাসে এই খাতের সবচেয়ে বড় খবর আসে যখন প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগল ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তমে একটি অত্যাধুনিক এআই ডেটা সেন্টারে রেকর্ড ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এটি ভারতে গুগলের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক বিনিয়োগ।

এই বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রেখে আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডব্লিউএস) এবং মেটা-এর মতো জায়ান্ট এবং স্থানীয় সংস্থা যেমন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজসহ বহু সংস্থা ভারতের ডেটা সেন্টার বাজারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছে। এমনকি বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররাও এখন এই বিশাল কম্পিউটিং অবকাঠামোগুলো তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

গ্লোবাল রিয়েল এস্টেট উপদেষ্টা জেএলএল (জেএলএল)-এর মতে, এই শিল্প বিশাল উত্থানের জন্য প্রস্তুত। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতের ডেটা সেন্টারের সক্ষমতা ৭৭ শতাংশ বেড়ে ১.৮ গিগাওয়াটে পৌঁছাবে। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য ২৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেটা সেন্টারের জন্য ভারতের আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার পেছনে একাধিক শক্তিশালী অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে, যেমন:

কম পরিচালন ব্যয়: কোটা রিসার্চ (Kotak Research)-এর তথ্য অনুসারে, ভারতে ডেটা সেন্টার স্থাপনের খরচ বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন, শুধু চীনের চেয়ে সামান্য বেশি। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের তুলনায় ভারতে বিদ্যুতের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

বিশাল ডেটার চাহিদা: যদিও বিশ্বে মোট ডেটা তৈরির প্রায় ২০ শতাংশ ভারতের অবদান, বিশ্বব্যাপী ডেটা সেন্টার সক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ ভারতে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যবহারের কারণে ২০২৮ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ ডেটা ব্যবহারকারী দেশে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে—ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে।

এআই-এর প্রভাব: এআই চ্যাটবটগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবহারকারী রয়েছে ভারতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের জন্য অতিরিক্ত কম্পিউটিং সক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা ডেটা সেন্টারের চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

প্রযুক্তিগত মানবসম্পদ: এই শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বমানের প্রযুক্তিগত প্রতিভা ও দক্ষ জনবল এ দেশে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক বিভূতি গর্গ বলেন, ‘যেমন আমরা নব্বই এবং দুই হাজারের দশকে আইটি পরিষেবার উত্থানকে কাজে লাগিয়েছিলাম, এটিও আমাদের জন্য আরেকটি বিশাল অর্থনৈতিক সুযোগ।’

এই বিপুল বিনিয়োগ দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ডেটা সেন্টারগুলো যেহেতু বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ এবং পানি ব্যবহার করে, তাই এটি ভারতের ডিকার্বনাইজেশন (কার্বনমুক্ত অর্থনীতি) পরিকল্পনা এবং পরিবেশের জন্য গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে পানির সংকট এবং বিদ্যুতের ঘাটতি থাকা ভারতে এই চ্যালেঞ্জ আরও প্রকট।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ ভারতে বাস করলেও, এখানে রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ পানিসম্পদ, যা ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে পানি-সংকটপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে।

ডেটা সেন্টারগুলোর পানির ব্যবহার ২০২৫ সালের ১৫০ বিলিয়ন লিটার থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৩৫৮ বিলিয়ন লিটারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এটি ভারতের ভূগর্ভস্থ পানিস্তরকে তীব্র চাপের মুখে ফেলবে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, এই দশকের মধ্যেই ভারতের ৬০-৮০ শতাংশ ডেটা সেন্টারকে সীমিত পানি সরবরাহের চাপে পড়তে হবে।

অ্যাডভোকেসি গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ফোরাম অন্ধ্র প্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গুগলের ডেটা সেন্টারের জন্য ‘সরকারি সম্পদ শোষণ’ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ বিশাখাপত্তম শহর ইতিমধ্যেই তীব্র পানি-সংকটে ভুগছে বলে জানিয়েছে তারা।

আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ)-এর মতে, ডেটা সেন্টারগুলোর জন্য ভারতের বিদ্যুৎ ব্যবহার দেশের মোট বিদ্যুতের চাহিদার ০.৫-১ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১-২ শতাংশ হবে।

বিভূতি গর্গ সতর্ক করেন, ‘এর অর্থ হতে পারে জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি। কারণ বর্তমানে এমন কোনো নিয়ম বা বিধি নেই যা ডেটা সেন্টারগুলোকে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে বাধ্য করে।’

ওয়াটার রিসার্চ অর্গানাইজেশন ডব্লিউআরআই ইন্ডিয়ার সাহানা গোস্বামী জানান, ডেটা সুরক্ষা এবং ডেটা সেন্টার নিয়ন্ত্রণের জন্য সুস্পষ্ট নীতি থাকলেও, পানির ব্যবহার এই নীতিগুলোর মধ্যে প্রধানভাবে স্থান পায়নি, এটা বলতে গেলে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্লাইন্ড স্পট। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে এই সেন্টারগুলোর কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটার ঝুঁকি রয়েছে। গ্রীষ্মকালে পানির অভাবে ডেটা সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংকিং, হাসপাতাল বা পরিবহন ব্যবস্থার মতো জরুরি পরিষেবাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এসব সংকট মোকাবিলায় বিশেজ্ঞরা কিছু বিকল্প পরামর্শ দিয়েছেন:

পানির পুনর্ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা: বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের বিশেষজ্ঞ প্রবীণ রামমূর্তি বলেন, ডেটা সেন্টার ঠান্ডা করার প্রয়োজনের জন্য অবশ্যই অ-পানীয় বা পরিশোধিত বর্জ্য পানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত।

শূন্য-পানি প্রযুক্তি: বিশ্বব্যাপী উন্নত হওয়া শূন্য-পানি শীতলকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং নতুন প্রকল্পগুলোর জন্য ‘কম চাপযুক্ত পানি অববাহিকা’ নির্বাচন করা উচিত। অর্থাৎ যেসব এলাকায় প্রাকৃতিক পানির ব্যবহার কম সেসব স্থানে ডেটা সেন্টার স্থাপনে জোর দিতে হবে।

সবুজ জ্বালানি বাধ্যতামূলক করা: বিভূতি গর্গ জোর দেন, ডেটা সেন্টারগুলোর কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করলেও, ‘সবুজ জ্বালানি ব্যবহার আনুষ্ঠানিকভাবে বাধ্যতামূলক’ করলে তবেই এই ডিজিটাল উন্নয়ন আরও টেকসই হবে।

বিভূতি গর্গ উপসংহারে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে একটি ভালো জিনিসের জন্য অন্য ভালো জিনিস যেন বলি না হয়।’

সূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ