Ajker Patrika

মৃত্যুকূপের পাড়ে অপেক্ষা

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২১, ১৩: ১২
মৃত্যুকূপের পাড়ে অপেক্ষা

কোভিড মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেও মানব পাচারের ঘটনায় বিশ্বের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ আবার শিরোনাম হয়েছে। ৮ জুলাই তিউনিসিয়ার নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া একটি নৌকা থেকে ৪৯ জন বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে। অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে ‘ভূমধ্যসাগর’ এখন যেন মৃত্যুকূপ। এর আগে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই নৌকা ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। তার পরও এই স্রোত বন্ধ হচ্ছে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, লিবিয়ার মরুভূমিতে পাচারকারীদের হাতে ৩৬ বাংলাদেশির নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। এতে জনমনে কিছুটা আস্থা আসে। কিন্তু এরপরই কুয়েতে একজন সাংসদ গ্রেপ্তারের খবর সবকিছু সামনে এনে দেয়।  

পুলিশের হিসাব বলছে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন অন্তত পৌনে দুই লাখ বাংলাদেশি। তাঁরা বৈধ ভিসা নিয়েই অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন।

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গত ১৮ মাসে দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৪ জন নারী ও পুরুষ দেশ ছেড়েছেন। তাঁদের মধ্যে ফেরত এসেছেন মাত্র ২১ হাজার ৭৫৪ জন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ১ লাখ ৭৮ হাজার লোক কোথায় আছেন, তার কোনো ধারণা নেই পুলিশের। এ ছাড়া অন্য দেশের ভিসা নিয়েও ফেরেননি–এমন অনেক মানুষ আছেন। এঁদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।

ইউরোপের দেশ ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন নবাবগঞ্জের যুবক সাইদুর রহমান। ১৫ লাখ টাকায় ইতালিতে পাঠানোর চুক্তি হয় তুহিনুজ্জামান ভূঁইয়ার সঙ্গে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় থাইল্যান্ডে। সেখান থেকে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া হয়ে টোগোতে নিয়ে আটকে রাখা হয় সাইদুর রহমানকে। করা হয় চরম নির্যাতন। এরপর পরিবারের কাছ থেকে দুই কিস্তিতে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় তুহিনুজ্জামান ভূঁইয়ার চক্র। গত ২ এপ্রিল দেশে ফেরেন সাইদুর। এরপর তিনি ১৩ জুন গুলশান থানায় মানব পাচারকারী তুহিনুজ্জামান ভূঁইয়াসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সাইদুর বলেন, টোগোতে তাঁর সঙ্গে একই হোটেলে ২৫ জন বাংলাদেশিকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাঁদের ভাগ্যে কী জুটেছে, তা বলতে পারেন না।

ভাগ্য ফেরাতে চাঁদপুরের যুবক ইয়াসিন যেতে চেয়েছিলেন স্পেনে। পাচারকারী নুরুল আলম সুমনকে তিনি ৪ লাখ টাকা দেন। বাকি টাকা স্পেনে যাওয়ার পর দেবেন বলে চুক্তি হয়। কিন্তু তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হয় টোগোতে। বিদেশের মাটিতে তাঁকে নির্যাতন করে দেশে আরও ৬ লাখ টাকা আদায় করা হয় পরিবারের কাছ থেকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে তিনি দেশে পালিয়ে আসেন। এরপর দেশে ফিরে গুলশান থানায় গত ১৩ জুন নুরুল আলম সুমনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

আর পোল্যান্ডে নেওয়ার কথা বলে ময়মনসিংহের মাসুম সরদারকে মানব পাচারকারীরা নিয়ে গিয়েছিল উজবেকিস্তানে। তিনি ৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা দেশে থাকতেই দিয়েছিলেন মানব পাচারকারী ইয়াসির বারীকে। উজবেকিস্তানে একটি জঙ্গলে আটকে রেখে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয়। গত ৩ জুন দেশে পালিয়ে এসে ইয়াসির বারীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।

এভাবে অনেক তরুণ ভাগ্য ফেরানোর আশায় বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতাও করুণ। এদিকে পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পড়ে দেশ ছেড়েছেন এই তরুণ-যুবকেরা। তাঁরা রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন দুবাইয়ের বৈধ টুরিস্ট ভিসা–তারপর লিবিয়া আর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ। এই দুর্গম পথ তাঁরা পাড়ি নিচ্ছেন নৌকায় করে। এভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছেন।

জানতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি (ইমিগ্রেশন) মো. মনিরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া একটি নৌকা থেকে উদ্ধারের পর ২৫ জন বাংলাদেশি তিন ধাপে দেশে ফিরেছেন। তাঁরা ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছিলেন। তাঁদের মতো আরও অনেক বাংলাদেশি সেখানে অপেক্ষায় রয়েছেন।

অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে এখন সরাসরি লিবিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নেই। দালালেরা এখন দেশ থেকে বৈধ ভিসায় প্রথমে দুবাই বা তুরস্কে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর সেখান থেকে তাঁরা লিবিয়ায় যাচ্ছেন। আর লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

বিশেষ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশিদের পাচার করতে এর বাইরেও একটা নিরাপদ রুট বেছে নিয়েছে আন্তর্জাতিক মানব পাচারের একটি চক্র। এই চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিরা। এই চক্র দুবাই থেকে কাজাখস্তান, ইউক্রেনে নিয়ে যাচ্ছে লোকজনকে। সেখানে নিয়ে তাঁদের চুক্তিতে বিয়ে করানো হচ্ছে। বিয়েতে খরচ পড়ছে চার–পাঁচ শ ডলার। তারপর সেখানে পাওয়া আবাসিক অবস্থানের পাস দেখিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপে।

পুলিশের হিসাবে গত তিন মাসে সব মিলিয়ে অন্তত ৯৫০ জন বাংলাদেশিকে এভাবে উদ্ধার করা হয়েছে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুন পর্যন্ত অবৈধভাবে ইউরোপযাত্রার সময় একাধিক দেশের অন্তত ৮১০ জন অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাঁরা ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে এখন শীর্ষে থাকা চারটি দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। আর পুরো ইউরোপে নৌপথে অবৈধভাবে প্রবেশের শীর্ষে আছেন বাংলাদেশিরা।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় রোহিঙ্গাদের জাহাজের খোলে ভর্তি করে দাস পাচারের মতো ‘ডলফিন ভিসা’ বা ‘শিপে’ সাগরপথে মানব পাচার জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এরপর আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র এ নিয়ে জমজমাট ব্যবসা ফেঁদে বসে। ২০১৫ সালে আন্দামান সাগরে শুধু মানব বিপর্যয়েরই জন্ম দেয়নি, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তে সন্ধান মেলে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের গণকবর। এই দালাল চক্র শুরুর দিকে বিমানে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে নিয়ে তারপর জঙ্গলের পর জঙ্গল হাঁটিয়ে রাতের অন্ধকারে ট্রাকে, মালগাড়িতে, নৌকায় পাচার শুরু করেছিল। এখন তা আরও জমাজমাট হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, গত প্রায় আট বছরে দেশে ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪৭টি, অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিচারাধীন আছে প্রায় ৪ হাজার ৪০৭টি মামলা।

জানতে চাইলে র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইউরোপে পাঠানোর নাম করে মানুষ পাচার করা অধিকাংশ দালাল মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও শরীয়তপুর এলাকার। এরা আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চক্রের মূল হোতারা দেশের বাইরে বসে থেকে অনলাইন ভিসা ও বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে। এমন দালাল চক্রের হাত থেকে এখন পর্যন্ত ৭৭২ জন পুরুষ ও ২৩৪ জন নারীসহ মোট ১ হাজার ৬ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৯৬ জনকে।

অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশ্লেষক এবং আইওএমের সাবেক কর্মকর্তা আসিফ মুনীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, মানব পাচারের ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশকেন্দ্রিক নয়, পৃথিবীজুড়েই এই চক্র আছে। গত এক বছরে দেশে অবৈধ ও বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।  

অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক এই বিশ্লেষক বলেন, মানব পাচারের এই অবহেলা সরকারি ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের, যার কারণে বন্ধ হচ্ছে না পাচার। আর ভুক্তভোগীরা ঝুঁকিতে ফেলছেন নিজেদের ও নিজের পরিবারকে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত