Ajker Patrika

বাংলাদেশে দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় এত বিশৃঙ্খলা হয় কেন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ১১: ০৭
সোমবার রাজধানীর উত্তরায় স্কুলভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর উৎসুক জনতার ভিড়। ছবি: আজকের পত্রিকা
সোমবার রাজধানীর উত্তরায় স্কুলভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর উৎসুক জনতার ভিড়। ছবি: আজকের পত্রিকা

দেশে আকস্মিক কোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা ঘটলেই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় এই বিশৃঙ্খলা বেশি দৃশ্যমান হয়। যানজট ও প্রশস্ত রাস্তা না থাকার কারণে প্রায়ই ফায়ার সার্ভিসের দলকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। অনেক যুদ্ধ করে পৌঁছানোর পর পানি উৎস পেতে সমস্যা হয়। কোনো বড় শহরেই যথেষ্ট জলাশয় ও হাইড্রেন্ট নেই। রয়েছে সরঞ্জামের সংকটও।

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক আর অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনার মতো দুর্ঘটনা হোক তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার, ত্রাণ, রক্তদানের মতো কাজে হাত দিতে হয় স্থানীয় সাধারণ মানুষকেই। সাধারণ মানুষের অদক্ষতা ও পেশাদার বাহিনীর দেরিতে পৌঁছানোর কারণে অনেক সময়ই প্রাণহানি ন্যূনতম রাখা সম্ভব হয় না।

সেই সঙ্গে রয়েছে উৎসুক জনতা। সোশ্যাল মিডিয়াতে কনটেন্ট মনিটাইজেশন আসার পর এই প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। বিপদগ্রস্ত মানুষের মুখের সামনে মোবাইল ক্যামেরা ধরে ফুটেজ নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যায়। এতেও উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়। এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সামলানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে মোতায়েন করাও সম্ভব হয় না।

সম্প্রতি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার হৃদয়বিদারক ঘটনাটিতেও আমরা এমন দৃশ্য দেখেছি। বাংলাদেশে কেন যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই এমন বিশৃঙ্খলা দেখতে হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন। অথচ ‘হাডসনের মিরাকল’-এর মতো ঘটনাগুলোর দিকে যদি তাকাই, যেখানে সুসংগঠিত প্রস্তুতি ও দায়িত্বশীলতা কীভাবে বিপর্যয়কে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

‘হাডসনের মিরাকল’: প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত

২০০৯ সালে নিউইয়র্কের লা গারডিয়া বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই একটি এয়ারবাস এ৩২০-এর দুটি ইঞ্জিন পাখির আঘাতে বিকল হয়ে যায়। ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে পাইলট ক্যাপ্টেন সালি সুলেনবার্গার নিউইয়র্কের হাডসন নদীর বরফশীতল পানিতে বিমানটি সফলভাবে অবতরণ করান। অবিশ্বাস্যভাবে, বিমানের প্রতিটি যাত্রী ও ক্রু বেঁচে যান। এই ঘটনাকে অনেকে অলৌকিক বললেও, পাইলট সালি নিজেই ব্যাখ্যা করেছিলেন যে এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না, বরং ছিল ‘দশকের পর দশক ধরে চলে আসা প্রস্তুতির ফলাফল’।

হাডসন নদীতে অবতরণের পর সব আরোহীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া
হাডসন নদীতে অবতরণের পর সব আরোহীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া

সালি ব্যাখ্যা করেন, তিনি এবং তাঁর কো-পাইলট জেফ্রি স্কাইলস প্রায় কোনো কথা না বলেই তাঁদের নিজ নিজ কাজ সুচারুভাবে করেছেন। কারণ তাঁরা একে অপরের দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ইঞ্জিন বিকল হওয়া বা পানিতে অবতরণের জন্য তাঁদের একটি সুনির্দিষ্ট চেকলিস্ট ছিল, তাঁরা ঠিক সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি রুট নির্দেশ করে। যখন ‘ব্রেস ফর ইমপ্যাক্ট’ বা ‘এভাকুয়েট’-এর মতো নির্দেশনা দেওয়া হয়, তখন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা নিজেদের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্রুত কেবিন প্রস্তুত করেন এবং যাত্রীদের নিরাপদে বের করে আনেন। এমনকি নদীর ওপর নামার বিষয়টিও তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পরিবর্তন করেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উদ্ধারকারী ফেরি বোট চালকেরা প্রতি মাসেই প্রশিক্ষণ নেন। বছরে একবার সিমুলেটর দিয়ে উদ্ধার অভিযান অনুশীলন করেন তাঁরা। বিমানটি হাডসন নদীতে অবতরণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান তাঁরা। ফায়ারবোট, পুলিশ হেলিকপ্টার এবং শহরের হাসপাতালগুলো—সবাই প্রস্তুত ছিল। এমনকি অফ-ডিউটি চিকিৎসক, নার্সদেরও ডেকে আনা হয়েছিল। সালি জোর দিয়ে বলেন, তিনি এবং তাঁর কো-পাইলট কেবল তাঁদের কাজ করেছেন। কিন্তু ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, ১৫০ জন যাত্রী, উদ্ধারকারী বোট এবং জল ও স্থল উভয় জায়গার ফার্স্ট রেসপন্ডাররা সবাই তাঁদের নির্ধারিত কাজ নিখুঁতভাবে করেছেন। এই সম্মিলিত ও নিখুঁত প্রস্তুতির ফলাফলই ছিল ‘মিরাকল’।

মাইলস্টোন স্কুলের ঘটনা

‘হাডসনের মিরাকল’-এর এই চিত্র, আর বাংলাদেশের মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার ঘটনাটি মিলিয়ে দেখুন, আলাদা এক বাস্তবতা উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান স্কুল ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। এফোঁড়-ওফোঁড় করে যায় ভবন। তাৎক্ষণিকভাবে আগুন ধরে যায়। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের জীবন ও ভবিষ্যৎ এক মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

এর পরের ঘটনাপ্রবাহ কেমন ছিল—উদ্ধারে অনেক সময় লেগেছে। আগুন আধপোড়া শিশু-কিশোরদের পাঁজাকোলা করে উদ্ধার করতে দেখা গেছে। সেখানে জরুরি চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। যদিও পরে ফায়ার সার্ভিস অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে, সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের ব্যবস্থাও করেছিল। শত শত উৎসুক জনতা উদ্ধারে হাত না লাগিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃতদেহ গুম করার গুজব ছড়িয়েছে, এআই দিয়ে তৈরি অনেক ছবি ছড়ানো হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে গিয়ে শোডাউন করেছেন। চিকিৎসকের কোনো পরামর্শ ও আহ্বান ছাড়াই রক্তদাতাদের ভিড়ও সমস্যা তৈরি করেছে। হাসপাতালেও উৎসুক জনতা ভিড় দেখা গেছে। অথচ এই ধরনের দুর্ঘটনায় আহত ও দগ্ধদের নিবিড় ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা জরুরি। অব্যবস্থাপনার কারণে সামান্য দেরিও একজনের জীবন কেড়ে নিতে পারে।

দুর্ঘটনা যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—দুর্ঘটনার পর সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। কিছু দেশ প্রস্তুত থাকে, যাতে প্রাণহানি কমানো যায়, আর কিছু দেশে বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থা আর দায়িত্বহীনতার কারণে আরও বেশি ক্ষতি হয়।

পাইলট সালি বলেছিলেন, ‘১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে হাডসনে বিমান নামানোর পরেও কোনো প্রাণহানি না হওয়া কোনো অলৌকিকতা ছিল না। এটা ছিল সিস্টেম, বছরের পর বছর ট্রেনিং, প্রস্তুতি আর দায়িত্বশীলতার ফলাফল।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত