Ajker Patrika

বিবিসির প্রতিবেদন /অপরাধীরা বাইরে থাকায় আতঙ্কে আয়নাঘরের ভুক্তভোগীরা

অনলাইন ডেস্ক
বিবিসির তোলা ছবিতে গুম হওয়া বন্দীদের আটকে রাখার ছোট্ট কুঠুরিগুলোর ধ্বংসাবশেষ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বিবিসির তোলা ছবিতে গুম হওয়া বন্দীদের আটকে রাখার ছোট্ট কুঠুরিগুলোর ধ্বংসাবশেষ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা একটি দেয়াল ভেঙে গোপন কারাগারের সন্ধান পান তদন্তকারীরা। দেখা যায়, একটি দরজা নতুন করে ইট গেঁথে বন্ধ করা হয়েছে। পেছনে কিছু একটা আড়াল করার চেষ্টা যে ছিল তা স্পষ্ট। ভেতরে দেখা যায়, একটি সরু করিডর, যার ডান ও বাম পাশে অনেকগুলো ছোট কুঠুরি। কুঠুরিগুলো ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছেই এই গোপন কারাগারটি সম্ভবত কখনোই খুঁজে পাওয়া যেত না—সেখানে বন্দী থাকা মীর আহমেদ বিন কাসেম এবং অন্যদের স্মৃতি হয়তো অজানাই থেকে যেত! আহমেদ বিন কাসেম বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচক ছিলেন। এই বন্দীশালায় তাঁকে ৮ বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল।

কারাগারে থাকার সময় তাঁর চোখ প্রায় সব সময়ই বাঁধা থাকত। তাই তিনি বিভিন্ন দিক থেকে আসা শব্দের ভিত্তিতে তাঁর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি উড়োজাহাজ উঠানামার শব্দ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারতেন। এই সূত্র ধরেই তদন্তকারীরা বিমানবন্দরের কাছে এক বন্দীশালায় পৌঁছান। মূল ভবনের পেছনে তাঁরা একটি ছোট, কঠোর পাহারায় ঘেরা জানালাবিহীন কংক্রিটের অবকাঠামো খুঁজে পান। সেখানেই বন্দীদের রাখা হতো।

এটি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। তবে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তদন্তকারীরা কাসেমের মতো শত শত ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেন। এসব ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন বন্দীশালায় আটকে রাখা হয়েছিল। অভিযোগ, আরও অনেককে বেআইনিভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে ওই কারাগারসহ অন্যান্য গোপন কারাগার চালাতেন মূলত এলিট কাউন্টার–টেররিজম ইউনিট ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সদস্যরা। তাঁরা সরাসরি হাসিনার কাছ থেকে নির্দেশনা পেতেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি গুমের ঘটনা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই অনুমোদন, অনুমতি বা নির্দেশের মাধ্যমে করিয়েছিলেন।’ তবে হাসিনার দলের লোকদের দাবি, তাঁদের অজান্তে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর কোনো দায় তাঁরা নেবেন না। সামরিক বাহিনী একাই কাজ করেছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আহমেদ বিন কাসেম এবং অন্যরা মুক্তি পেয়েছেন ৭ মাসের বেশি সময় হলো, তবে এখনো তাঁদের আতঙ্ক কাটেনি। তাঁদের যারা গোপন কারাগারে রেখেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখনো নিরাপত্তা বাহিনীতে বহাল তবিয়তে কাজ করছেন এবং অনেকে এখনো মুক্ত।

আহমেদ বিন কাসেম জানান, এখন টুপি ও মাস্ক ছাড়া তিনি কখনই বাড়ির বাইরে যান না। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় বের হলে সব সময় আমাকে সাবধানে থাকতে হয়।’ কিছুদিন আগে তিনি বিবিসির দলটিকে সেই জায়গাটি দেখাতে নিয়ে যান, যেখানে তাঁকে রাখা হয়েছিল। ভারী ধাতব দরজা ঠেলে, মাথা নিচু করে আরেকটি সরু দরজা পেরিয়ে তিনি ‘তাঁর’ ঘরে প্রবেশ করেন। এই কুঠুরিতেই আট বছর বন্দী ছিলেন তিনি।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘মনে হতো, যেন জীবন্ত কবর, বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।’ সেখানে কোনো জানালা ছিল না, প্রাকৃতিক আলো আসার কোনো পথ ছিল না। ভেতরে থাকলে দিন-রাতের পার্থক্য বোঝা যেত না। চল্লিশের কোঠায় থাকা আইনজীবী আহমেদ বিন কাসেম এর আগেও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তবে এই প্রথম তিনি গণমাধ্যমকে সেই ছোট্ট কুঠুরির ভেতরটা বিস্তারিত দেখালেন, যেখানে তাঁকে বন্দী রাখা হয়েছিল।

টর্চের আলোয় দেখা যায়, ঘরটি এত ছোট যে—একজন গড় উচ্চতার মানুষের পক্ষেও সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন। ঘরটিতে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, দেয়ালের কিছু অংশ ভাঙা, ইট ও কংক্রিটের টুকরা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অপরাধের প্রমাণ ধ্বংস করার জন্য এটি ছিল শেষ চেষ্টা।

প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামও বিবিসির সঙ্গে ওই বন্দীশালা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এটি একটি বন্দিশালা। আমরা জানতে পেরেছি, সারা দেশে ৫০০,৬০০, ৭০০ টিরও বেশি কুঠুরি রয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, এটি ব্যাপক ও পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।’

আহমেদ বিন কাসেম তাঁর সেলের হালকা নীল রঙের টাইলসের কথাও স্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন। মেঝেতে ভাঙা টাইলসের টুকরোগুলো পড়ে ছিল। আর এর সাহায্যেই তদন্তকারীরা এই বিশেষ ঘরটি খুঁজে পান। নিচতলার সেলগুলোর তুলনায় এটি বেশ বড়, ১০ ফুট বাই ১৪ ফুট। একপাশে একটি নিচু টয়লেট রয়েছে।

সেই কষ্টের স্মৃতিচারণ করতে করতে আহমেদ বিন কাসেম ঘরের চারপাশে হেঁটে হেঁটে দেখান এবং বন্দী জীবনে কীভাবে সময় কাটিয়েছেন তা তুলে ধরেন। গ্রীষ্মকালে সেখানে অসহ্য গরম লাগত। তিনি মেঝেতে কুঁকড়ে বসে দরজার নিচের দিকে মুখ রাখতেন কিছুটা বাতাস পাওয়ার আশায়। তিনি বলেন, ‘মনে হতো মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ।’

নিজের দুঃসহ স্মৃতি পুনরাবৃত্তি করানোর বিষয়টিকে অনেকের কাছে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। কিন্তু আহমেদ বিন কাসেম মনে করেন, বিশ্বের মানুষের দেখা উচিত, কী করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যারা এই ফ্যাসিবাদী শাসনকে সাহায্য ও সমর্থন করেছে, সেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এখনো তাদের পদে বহাল আছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের (এখানকার) গল্প তুলে ধরা দরকার এবং যারা ফিরে আসেনি তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং যারা বেঁচে আছেন তাদের পুনর্বাসিত হতে সাহায্য করার জন্য আমাদের যা কিছু করার আছে তা করতে হবে।’

বিবিসির আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাঁকে ঢাকার প্রধান গোয়েন্দা সদর দপ্তরের ভেতরে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত এক কুখ্যাত বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল। তবে তদন্তকারীরা এখন মনে করছেন, এ ধরনের আরও অনেক কেন্দ্র ছিল। আহমেদ বিন কাসেম বিবিসিকে জানান, প্রথম ১৬ দিন ছাড়া বাকি পুরো সময় তিনি র‍্যাবের হেফাজতেই ছিলেন। তদন্তকারীরা এখন সন্দেহ করছেন, প্রথম স্থানটি ছিল ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি শাখা।

তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাঁকে গুম করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তিনি তাঁর বাবার পক্ষে আইনি লড়াই করছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নেতা। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং পরে ফাঁসি দেওয়া হয়।

আহমেদ বিন কাসেম ছাড়াও বিবিসি এমন বন্দীশালায় আটক থাকা আরও পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা জানান, তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে অন্ধকার কংক্রিটের কুঠুরিতে রাখা হয়েছিল। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁদের কোনো সংযোগ ছিল না। অনেকের অভিযোগ, তাঁদের মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছে।

বিবিসি এই ভুক্তভোগীদের বক্তব্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে না পারলেও, প্রায় সবাই বলেছেন—তাঁরা আতঙ্কিত যে, একদিন রাস্তায় বা বাসে তাঁদের নিপীড়নকারীদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। ৩৫ বছর বয়সী আতিকুর রহমান রাসেল বলেন, ‘এখন, যখনই আমি গাড়িতে উঠি বা বাড়িতে একা থাকি, তখন আমি যেখানে ছিলাম সেই কথা ভেবে ভয় লাগে। আমি ভাবি, আমি কীভাবে বেঁচে ছিলাম, আদৌ আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল কিনা।’

রাসেল জানান, তাঁর নাক ভেঙে গিয়েছিল এবং হাতে এখনো ব্যথা আছে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে হাতকড়া পরিয়ে অনেক মারধর করেছে।’ রাসেল জানান, গত জুলাইয়ে যখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছিল, তখন রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি মসজিদের বাইরে একদল লোক তাঁর কাছে আসে। তাঁরা নিজেদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য বলে পরিচয় দেয় এবং তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যেতে বলে।

এরপর তৎক্ষণাৎ তাঁকে একটি ধূসর গাড়িতে তোলা হয়, হাতকড়া পরানো হয়, মুখ ঢাকা হয় এবং চোখ বেঁধে দেওয়া হয়। ৪০ মিনিট পর তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি ভবনে নিয়ে একটি কামরায় রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রায় আধঘণ্টা পর একজন একজন করে লোকজন আসতে শুরু করে এবং প্রশ্ন করতে থাকে। আপনি কে? আপনি কী করেন?’ এরপর শুরু হয় মারধর।

রাসেল আরও বলেন, ‘ওই জায়গার ভেতরে থাকাটা ছিল ভীতিকর। আমার মনে হয়েছিল, আমি আর কখনোই বের হতে পারব না।’ রাসেল এখন তাঁর বোন ও বোনের স্বামীর সঙ্গে থাকেন। ঢাকার একটি ফ্ল্যাটে ডাইনিং চেয়ারে বসে তিনি তাঁর বন্দী জীবনের কয়েক সপ্তাহের বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি যখন কথা বলছিলেন তখন আবেগ চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন, যেন তাঁর নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই!

রাসেলও মনে করেন, তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই তাঁকে বন্দী করা হয়েছিল। তিনি হাসিনার দল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ছাত্রনেতা ছিলেন এবং তাঁর বাবা ছিলেন ওই দলের জ্যেষ্ঠ নেতা। বিদেশে থাকা তাঁর ভাই প্রায়শই হাসিনার সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতেন।

রাসেল জানান, তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছিল তা জানার কোনো উপায় ছিল না। তবে এ বছরের শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনটি বন্দিশালা পরিদর্শন করতে দেখার পর তিনি ধারণা করছেন, তাঁকে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় রাখা হয়েছিল।

এটি প্রায় প্রকাশ্যই ছিল যে, হাসিনা রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল ছিলেন না। সাবেক বন্দী, বিরোধী দল এবং তদন্তকারীদের মতে, তাঁর সমালোচনা করলে ‘গুম’ হয়ে যেতে হতো। তবে কত মানুষ গুম হয়েছেন তার মোট সংখ্যা কখনোই স্পষ্ট হবে না হয়তো।

একটি বাংলাদেশি এনজিও ২০০৯ সাল থেকে গুমের ঘটনা রেকর্ড করছে। তারা কমপক্ষে ৭০৯ জন ব্যক্তির গুম হওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। তাদের মধ্যে ১৫৫ জন এখনো নিখোঁজ। গত সেপ্টেম্বরে গুম তদন্ত কমিশন গঠনের পর থেকে তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৬৭৬ টিরও বেশি অভিযোগ পেয়েছে এবং আরও অনেকে এগিয়ে আসছেন নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে। তবে এটি মোট সংখ্যা নয়, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়।

আহমেদ বিন কাসেমের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমেই প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বন্দিশালার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের, এমনকি শেখ হাসিনাকেও অভিযুক্ত করার জন্য মামলার নথিপত্র প্রস্তুত করতে পারছেন। বিভিন্ন স্থানে বন্দী থাকলেও ভুক্তভোগীদের বর্ণনাগুলো আশ্চর্যজনকভাবে একই রকম।

হাসিনার দল আওয়ামী লীগের মুখপাত্র সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এসব গুমের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের কোনোভাবে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যদি কাউকে জোরপূর্বক গুম করা হয়ে থাকে, তবে তা হাসিনা—যিনি বর্তমানে ভারতে রয়েছেন—বা তাঁর মন্ত্রিসভার কারও নির্দেশে করা হয়নি।

আরাফাত বলেন, ‘যদি এ ধরনের কোনো আটক ঘটনা ঘটে থাকে, তবে তা জটিল অভ্যন্তরীণ সামরিক গতিবিধির ফলাফল হতে পারে। আমার মনে হয় না, আওয়ামী লীগ বা সরকারের কাছে এসব লোকদের গোপনে আটক রাখার কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আছে।’

সামরিক বাহিনীর প্রধান মুখপাত্রের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলেছে বিবিসি। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ বিবিসিকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী এ ধরনের কোনো বন্দিশালা পরিচালনার কথা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করছে।’

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম মনে করেন, এসব কারাগারে বন্দী থাকা ব্যক্তিরাই এসব গুমে আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘এখানে যাদের আটক করা হয়েছিল তারা সবাই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছিলেন এবং তাঁরা শুধু তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের কথা বলেছিলেন, আর সেই কারণেই তাঁদের এখানে আনা হয়েছিল।’

এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাউকে বিচারের আওতায় আনা যায়নি। এ কারণে ৭১ বছর বয়সী ইকবাল চৌধুরীর মতো ভুক্তভোগীরা মনে করেন, তাঁদের জীবন এখনো বিপন্ন। চৌধুরী বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চান। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর বহু বছর তিনি বাড়ি থেকে বের হননি, এমনকি বাজারেও যাননি। চৌধুরীকে যারা আটকে রেখেছিল, তারা তাঁকে মুখ না খোলার জন্য সতর্ক করেছিল।

ইকবাল চৌধুরী জানান, তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘যদি তুমি কখনো বলো তোমাকে কোথায় রাখা হয়েছিল বা কী ঘটেছিল, এবং যদি তোমাকে আবার ধরা হয় তবে তোমাকে আর কেউ খুঁজে পাবে না। তুমি এই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে!’

চৌধুরী বলেন, ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লেখার কারণে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে এবং মারধর করে নির্যাতন করা হয়েছিল। এখন বৈদ্যুতিক শকের কারণে আমার একটি আঙুল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমি পায়ের শক্তি হারিয়েছি, শারীরিক শক্তি হারিয়েছি।’ তিনি অন্যদের শারীরিক নির্যাতনের শব্দ, বয়স্ক পুরুষদের আর্তনাদ ও ব্যথায় কান্নার শব্দ মনে করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখনো ভয় পাচ্ছি।’

আয়নাঘরের আরেক ভুক্তভোগী ২৩ বছর বয়সী রহমতুল্লাহ। তিনিও আতঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘তারা আমার জীবনের দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। সেই সময় আর কখনোই ফিরে আসবে না। তারা আমাকে এমন এক জায়গায় ঘুমাতে বাধ্য করেছিল যেখানে কোনো মানুষের থাকা সম্ভব নয়।’

রহমতুল্লাহ জানান, ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট মধ্যরাতে র‍্যাব কর্মকর্তারা—যাদের মধ্যে কেউ ইউনিফর্ম পরা ছিলেন, কেউ সাদা পোশাকে—তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যান। তিনি পাশের শহরে বাবুর্চির কাজ করতেন এবং একই সঙ্গে ইলেকট্রিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বারবার জিজ্ঞাসাবাদের পর রহমতুল্লাহর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভারতবিরোধী এবং ইসলাম সম্পর্কিত সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছে।

একটি কলম ও কাগজ ব্যবহার করে তিনি তাঁর সেলের নকশা আঁকেন, যার মধ্যে খোলা ড্রেনটিও রয়েছে, যা তিনি মলত্যাগের জন্য ব্যবহার করতেন।

রহমতুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকার সেই জায়গার কথা ভাবলেও আমার খারাপ লাগে। সেখানে ঠিকমতো শোয়ার জায়গাও ছিল না, তাই আমাকে কুঁকড়ে শুতে হতো। শুয়ে পা মেলে দিতে পারতাম না।’

বিবিসি মাইকেল চাকমা ও মাসরুর আনোয়ার নামে আরও দুই সাবেক বন্দীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। অনেক ভুক্তভোগীর শরীরে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। তারা সবাই সেই মানসিক যন্ত্রণার কথা বলেছেন, যা তাঁদের সার্বক্ষণিক তাড়িয়ে বেড়ায়।

দীর্ঘ দিনের স্বৈরশাসনের পর বাংলাদেশ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। গণতন্ত্রের দিকে দেশের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে এসব অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার করার সক্ষমতা। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এটি সম্ভব এবং তা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে এবং আমাদের ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার করতে হবে। তারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।’

নিজেকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেই কংক্রিটের সেলের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আহমেদ বিন কাসেম বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিচার হওয়া উচিত, যাতে এই অধ্যায়টি শেষ হতে পারে। কিন্তু রহমতুল্লাহর জন্য বিষয়টি এত সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘ভয় এখনো যায়নি। এই ভয় আমার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত থাকবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল দিল্লি

‘ক্রিকেটাররা আমাকে ন্যুড পাঠাত’, বিস্ফোরক ভারতের সাবেক কোচের সন্তান

‘শেখ হাসিনা আসবে, বাংলাদেশ হাসবে’ ব্যানারে বিমানবন্দর এলাকায় আ.লীগের মিছিল

নালিতাবাড়ীতে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে যুবক আটক

পারদর্শী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ, স্থিতিশীল হচ্ছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক: ভারতীয় বিশেষজ্ঞ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত