Ajker Patrika

৪২৫ টাকায় কেনা টিকা খরচ ৩০০০ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২১, ১১: ৪৩
Thumbnail image

করোনার টিকার প্রতি ডোজের জন্য খরচ হয়েছে ৩ হাজার টাকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। তবে গত জুন পর্যন্ত ব্যবহৃত করোনার টিকার একটা বড় অংশ এসেছে উপহার হিসেবে। আর কেনা টিকার প্রায় পুরোটাই এসেছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই জানিয়েছিল, সেরামের টিকার প্রতি ডোজ কেনা, পরিবহন ও আনুষঙ্গিক সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৫ ডলার বা ৪২৫ টাকা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই এখন প্রতি ডোজে ৩ হাজার টাকা খরচ নিয়ে বিভ্রান্ত। তাঁরা বলছেন, টিকা কেনার জন্য বিভিন্ন দেশ বা সংস্থাকে অগ্রিম যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা–ও হয়তো এই হিসাবের মধ্যে চলে এসেছে। না হলে এত বেশি খরচ কীভাবে হলো, তা তারা মেলাতে পারছেন না।

জানতে চাইলে চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর মন্ত্রণালয়ের লোকজন অঙ্ক জানে না, নয়তো তারা মনে করেছেন যে দেশে সব মানুষ অশিক্ষিত, কেউ অঙ্ক কষতে জানে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটা হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।’

বিভিন্ন দৈনিকে ৯ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ করোনার টিকা কিনেছে। এতে বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডোজ ৩ হাজার টাকা। যদিও চলতি বছরের ১০ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ টিকা কিনেছে মোট ৯০ লাখ।

 স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ১ কোটি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮২ ডোজ করোনার টিকা ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১ কোটি ১ লাখ ৫ হাজার ৯৪৯টি, চীনের সিনোফার্মের ৪৬ হাজার ৮৯৩টি এবং কোভ্যাক্সের আওতায় আসা ফাইজারের ২৪০টি টিকা ব্যবহার করা হয়েছে। 
গত বছরের নভেম্বরে ৩ কোটি টিকা কিনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও বেক্সিমকোর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী প্রতি মাসে সেরামের ৫০ লাখ ডোজ করে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে সেরাম দুই দফায় ৭০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। যা কিনতে খরচ হয়েছে ২৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের উপহারসহ বিভিন্নভাবে এসেছে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড টিকা এসেছে ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ।

এর বাইরে কোভ্যাক্স থেকে বিনা মূল্যে ফাইজারের ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা এসেছে। সেই সঙ্গে চলতি মাসে কোভ্যাক্স থেকে এসেছে মডার্নার ২৫ লাখ টিকা। আর চীন থেকে দুই দফায় সিনোফার্মের ১১ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে এসেছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ২০ লাখ টিকা বাংলাদেশে এসেছে। এর দাম প্রতি ডোজ ১০ ডলার বলে জানিয়েছিলেন এক সরকারি কর্মকর্তা। পরে অবশ্য চীন এই দামের বিষয়টি অস্বীকার করে। এরপর থেকে চীন বা রাশিয়া থেকে কত দামে টিকা কেনা হচ্ছে, তা সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেনা টিকার যে হিসাব দিয়েছে, তার মধ্যে উপহারের টিকাও আছে। টিকার পরিমাণ ও দাম নিয়ে ৩০ জুন সংসদে দেওয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হিসাবের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে আগের কিছু টিকা কেনা রয়েছে। আরও টিকা কেনার জন্য অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এখানে সেই হিসাবটি দেখানো হয়েছে।’

টিকার পরিমাণ ও দামের এ ব্যাখ্যা জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তা টিকার প্রসঙ্গ শুনে ফোন কেটে দেন। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন বলেন, টিকা তো ভারতের সেরাম থেকেও অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে ৩ কোটি কেনা হয়েছে। আর চীন থেকেও দেড় কোটি টিকা কেনা হয়েছে। সেই সঙ্গে কোভ্যাক্সেও অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। সেই টিকা কেন হিসাবে আনা হলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ওই কর্মকর্তা। 
নাম না প্রকাশ করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, চীনের টিকা নিয়ে আসার জন্য বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ পাঠানো হয়েছিল। ফলে চীনের উপহার দেওয়া টিকাতেও কিছু অর্থ খরচ হয়েছে। তাই বলে প্রতি ডোজে ৩ হাজার টাকা হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাকি টিকার দাম কী কারণে এ রকম নির্ধারণ করা হলো, তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই ভালো বলতে পারবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে করোনাভাইরাসের যে টিকা কিনছে, তাতে প্রতিটি ডোজের দাম পড়বে ৪ ডলার বা ৩৪০ টাকার মতো। তবে টিকা পরিবহনসহ সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ৫ ডলার। খরচ প্রসঙ্গে আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘ওরা ডোজপ্রতি চার ডলার করে নিচ্ছে আর টিকা আনার খরচ, শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদির খরচের জন্য বেক্সিমকো নেবে ডোজপ্রতি এক ডলার করে।’ 
ফলে গত ৩০ জুনের হিসাব পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবহার করা টিকার মধ্যে ৭০ লাখ টিকা বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রতি ডোজ কিনেছে ৪ ডলার বা ৩৪০ টাকা (ডলার মূল্য ৮৫ টাকা ধরে) করে। আর এর পরিবহন ও সংরক্ষণে ১ ডলার ধরে টিকার মোট দাম হওয়ার কথা ৫ ডলার বা ৪২৫ টাকা। আর ৫ ডলার হিসাবে ৭০ লাখ টিকা কিনতে বাংলাদেশের খরচ হওয়ার কথা ২৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

টিকার দাম নিয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে–নজির আহমেদ বলেন, ‘এই খরচটা অস্বাভাবিক। যদিও আমরা ধরে নিই যে টিকাদানকর্মী, টিকা পরিবহন, অবকাঠামোসহ এই খরচ হয়েছে, তবু এটা অস্বাভাবিক। এত খরচ হওয়ার কথা নয়। কারণ, টিকাদানে জড়িত স্বেচ্ছাসেবক বা অন্যদের যে টাকাটা দেওয়া হয়, সেটা অতি নগণ্য। আমরা যদি টিকার দামের সঙ্গে পরিবহন এবং আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করে চিন্তা করি, তবু ডোজপ্রতি এত খরচ হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক। জাতির সামনে এর ব্যাখ্যা তাদের তুলে ধরা উচিত।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত