Ajker Patrika

বাইনদের ঘরের কান্না কানে আসছে না

নাজমুল হাসান সাগর, ঢাকা
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১১: ৩৩
বাইনদের ঘরের কান্না কানে আসছে না

প্রাচীরঘেরা একতলা বাড়ি। ভেতরে সুনসান নীরবতা। বড় বড় তিনটি ঘর। পেছনে ফাঁকা জায়গা। বড় জানালা থাকায় ঘরে আলো-বাতাসের কমতি নেই। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতে চোখে পড়ল জানালার কাছে সোফায় গা এলিয়ে রোদ পোহাচ্ছেন এক বৃদ্ধ। অপরিচিত মুখ দেখে শরীর টেনে টেনে সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রাথমিক পরিচয় শেষে ডাকলেন ভেতরে।

৮০ ছুঁই ছুঁই এই ব্যক্তির নাম বিপুল বাইন। বাইন কি পরিচিত লাগছে? ঢাকার অপরাধজগতে বাইন নামটি শুধু পরিচিত বললে ভুল হবে, বরং বলা যায় অতিপরিচিত। এবার পুরো নামটি শুনুন, ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। পুলিশের তালিকার শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাঁরই বাবা এই বিপুল বাইন। ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডে সেভেন স্টার গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুব্রতর নামে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ছিল কমপক্ষে ৩০টি মামলা। ২১ বছর ধরে দেশ থেকে পলাতক ও ১০ বছর ধরে কলকাতার কারাগারে বন্দী এই শীর্ষ সন্ত্রাসী।

একসময় রাজধানীর মগবাজার এলাকায় থাকলেও ৩০ বছর ধরে সুব্রতর পরিবারের বসবাস গাজীপুরের টঙ্গীর অদূরে মরকুম হারবাইদ এলাকায় নিজস্ব বাড়িতে। ওই বাড়িতে থাকেন বিপুল বাইন ও তাঁর স্ত্রী কমলিনী বাইন। বার্ধক্য জেঁকে বসেছে বিপুল বাইনের শরীরে।

দুর্বলতা, শরীর ব্যথাসহ নানা শারীরিক জটিলতা। কমে গেছে স্মৃতিশক্তিও। কমলিনী বাইন কয়েক মাস ধরে শয্যাশায়ী। পাশের ঘরে দেখা যায় বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। চোখ বন্ধ, নড়াচড়া নেই। জানা গেল, তাঁর সুস্থতার জন্য মাস দুয়েক আগে খ্রিষ্ট ধর্মমতে অন্তিমলগ্ন বা বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছিল। 
ওই বাড়ির পাশেই স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন বিপুল বাইনের বড় মেয়ে মেরি বাইন ও মেজো মেয়ে চেরি সুপর্ণা বাইন। জমিজমা নিয়ে বিরোধ থাকায় ছোট মেয়ে সুপ্রভা পরির সঙ্গে পরিবারের কারও যোগাযোগ নেই। চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে সুব্রত সবার বড়।

কমলিনী অসুস্থ থাকায় ওই বাড়িতে চুলা জ্বলে না কয়েক মাস। বড় ও মেজো মেয়ের বাড়ি থেকেই আসে খাবার। দেখভালও করেন তাঁরা। চিকিৎসা আর ওষুধের টাকার জোগানও দেন দুই বোন।

ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমে আগ্রহ দেখালেন না বিপুল বাইন। পরে নিজে থেকেই বললেন, ‘তার সঙ্গে এখন কোনো যোগাযোগ নেই। আট-নয় মাস আগে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল। বছরখানেক আগে গেছিলাম কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে সুব্রতর বাড়িতে। কয়েক দিন থাইকা আসছি।’ আর কিছু বললেন না এই বাবা। 
বিছানায় পড়ার আগে সুব্রত বাইনের সঙ্গে কথা বলার আকুতি জানিয়েছিলেন কমলিনী—এমনটা জানালেন চেরির স্বামী অতুল পিরিচ। তাঁর দাবি, প্রায় দুই বছর সুব্রত কোনো যোগাযোগ করে না। বেঁচে আছে, না মরে গেছে তাঁরা সেটাও জানেন না। মায়ের অসুস্থতার কথা জানানোর কোনো পথ পাচ্ছেন না তাঁরা।
কিন্তু বিপুল বাইন তো বলেছেন, আট-নয় মাস আগেও নাকি কথা হয়েছে। বিষয়টি অস্বীকার করে অতুল বলেন, ‘তাঁর (সুব্রত) মায়ের জন্য একটা ফোন যদি পাইতাম কোথাও থাইকা। এই অবস্থায় আছি আমরা।’

অতুল পিরিচ জানান, ভারতে গিয়ে মুসলিম হওয়ার পর থেকে সুব্রতর সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমে যায়। মেরিকেই ফোন দিতেন বেশি। তবে শুক্রবার হলে ফোন দিতেন চেরিকে। জমিজমা নিয়ে বিরোধের আগে ছোট বোন পরির সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ করতেন। কিন্তু দুই বছর আগে জমিজমা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বিরোধ হলে নিজের সবকিছু বিক্রি করে পরি এখান থেকে চলে গেছেন। তাঁর সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই।

আট-নয় মাস আগে মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর কিংবা মাঝরাতে সুব্রতদের বাড়ি থেকে নারীকণ্ঠে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে অস্পষ্ট কথার আওয়াজ পাওয়ার কথা জানান কয়েকজন প্রতিবেশী। তাঁদের অনুমান, ফোনে ছেলের সঙ্গে তখন কথা বলতেন কমলিনী। কানে আসত ছেলেকে দেখার আকুতি।

সুব্রত বাইনের প্রথম স্ত্রী ছিলেন লুসি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে একটি মামলায় সুব্রত কারাগারে থাকার সময় লুসি তাঁর দলের এক যুবকের প্রেমে পড়েন। প্রায় দেড় বছর পর কারাগার থেকে বেরিয়ে ঘটনা জানার পর তিনি নিজেই লুসিকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। লুসির ঘরে সুব্রতর দুই সন্তান ছিল। তারপর কুমিল্লায় বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। তবে কয়েক বছর পর তাঁকে তালাক দেন। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় প্রথম নামটিই ছিল সুব্রত বাইনের। এর পরই দেশ থেকে পালান তিনি। মোহাম্মদ ফতেহ আলী নামে ঘাঁটি গাড়েন কলকাতায়। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলাকে বিয়ে করেন। সেই ঘরেও একটি মেয়ে আছে।

ঢাকায় একসময় অঢেল অর্থবিত্ত ছিল সুব্রতর। তাঁর পরিবার বলেছে, সেই সব ভোগ করছে প্রথম স্ত্রীর ঘরের দুই সন্তান। তবে তারা সুব্রতর বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিতে আসে না।

কথা হয় সুব্রত বাইনদের প্রতিবেশী রায়হানের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটা সময় পর্যন্ত সুব্রতর ছেলে-মেয়ে এখানে আসত। কয়েক দিন থাকত। ছেলেটা প্রতিবন্ধী। তবে তাদের মা (লুসি) কখনো আসেননি। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রায়ই এলাকায় এসে সুব্রত সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন। একসময় সুব্রতর ব্যাপক প্রভাব থাকলেও এখন নাম উচ্চারণ হয় কালেভদ্রে।

চোখ-মুখে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে রায়হান বলেন, দুনিয়ায় যার যত প্রভাবই থাকুক, উপরওয়ালার কাছে সে কিছুই না। দুনিয়ায় থাকতেই তার পাপের শাস্তি পায়। 
সুব্রতদের বাড়ির সামনে দিয়ে ফেরার সময় কাঁচা হলুদ রঙের বাড়ির দরজায় আবার দেখা বিপুল বাইনের সঙ্গে। ছলছল চোখে অপলক তাকিয়ে ছিলেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত