Ajker Patrika

ছাতিমের শহরে ভূতের ভয় নেই

রিমন রহমান, রাজশাহী
Thumbnail image

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’তে ছাতিম ফুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, তার আবেশ পাওয়া যাচ্ছে রাজশাহীতে। কদিন ধরে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে এ শহরে সৌরভ ছড়াচ্ছে ছাতিম। এখন ছাতিম ফুলের গন্ধে অনেকে বের হচ্ছেন ঘর থেকে। সন্ধ্যার পর ছাতার মতো ছাতিমগাছের নিচে বসে এর সুবাসে উন্মনা হচ্ছেন অনেকে।

অথচ গ্রামে ভূতের ভয়ে অনেকে যান না ছাতিমতলায়। ছাতিমগাছ আর বিভিন্ন প্রজাতির ভূতের নামে কত গল্প যে ছড়িয়ে আছে! কিন্তু রাজশাহী শহরে বরং ছাতিমগাছ দেখতে বেরিয়ে পড়ছেন অনেকে।

নানা কারণে গ্রামে এ গাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে। তবে এ শহরে এই গাছ ছড়িয়ে দিয়েছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন বা রাসিক। রাসিককে রসিক বলাই যায়। প্রতিষ্ঠানটি শহরের ফুটপাতে ২০১৯ সালে ছাতিমগাছ লাগানো শুরু করে। নগরের রেলগেট-সিটি বাইপাস সড়ক, বিলশিমলা-সিঅ্যান্ডবি মোড়, উপশহর, সপুরাসহ বিভিন্ন সড়কে প্রায় ৫০০ ছাতিমগাছ লাগানো হয় ওই সময়। গাছগুলো এখন বেশ বড়। ঝাঁকড়া পত্রপল্লব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাতার মতো।

রাজশাহী শহরের রেলগেট থেকে সিঅ্যান্ডবি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতে আছে ৩০০টি ছাতিমগাছ। এখন শাখা-প্রশাখায় ভরা পাতার মাঝে থোকায় থোকায় ফুটেছে সবুজাভ ফুল। এসব ফুল যেন শিশি উপুড় করে সন্ধ্যার বাতাসে ঢেলে দিচ্ছে মিষ্টি গন্ধ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ফুলের গন্ধ আরও তীব্র আর মাদকতাময় হয়ে ওঠে।

এই ছাতিম ফুলের গন্ধে ‘পাগল’ হয়ে সমরেশ মজুমদার একবার কলকাতা সিটি করপোরেশনে গিয়েছিলেন। নালিশ করেছিলেন, ঘরের পাশে থাকা সরকারি গাছটাতে ফুল ফুটলেই তীব্র গন্ধে তাঁর নাক জ্বলে। খুব কাছে থাকার কারণে ফুলের গন্ধে সমস্যায় পড়েছিলেন লেখক। অবশ্য এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি রাজশাহী সিটি করপোরেশনকে; বরং শহরজুড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ছাতিমগাছ লাগানোয় প্রশংসা পাচ্ছে নগর সংস্থা।

সাইদ সাদমান রাহুল নামের এক শিক্ষার্থী বললেন, বাংলাদেশের অন্য কোনো শহরে কিন্তু আপনি এভাবে সারি সারি ছাতিমগাছ পাবেন না। সন্ধ্যার পর আপনি যদি বের হন, তাহলে পুরো রাজশাহীতেই ছাতিমের সুবাস পাওয়া যায়। আপনার মন বিমোহিত করে তুলবে এর সুবাস।

ছাতিমগাছ কোনো এলাকায় ছাতিয়াম, কোথাও আবার ছাইতন নামে পরিচিত। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে গাছটি ছাতিম নামেই বেশি পরিচিত। এই ছাতিম ফুলের পাগল করা ম-ম গন্ধে মানুষ বিমোহিত হলেও গাছটির কিছুটা বদনামও আছে। এ গাছে নাকি ভূত থাকে! পশ্চিমা বিশ্বে গাছটিকে ডাকা হয় ‘ডেভিলস ট্রি’ নামে। যদিও এ গাছ মানুষের নানা উপকারে আসে।

7ছাতিমের কষ অনেকে ওষুধ হিসেবে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে থাকেন। গ্রামাঞ্চলে এখনো জ্বর, কুষ্ঠ, চর্মরোগ, যকৃতে ব্যথা, কাশি, দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া, হাঁপানি, বাতব্যথাসহ নানান শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় ছাতিমগাছের বাকল, পাতা ও কষ ব্যবহার করা হয়। ছাতিমের কাঠ দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন আসবাব। পেনসিল ও দেশলাইয়ের কাঠিও তৈরি হয় এই গাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাতিমগাছ এবং এর ফুল খুব পছন্দ করতেন। তাই শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে ছাতিম ফুলের পাতা উপহার দেওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ওই যে ছাতিমগাছের মতোই আছি...।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ছাতিমের সুবাস নিয়ে হইচই। অনেকে ছাতিমতলায় গিয়ে বসে থাকছেন। ছবি তুলছেন। ভিডিও করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন নেট দুনিয়ায়। এতে রাজশাহী এবার পরিচিত হচ্ছে ছাতিমের শহর হিসেবে। বিষয়টি নিয়ে খুশি রাজশাহী সিটি করপোরেশনও।

এ নিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অপুর কথাও বললেন সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর। তিনি বললেন, ‘রাজশাহী শহরে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়ণ করা হয়েছে। এখন ছাতিমগাছের কাছ দিয়ে গেলে সুবাসে মনটা ভালো হয়ে যায়। আমরা তো নানান দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যাই, তারপরও ‘পথের পাঁচালী’র অপুর সেই ছাতিম ফুলের গন্ধ আমাদের মন ভালো করে দেয়। এ রকম আরও পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগিয়ে আমরা পুরো শহরটাকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিতে চাই।’

তবে ছাতিমতলায় যাওয়ার জন্য একটুখানি সতর্কতা অবশ্য অবলম্বন করতে হয়। ভূত না থাক, ছাতিম ফুলের রেণু কারও কারও তীব্র অ্যালার্জি তৈরি করতে পারে। সে কারণে যাদের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে, তাদের জন্য ছাতিমগাছ সত্যিকার অর্থেই ডেভিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত