Ajker Patrika

এভারেস্টের কোল ঘেঁষে

শায়লা বিথী
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২২, ০৮: ৩৭
এভারেস্টের কোল ঘেঁষে

রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোয় এগিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। তিন অভিযাত্রী ও তিনজন গাইড মিলে আমরা মোট ছয়জন। রোদ উঠলে ঠান্ডা কিছুটা কমে আসবে বলে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করছি। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম সবাই। ১৭ মে রাত ২টা ৩০ মিনিটে আমরা লাকপারি পর্বতচূড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।

আলো ফুটলে চোখের সামনে লাফিয়ে এল লাকপারি পর্বত। মনে হচ্ছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। সূয্যিমামা উঠি উঠি করছে। সবার সামনে আমাদের প্রধান গাইড দাওয়া শেরপা, তাঁর পেছনে আমরা সবাই। মেইন রোপে বাঁধা অবস্থায় হাঁটছি। হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বুকসমান বরফের মধ্যে। আমি একটা লুকায়িত বরফের ফাটলে পড়ে গিয়েছি। রোপে টান পড়লে সামনের সহযাত্রী দুজন দাঁড়িয়ে পড়েন। বাকিরা কাছে এলেন না। প্রধান গাইড খুব সতর্কতার সঙ্গে আমার কাছে এসে একা ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে বললেন। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ওপরে তুলতে পারলাম না। পরে তিনি অনেক চেষ্টা করে আমাকে টেনে তুলে জানতে চাইলেন, ভয় পেয়েছি কি না! প্রচণ্ড ভয় পেলেও হাসিমুখে উত্তর দিলাম, পাইনি। এর পর থেকে সবাই ভীষণ সচেতনতার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলেছি, পথ আর শেষ হয় না। অথচ লাকপারি একদম নাক বরাবর। কতবার এমন হয়েছে, আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, আর ওপরে এগোব না। কিন্তু সহযাত্রীরা বরাবরই উৎসাহ দিচ্ছিল সামনে এগোনোর জন্য।

২৩ হাজার ১১৩ ফুট উচ্চতার লাকপারি পর্বত অভিযানের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ ছিল এভারেস্টকে কাছ থেকে দেখা। তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট ও লাকপারি পর্বতের বেসক্যাম্প, মিডল ক্যাম্প এবং অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প একই। তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প গাড়িতে করেই যাওয়া যায়। আমরা নেপালের থামেল থেকে নেপাল-চায়না বর্ডারে রসুয়াগাডি যাই। সেখান থেকে পরের দিন তিব্বতের কেরুং শহরে। সেখানে এক দিন থেকে তিব্বতের তিংড়ি নামে অন্য একটি শহরে যাই। সেখানেও এক দিন কাটাই আমরা। এই চার দিনে খুব সামান্য হলেও ছোটবেলায় বইয়ে পড়া নিষিদ্ধ শহর তিব্বতে ঘোরার সুযোগ হয়েছে। তিংড়িতে আমরা কিছু তিব্বতি গ্রামের দেখা পেয়েছিলাম।

আমরা ৮ মে দুপুর ১২টা নাগাদ বেসক্যাম্প পৌঁছে যাই। কী চমৎকার আবহাওয়া ছিল সেদিন! আশপাশে শত শত তাঁবু। বিশাল ময়দানের মতো একটা জায়গায় যেন মেলা বসেছে। সবাই এভারেস্ট অভিযানে এসেছে। আমরাই শুধু লাকপারি অভিযানে এসেছি। সেখানে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে খাবারের তাঁবুতে গিয়ে এভারেস্ট অভিযাত্রী তিন পোলিশ ও এক ভারতীয় পর্বতারোহীর সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রায় মাসখানেক আগে তাঁরা এসেছেন এভারেস্ট অভিযানে।

চতুর্থ দিন আমরা এভারেস্ট মিডল ক্যাম্পে পৌঁছাই। পরদিন এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে পৌঁছে যাই। সেখানে আরও তিন দিন কাটিয়ে মূল অভিযান।

২.বেলা প্রায় ৩টা। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা একটানা হেঁটে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩ হাজার ১১৩ ফুট উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন ঠিক কোন অনুভূতি হয়েছিল তা আজ আর মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি লাকপারির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। তবে সত্যি বলতে, ভীষণ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিলাম তখন। তাঁবুতে ফিরে বিশ্রাম আর খাবারের কথা মনে হচ্ছিল বারবার।

মনের মধ্যে যখন এসব এলোমেলো ভাবনা খেলা করছিল, তখনই ভ্রম ভাঙালেন দাওয়া শেরপা। বললেন, তাড়াতাড়ি ছবি তোলো, ফিরতে হবে দ্রুত। এই দীর্ঘ পথ ফিরতে হবে ভেবে আমার চিন্তা বেড়ে গেল। সকালের সেই ক্রেভাসে পড়ে যাওয়ার ঘটনা সারা দিন মাথায় গেঁথে ছিল। আবার সেই পথে ফিরতে হবে মনে করেই পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল।

লাকপারির চূড়ায় আধা ঘণ্টার মতো থেকে আমরা ফিরতি পথ ধরি। রাত সাড়ে ৯টার অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প পৌঁছাই। এই ফেরার পথটুকু আমি কীভাবে হেঁটেছি, মনে নেই। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছি। সর্বশেষ যখন তাঁবুতে পা রাখলাম, আমি কিছু সময়ের মতো অবচেতন ছিলাম। আমার ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে, কোনো এক শেরপা দ্রুত আমার শরীর থেকে হার্নেস সেট, আইস বুট আর উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট খুলে দিচ্ছেন। কেউ একজন গরম পানি হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন খাওয়ার জন্য। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লেগেছিল আমার। এখনো সেই ঘোর চোখে-মুখে লেগে আছে। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

লেখক: পর্যটক ও পর্বতারোহী, ঢাকা ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত