শায়লা বিথী
রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোয় এগিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। তিন অভিযাত্রী ও তিনজন গাইড মিলে আমরা মোট ছয়জন। রোদ উঠলে ঠান্ডা কিছুটা কমে আসবে বলে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করছি। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম সবাই। ১৭ মে রাত ২টা ৩০ মিনিটে আমরা লাকপারি পর্বতচূড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।
আলো ফুটলে চোখের সামনে লাফিয়ে এল লাকপারি পর্বত। মনে হচ্ছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। সূয্যিমামা উঠি উঠি করছে। সবার সামনে আমাদের প্রধান গাইড দাওয়া শেরপা, তাঁর পেছনে আমরা সবাই। মেইন রোপে বাঁধা অবস্থায় হাঁটছি। হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বুকসমান বরফের মধ্যে। আমি একটা লুকায়িত বরফের ফাটলে পড়ে গিয়েছি। রোপে টান পড়লে সামনের সহযাত্রী দুজন দাঁড়িয়ে পড়েন। বাকিরা কাছে এলেন না। প্রধান গাইড খুব সতর্কতার সঙ্গে আমার কাছে এসে একা ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে বললেন। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ওপরে তুলতে পারলাম না। পরে তিনি অনেক চেষ্টা করে আমাকে টেনে তুলে জানতে চাইলেন, ভয় পেয়েছি কি না! প্রচণ্ড ভয় পেলেও হাসিমুখে উত্তর দিলাম, পাইনি। এর পর থেকে সবাই ভীষণ সচেতনতার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলেছি, পথ আর শেষ হয় না। অথচ লাকপারি একদম নাক বরাবর। কতবার এমন হয়েছে, আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, আর ওপরে এগোব না। কিন্তু সহযাত্রীরা বরাবরই উৎসাহ দিচ্ছিল সামনে এগোনোর জন্য।
২৩ হাজার ১১৩ ফুট উচ্চতার লাকপারি পর্বত অভিযানের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ ছিল এভারেস্টকে কাছ থেকে দেখা। তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট ও লাকপারি পর্বতের বেসক্যাম্প, মিডল ক্যাম্প এবং অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প একই। তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প গাড়িতে করেই যাওয়া যায়। আমরা নেপালের থামেল থেকে নেপাল-চায়না বর্ডারে রসুয়াগাডি যাই। সেখান থেকে পরের দিন তিব্বতের কেরুং শহরে। সেখানে এক দিন থেকে তিব্বতের তিংড়ি নামে অন্য একটি শহরে যাই। সেখানেও এক দিন কাটাই আমরা। এই চার দিনে খুব সামান্য হলেও ছোটবেলায় বইয়ে পড়া নিষিদ্ধ শহর তিব্বতে ঘোরার সুযোগ হয়েছে। তিংড়িতে আমরা কিছু তিব্বতি গ্রামের দেখা পেয়েছিলাম।
আমরা ৮ মে দুপুর ১২টা নাগাদ বেসক্যাম্প পৌঁছে যাই। কী চমৎকার আবহাওয়া ছিল সেদিন! আশপাশে শত শত তাঁবু। বিশাল ময়দানের মতো একটা জায়গায় যেন মেলা বসেছে। সবাই এভারেস্ট অভিযানে এসেছে। আমরাই শুধু লাকপারি অভিযানে এসেছি। সেখানে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে খাবারের তাঁবুতে গিয়ে এভারেস্ট অভিযাত্রী তিন পোলিশ ও এক ভারতীয় পর্বতারোহীর সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রায় মাসখানেক আগে তাঁরা এসেছেন এভারেস্ট অভিযানে।
চতুর্থ দিন আমরা এভারেস্ট মিডল ক্যাম্পে পৌঁছাই। পরদিন এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে পৌঁছে যাই। সেখানে আরও তিন দিন কাটিয়ে মূল অভিযান।
২.বেলা প্রায় ৩টা। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা একটানা হেঁটে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩ হাজার ১১৩ ফুট উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন ঠিক কোন অনুভূতি হয়েছিল তা আজ আর মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি লাকপারির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। তবে সত্যি বলতে, ভীষণ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিলাম তখন। তাঁবুতে ফিরে বিশ্রাম আর খাবারের কথা মনে হচ্ছিল বারবার।
মনের মধ্যে যখন এসব এলোমেলো ভাবনা খেলা করছিল, তখনই ভ্রম ভাঙালেন দাওয়া শেরপা। বললেন, তাড়াতাড়ি ছবি তোলো, ফিরতে হবে দ্রুত। এই দীর্ঘ পথ ফিরতে হবে ভেবে আমার চিন্তা বেড়ে গেল। সকালের সেই ক্রেভাসে পড়ে যাওয়ার ঘটনা সারা দিন মাথায় গেঁথে ছিল। আবার সেই পথে ফিরতে হবে মনে করেই পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল।
লাকপারির চূড়ায় আধা ঘণ্টার মতো থেকে আমরা ফিরতি পথ ধরি। রাত সাড়ে ৯টার অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প পৌঁছাই। এই ফেরার পথটুকু আমি কীভাবে হেঁটেছি, মনে নেই। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছি। সর্বশেষ যখন তাঁবুতে পা রাখলাম, আমি কিছু সময়ের মতো অবচেতন ছিলাম। আমার ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে, কোনো এক শেরপা দ্রুত আমার শরীর থেকে হার্নেস সেট, আইস বুট আর উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট খুলে দিচ্ছেন। কেউ একজন গরম পানি হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন খাওয়ার জন্য। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লেগেছিল আমার। এখনো সেই ঘোর চোখে-মুখে লেগে আছে। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
লেখক: পর্যটক ও পর্বতারোহী, ঢাকা ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব
রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোয় এগিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। তিন অভিযাত্রী ও তিনজন গাইড মিলে আমরা মোট ছয়জন। রোদ উঠলে ঠান্ডা কিছুটা কমে আসবে বলে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করছি। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম সবাই। ১৭ মে রাত ২টা ৩০ মিনিটে আমরা লাকপারি পর্বতচূড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।
আলো ফুটলে চোখের সামনে লাফিয়ে এল লাকপারি পর্বত। মনে হচ্ছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। সূয্যিমামা উঠি উঠি করছে। সবার সামনে আমাদের প্রধান গাইড দাওয়া শেরপা, তাঁর পেছনে আমরা সবাই। মেইন রোপে বাঁধা অবস্থায় হাঁটছি। হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বুকসমান বরফের মধ্যে। আমি একটা লুকায়িত বরফের ফাটলে পড়ে গিয়েছি। রোপে টান পড়লে সামনের সহযাত্রী দুজন দাঁড়িয়ে পড়েন। বাকিরা কাছে এলেন না। প্রধান গাইড খুব সতর্কতার সঙ্গে আমার কাছে এসে একা ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে বললেন। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ওপরে তুলতে পারলাম না। পরে তিনি অনেক চেষ্টা করে আমাকে টেনে তুলে জানতে চাইলেন, ভয় পেয়েছি কি না! প্রচণ্ড ভয় পেলেও হাসিমুখে উত্তর দিলাম, পাইনি। এর পর থেকে সবাই ভীষণ সচেতনতার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলেছি, পথ আর শেষ হয় না। অথচ লাকপারি একদম নাক বরাবর। কতবার এমন হয়েছে, আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, আর ওপরে এগোব না। কিন্তু সহযাত্রীরা বরাবরই উৎসাহ দিচ্ছিল সামনে এগোনোর জন্য।
২৩ হাজার ১১৩ ফুট উচ্চতার লাকপারি পর্বত অভিযানের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ ছিল এভারেস্টকে কাছ থেকে দেখা। তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট ও লাকপারি পর্বতের বেসক্যাম্প, মিডল ক্যাম্প এবং অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প একই। তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প গাড়িতে করেই যাওয়া যায়। আমরা নেপালের থামেল থেকে নেপাল-চায়না বর্ডারে রসুয়াগাডি যাই। সেখান থেকে পরের দিন তিব্বতের কেরুং শহরে। সেখানে এক দিন থেকে তিব্বতের তিংড়ি নামে অন্য একটি শহরে যাই। সেখানেও এক দিন কাটাই আমরা। এই চার দিনে খুব সামান্য হলেও ছোটবেলায় বইয়ে পড়া নিষিদ্ধ শহর তিব্বতে ঘোরার সুযোগ হয়েছে। তিংড়িতে আমরা কিছু তিব্বতি গ্রামের দেখা পেয়েছিলাম।
আমরা ৮ মে দুপুর ১২টা নাগাদ বেসক্যাম্প পৌঁছে যাই। কী চমৎকার আবহাওয়া ছিল সেদিন! আশপাশে শত শত তাঁবু। বিশাল ময়দানের মতো একটা জায়গায় যেন মেলা বসেছে। সবাই এভারেস্ট অভিযানে এসেছে। আমরাই শুধু লাকপারি অভিযানে এসেছি। সেখানে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে খাবারের তাঁবুতে গিয়ে এভারেস্ট অভিযাত্রী তিন পোলিশ ও এক ভারতীয় পর্বতারোহীর সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রায় মাসখানেক আগে তাঁরা এসেছেন এভারেস্ট অভিযানে।
চতুর্থ দিন আমরা এভারেস্ট মিডল ক্যাম্পে পৌঁছাই। পরদিন এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে পৌঁছে যাই। সেখানে আরও তিন দিন কাটিয়ে মূল অভিযান।
২.বেলা প্রায় ৩টা। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা একটানা হেঁটে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩ হাজার ১১৩ ফুট উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন ঠিক কোন অনুভূতি হয়েছিল তা আজ আর মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি লাকপারির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। তবে সত্যি বলতে, ভীষণ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিলাম তখন। তাঁবুতে ফিরে বিশ্রাম আর খাবারের কথা মনে হচ্ছিল বারবার।
মনের মধ্যে যখন এসব এলোমেলো ভাবনা খেলা করছিল, তখনই ভ্রম ভাঙালেন দাওয়া শেরপা। বললেন, তাড়াতাড়ি ছবি তোলো, ফিরতে হবে দ্রুত। এই দীর্ঘ পথ ফিরতে হবে ভেবে আমার চিন্তা বেড়ে গেল। সকালের সেই ক্রেভাসে পড়ে যাওয়ার ঘটনা সারা দিন মাথায় গেঁথে ছিল। আবার সেই পথে ফিরতে হবে মনে করেই পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল।
লাকপারির চূড়ায় আধা ঘণ্টার মতো থেকে আমরা ফিরতি পথ ধরি। রাত সাড়ে ৯টার অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প পৌঁছাই। এই ফেরার পথটুকু আমি কীভাবে হেঁটেছি, মনে নেই। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছি। সর্বশেষ যখন তাঁবুতে পা রাখলাম, আমি কিছু সময়ের মতো অবচেতন ছিলাম। আমার ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে, কোনো এক শেরপা দ্রুত আমার শরীর থেকে হার্নেস সেট, আইস বুট আর উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট খুলে দিচ্ছেন। কেউ একজন গরম পানি হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন খাওয়ার জন্য। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লেগেছিল আমার। এখনো সেই ঘোর চোখে-মুখে লেগে আছে। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
লেখক: পর্যটক ও পর্বতারোহী, ঢাকা ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব
আমরা সবাই কখনো না কখনো রেগে যাই। কারও ওপর, নিজের ওপর, পরিস্থিতির ওপর, কিংবা কখনো এমনকি অজানা এক শূন্যতার ওপরও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন রেগে যায়? রাগ কি কেবলই একটি আবেগ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে থাকে বহুস্তর বিশ্লেষণ, অতীত অভিজ্ঞতা, অসহায়ত্ব, অপূর্ণতা এবং একধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া?
৩৬ মিনিট আগেঅনেকে কাঁকড়া খেতে ভালোবাসেন। তবে যাঁরা এই প্রথম বাজার থেকে কাঁকড়া কিনে এনেছেন রাঁধবেন বলে, তাঁদের জন্য কাঁকড়া ভুনার রেসিপি ও ছবি দিয়েছেন রন্ধনশিল্পী ওমাম রায়হান।
১৬ ঘণ্টা আগেশহরটির বয়স প্রায় ১১০ বছর। ‘ম্যাড ম্যাক্স বিয়ন্ড থান্ডারডোম’, ‘প্রিসিলা’, ‘ডেজার্ট কুইন’ ও ‘রেড প্ল্যানেট’ চলচ্চিত্র যাঁরা দেখেছেন, বিস্তারিত না জানলেও তাঁরা এই শহর এবং তার পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত। কারণ, এই চলচ্চিত্রগুলো শতবর্ষী শহরটিতেই চিত্রায়িত হয়েছিল।
১৬ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে কেউই নিজেদের মিথ্যাবাদী ভাবতে চায় না। কিন্তু সত্যি বলতে, সবাইকে কখনো না কখনো মিথ্যা বলতে হয়। ছোট ছোট সাদা মিথ্যা থেকে শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত মিথ্যা। এ ধরনের কথা বলার ধরন অনেক রকম। শিশুরাও বুঝে না বুঝে মিথ্যা বলে। তাই মিথ্যা বলা হয়তো একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি।
১৬ ঘণ্টা আগে