Ajker Patrika

চেক রিপাবলিক থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বাটা

ফিচার ডেস্ক
বাটার মূর্তি, চেক রিপাবলিক। ছবি: সংগৃহীত
বাটার মূর্তি, চেক রিপাবলিক। ছবি: সংগৃহীত

জুতা শিল্পে বিশ্বজুড়ে পুরোনো ও খ্যাতিমান ব্র্যান্ড বাটা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে এর শোরুম। এ ছাড়া বিশটি দেশে ২৭টি উৎপাদন কারখানা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমানে বাটার প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের লোজান শহরে। শত বছর পার করে এখন পর্যন্ত জুতার বাজারে আস্থা ও খ্যাতির প্রতীক বাটা।

যেভাবে শুরু হলো বাটা

প্রতিষ্ঠাতার নাম টমাস বাটা। ১৮৭৬ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার (বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র) জিলিন শহরে জন্মেছিলেন তিনি। পরিবারে তিন সন্তানের মধ্যে টমাস ছিলেন সবার ছোট। তাঁর পূর্বপুরুষেরা প্রজন্ম ধরে জুতা তৈরির পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই চামড়া ও জুতার সঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে বড় হন টমাস। একপর্যায়ে তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নিজের পারিবারিক পেশাকে আধুনিক ও বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করার। মাত্র ৩২০ ডলার মূলধন নিয়ে ১৮৯৪ সালে টমাস তাঁর বড় ভাই এনটোনিন ও বোন এনাকে সঙ্গে নিয়ে টিএন্ডএ বাটা নামে একটি ছোট দোকান খোলেন। কিস্তিতে সেলাই মেশিন কিনে শুরু হয় তাঁদের যাত্রা। কিন্তু ১৮৯৫ সালে ভাইয়ের চাকরি ও বোনের বিয়ের পর টমাস একা হয়ে পড়েন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন। অল্পদিনের মধ্যে আর্থিক সংকটে ধুঁকতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু টমাস হাল ছাড়েননি।

সংকট কাটাতে টমাস চালু করেন নতুন ডিজাইনের জুতা বাটোভকা। এটি বাজারে আসার পরই বদলে যায় তাঁর ভাগ্য। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় কর্মীসংখ্যা দশ থেকে বেড়ে হয় পঞ্চাশ। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর মেশিনচালিত জুতার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে বাটা। টমাস ১৯০৪ সালে তিনজন দক্ষ কর্মীসহ আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখানে একটি মেশিনচালিত জুতা কারখানায় কাজ করে প্রযুক্তি রপ্ত করেন। ছয় মাস পর ফিরে ইউরোপে প্রথম মেশিনচালিত জুতা উৎপাদন শুরু করেন তিনি। এর ফলে উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে বাটা হয়ে ওঠে আধুনিক জুতা শিল্পের অগ্রদূত।

টমাস বাটা প্রতিষ্ঠিত প্রথম শোরুম। চেকোস্লোভাকিয়া, ১৮৯৯। ছবি: সংগৃহীত
টমাস বাটা প্রতিষ্ঠিত প্রথম শোরুম। চেকোস্লোভাকিয়া, ১৮৯৯। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর জুতা তৈরি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর জুতা সরবরাহের চুক্তি পায় বাটা। যুদ্ধের পর অব্যবহৃত কাঁচামাল দিয়ে তাঁরা গরিবদের জন্য সস্তা জুতা বাজারজাত করতে শুরু করে। এটি তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু ১৯১৮ সালে যুদ্ধোত্তর মন্দায় ইউরোপজুড়ে আর্থিক সংকট শুরু হলে বাটাও কিছুটা টালমাটাল হয়ে ওঠে। টমাস তখন জুতার দাম করে দেন অর্ধেক। ব্যবসার জগতে অনেকেই টমাস বাটার এ সিদ্ধান্তকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিলেও ফল দেখে চমকে ওঠেন। মন্দার মধ্যেও বাটার সাশ্রয়ী জুতা কেনার জন্য ভিড় জমায় মানুষ। চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়িয়ে ১০ গুণ করা হয়। এভাবেই বাটা শুধু টিকে যায়নি বরং আরও অনেক দেশে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে।

বাংলাদেশে বাটা

ব্রিটিশ ভারতে বাটার প্রসার ঘটে। ১৯৩১ সালে কলকাতায় প্রথম কারখানা খোলার পর ধীরে ধীরে পুরো উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এর খ্যাতি। এই খ্যাতির সংবাদ শুনে যেতে পেরেছিলেন টমাস বাটা। ভারত উপমহাদেশে যাত্রা শুরুর বছরখানিকের মাথায় ১৯৩২ সালের ১২ জুলাই তিনি মারা যান।

টমাস বাটা। ছবি: সংগৃহীত
টমাস বাটা। ছবি: সংগৃহীত

ভারত ভাগের সূত্রে ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে বাটা। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই এ দেশে ব্যবসার ব্যাপক সম্ভাবনা দেখে ১৯৬২ সালে এখানে কারখানা প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ভূখণ্ডে বাটার ইতিহাস শুধুই সাফল্যের। বাংলাদেশে বাটার জনপ্রিয়তা এতটাই যে এক সময় জুতা মানেই ছিল বাটা।

বাটা পরিবার। ছবি: সংগৃহীত
বাটা পরিবার। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বন্ধু

১৯৭০ সালে বাটার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সৈনিক। ফলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানিদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, তথ্য, অস্ত্র এবং ওষুধ সরবরাহ করতেন ওডারল্যান্ড। যুদ্ধের সময় বাটার টঙ্গীর কারখানা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ক্যাম্প। ওডারল্যান্ড নিজেও যুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশ নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাটার নির্বাহী পরিচালক উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ডকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। এটি ছিল এক বিশেষ সম্মাননা।

বাটা স্টোর, ১৯২০। ছবি: সংগৃহীত
বাটা স্টোর, ১৯২০। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান

আজকের দিনেও বাটা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে আছে। প্রায় ৬৪ একর জায়গায় বাটার দুটি কারখানা রয়েছে এ দেশে। এর একটি ধামরাই অন্যটি টঙ্গীতে। এসব কারখানায় প্রায় ৩ হাজার কর্মী কাজ করেন। বাংলাদেশে বাটার উৎপাদিত পণ্য দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ব্যাপক অবদান রেখেছে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটার অধিকাংশ পণ্য তৈরি হয় এ দেশে। এখানে কাজ করেন দেশের মানুষ। এভাবে দেশের অর্থের বড় অংশ দেশেই থেকে যায়।

বাটা মেমোরিয়াল, জিলিন, চেক প্রজাতন্ত্র। ছবি: সংগৃহীত
বাটা মেমোরিয়াল, জিলিন, চেক প্রজাতন্ত্র। ছবি: সংগৃহীত

বিভূতিভূষণ অনুবাদ করেন টমাস বাটার জীবনী

‘হাউ আই বিগান’ নামে আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন টমাস বাটা। তবে সেটি আর শেষ করা হয়নি। বইটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে পড়ে। সেই বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে নিজেই বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, বাংলার তরুণদের টমাস বাটা সম্পর্কে জানা জরুরি। অনুবাদের কাজ শেষ হলে পাণ্ডুলিপি নিয়ে যান আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কাছে। বিভূতিভূষণকে বিমুখ করেননি তিনি। প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় টমাস বাটার আত্মজীবনী। বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র।

বাংলাদেশে বাটার একটি শোরুম। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে বাটার একটি শোরুম। ছবি: সংগৃহীত

সংগ্রাম, উদ্ভাবন ও জনগণের চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাটা আজ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও বিশ্বস্ত জুতার ব্র্যান্ড। বাংলাদেশে এর অবস্থান শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যেরই নয়, সামাজিক আস্থারও প্রতীক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত