Ajker Patrika

মায়ের বুকের দুধে শিশুর শুভ সূচনা হোক

মো. ইকবাল হোসেন 
আপডেট : ০১ জুন ২০২১, ১৮: ৪১
মায়ের বুকের দুধে শিশুর শুভ সূচনা হোক

প্রতিটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্মের পর প্রধান খাবার হয় তার মায়ের বুকের দুধ। বিজ্ঞান নির্ভর পৃথিবীতে প্রমাণিত যে, শিশুর জন্য তার মায়ের দুধের গুরুত্ব অপরিসীম। আর জন্মের পর শালদুধ শিশুর প্রথম টিকা। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই শিশু যার, দুধ তার হতে হবে। আপনি যদি মানব শিশুকে জন্মের পর গরু-ছাগলের শালদুধ খাওয়ান, তাহলে সেটা কাজে আসবে না।

প্রতিটি প্রাণীর দুধের উপাদানের পরিমাণ আলাদা থাকে, যা শুধু ওই প্রাণীর বাচ্চার জন্যই উপযোগী। মানব শিশুর হাড়, দাঁত, মস্তিষ্কসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গঠনে যে উপাদান যতটুকু দরকার, মায়ের দুধে ঠিক ততটুকুই আছে। আবার গরুর দুধে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, যা গরুর বাছুরের দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধির জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এই উচ্চ প্রোটিন মানব শিশুর জন্য প্রযোজ্য নয়। অপরদিকে মায়ের দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে যা, মানব শিশুর জন্য খুব দরকারি কিন্তু গরুর বাছুরের জন্য নয়। আবার বুকের দুধে উন্নতমানের কার্বোহাইড্রেট অলিগোস্যাকারাইড পাওয়া যায়, যা গরুর দুধে পাওয়া যায় না। একই ভাবে গরুর দুধে আয়রন এবং ফাইবারের পরিমাণ খুবই কম থাকে, যা মায়ের দুধে অনেক বেশি থাকে।

গরুর দুধমায়ের বুকের দুধ 
কার্বোহাইড্রেট ৪.৫ গ্রামকার্বোহাইড্রেট ৭.১ গ্রাম 
প্রোটিন ৩.৫ গ্রাম প্রোটিন ১.১ গ্রাম
চর্বি ৩.৯ গ্রাম চর্বি ৪.১ গ্রাম 
আয়রন ০.১ মিলিগ্রামআয়রন ০.২ মিলিগ্রাম
ফাইবার ০.১ গ্রামফাইবার ০.২
ক্যালসিয়াম ১২৫ মিলিগ্রামক্যালসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম ০.৭৭ গ্রামসোডিয়াম ০.১৭ গ্রাম
জিংক ৪ মিলিগ্রামজিংক ১.৮ মিলিগ্রাম

মায়ের দুধ এবং গরুর দুধের উপাদানের পরিমাণ (প্রতি ১০০ মিলি লিটারে) :

এ ছাড়াও মায়ের বুকের দুধে বিশেষ কিছু এনজাইম থাকে যা, শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি। যেমন মায়ের বুকের দুধে চর্বি পরিপাককারী লাইপেজ এনজাইম থাকে, যা গরু-ছাগলের দুধে থাকে না। মায়ের দুধ যেহেতু সরাসরি পান করা হয়, তাই প্রতিটি এনজাইমের কার্যকারিতা অক্ষুণ্ন থাকে। অন্যদিকে গরুর দুধে কিছু প্রয়োজনীয় এনজাইম থাকলেও তা বারবার ফুটানোর কারণে অনেকটাই অকেজো হয়ে যেতে পারে।

মানব শিশুর জন্য মানুষের দুধ আর গরু-ছাগলের বাচ্চার জন্য গরু-ছাগলের দুধ। এটিই প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক। তাই শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ান। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (আধ ঘণ্টার মধ্যে) বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা উচিত। শুরুতেই হয়তো বাচ্চা বুকের দুধ পাওয়া যাবে না, তাই বলে কিন্তু খাওয়ানো বন্ধ রাখা যাবে না।

শিশু দুধ না পেলেও বারবার তাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, এতে দ্রুত মায়ের বুকে দুধ আসবে। পূর্ণ ছয় মাস (১৮০ দিন) বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ (এক ফোঁটা পানিও নয়) খাওয়াতে হবে। এই ছয় মাসে শিশুর শরীর এবং মস্তিষ্কের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান মায়ের বুকের দুধেই আছে।  শিশুর জন্য মায়ের দুধ বাদে অন্য কোনো প্রাণীর দুধ, যেমন গরু, ছাগল ইত্যাদির দুধ বা টিনের দুধ ব্যবহার করলে তাকে বিকল্প দুধ বলা হয়। বুকের দুধ শিশুর জীবনে শ্রেষ্ঠ সূচনা।

শিশুর আয়ু, পুষ্টি, বৃদ্ধি ও বিকাশ সব মঙ্গল নিহিত আছে এতে। এ ছাড়া মায়ের বুকের দুধ পানে মা এবং সন্তান উভয়েরই কিছু উপকারী দিক আছে।

মায়ের দুধে শিশুর উপকারিতা:

  • শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদানই মায়ের দুধেই আছে।
  • সহজে হজম হয় এবং অ্যালার্জি সমস্যা হয় না।
  • মায়ের দুধের অ্যান্টিবডি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সব ধরনের রোগ থেকে শিশুকে রক্ষা করে।
  • শিশুর বুদ্ধির বিকাশ দ্রুত হয়, কৌটার দুধের তুলনায় মায়ের বুকের দুধে বুদ্ধির বিকাশ ৯ গুণ বেশি হয়।
  • মায়ের সঙ্গে শিশুর আত্মার বন্ধন তৈরি হয়।
  • শিশু মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন হয়। মায়ের মমতা ও ভালোবাসা পেয়ে বড় হওয়া শিশু সব মানুষকে ভালোবাসতে শেখে।

বুকের দুধ খাওয়ানোয় মায়ের উপকারিতা:

  • মায়ের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
  • মায়ের দুধ প্রাকৃতিক, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো সময় মা খাওয়াতে পারেন। কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না।
  • শিশু জন্মের পর মায়ের রক্তক্ষরণ কম হয়।
  • শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে তা প্রাকৃতিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজ করে।
  • বুকের দুধ খাওয়ানোর অভ্যাস জরায়ু ও স্তন ক্যানসারসহ অনেক রোগ থেকে মাকে রক্ষা করে।
  • মায়ের ওজন কমাতে সাহায্য করে।

বিকল্প দুধ শিশুর যেসব ক্ষতি করতে পারে:

  • শিশু ঘন ঘন অসুখে ভুগতে পারে। কেন না দুধ, নিপল ও বোতলের সঙ্গে কিংবা বিকল্প দুধ তৈরিতে ব্যবহৃত পানির সঙ্গে সব সময় রোগজীবাণু থাকার আশঙ্কা আছে।
  • গরমকালে দুধসহ বোতল কিছুক্ষণ থাকলেই তাতে দ্রুত রোগজীবাণু বাসা বাঁধে।
  • বিকল্প দুধে মায়ের দুধের মতো রোগপ্রতিরোধক শক্তি থাকে না। শিশুর ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানপাকাসহ অন্যান্য রোগব্যাধির ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়। পরিণামে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়।
  • বিকল্প দুধে বেড়ে ওঠা শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
  • বিকল্প দুধে আয়রন কম থাকে বলে শিশু আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
  • গরুর দুধ প্রকৃত অর্থে বাছুরের জন্য। মানবশিশু তা সহজে হজম করতে পারে না। শিশু প্রায়ই কোষ্ঠকাঠিন্যে কষ্ট পায়।
  • বোতলের দুধে মায়ের খাটুনি ও খরচ অনেক। বোতলের ছিদ্রে একটু চাপ দিলে শিশু অনায়াসে দুধ পায়, যা মায়ের দুধের তুলনায় কিছুটা বেশি মিষ্টি। ফলে শিশু কষ্ট করে মায়ের দুধ খেতে চায় না। শিশু ধীরে ধীরে মায়ের দুধ খাওয়া কমিয়ে দেয়। ফলে বুকের দুধ ক্রমে শুকিয়ে যায়। তাই একান্ত বাধ্য না হলে শিশুর জন্য বিকল্প দুধের ব্যবহার না করাই ভালো।

লেখক: পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত