Ajker Patrika

ইউক্রেনের পর এবার পাকিস্তানের খনিজে নজর যুক্তরাষ্ট্রের

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ৪০
বিশ্বের বৃহত্তম খেওরা সল্ট মাইন। এটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ঝিলাম শহরে অবস্থিত। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের বৃহত্তম খেওরা সল্ট মাইন। এটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ঝিলাম শহরে অবস্থিত। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েই ইউক্রেনের বিরল খনিজের ওপর নজর দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি একটি চুক্তিরও দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল ওয়াশিংটন ও কিয়েভ। যদিও নানা কারণে সেই চুক্তি এখনো হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইউক্রেনের খনিজে নজর দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এবার দেশটি নজর দিয়েছে পাকিস্তানের বিরল খনিজেও।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এরিক মেয়ার গত সপ্তাহে ইসলামাবাদ সফরে আসেন। সেখানে তিনি একটি খনিজ বিনিয়োগ ফোরামে যোগ দেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে এক বৈঠকে মেয়ার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো পাকিস্তানের অব্যবহৃত খনিজ সম্পদে বিনিয়োগে আগ্রহী।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক ব্যাপক আগ্রহের প্রতিফলন। আলোচনার ঠিক দুই দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে এক ফোনালাপে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ নিয়ে ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সহযোগিতার সম্ভাবনার কথা বলেন।

এই আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসেও দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেসের পাকিস্তান ককাসের সহসভাপতি রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা জ্যাক বার্গম্যান সম্প্রতি খনিজকে অংশীদারত্বের ‘মূল খাত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বার্গম্যান গত সপ্তাহান্তে ইসলামাবাদ সফর করেন। ২০২৩ সালের পর এটি ছিল পাকিস্তানে প্রথম কোনো কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের সফর।

পাকিস্তানের খনিজ ভান্ডারে তামা ও সোনার বিশাল মজুত ছাড়াও লিথিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই খনিজ সম্পদ ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমাইলের বেশি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি যুক্তরাজ্যের আয়তনের দ্বিগুণেরও বেশি।

ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে তাদের খনিজ সম্পদের বিপুল পরিমাণ মজুতের কথা বলে আসছে। বর্তমানে এর আর্থিক মূল্য ৮ ট্রিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান দীর্ঘকাল ধরে আগ্রহী বিনিয়োগকারী খুঁজে পেতে হিমশিম খেয়েছে। তাই ট্রাম্প প্রশাসনের এই আগ্রহকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান খনিজ সহযোগিতার সম্ভাবনাকে বেশি করে দেখা ঠিক হবে না। গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি এ ধরনের অংশীদারত্বকে বিপজ্জনক জুয়ায় পরিণত করেছে।

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসার পর দুই দেশের সম্পর্কে যখন অংশীদারত্বের ভিত্তি খোঁজা হচ্ছিল, তখন খনিজকে নতুন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে দেখা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের জোরালো আগ্রহ সুবিদিত। চীন সম্প্রতি বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পাকিস্তানকে সুযোগ হিসেবে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তি প্রেরণা জোগাচ্ছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান হয়তো তাদের খনিজ সম্পদকে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে তুলে ধরার সুযোগ হিসেবে দেখছে। শাহবাজ শরিফ বলেছেন, খনিজ বিনিয়োগ পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক আর্থিক নির্ভরতা কমাতে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

তবে নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খনি কোম্পানিগুলো প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ ভূখণ্ডে কাজ করে, তাই উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্ভাব্য খনি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে ৫২১টি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এটি ৭০ শতাংশ বেশি।

৫২১টি হামলার ৯৫ শতাংশের বেশি হয়েছে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে। সরকারি তথ্য অনুসারে, পাকিস্তানের বেশির ভাগ খনিজ সম্পদ এই দুটি প্রদেশেই অবস্থিত। ২০২৫ সালেও এই প্রবণতা অব্যাহত। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে ৫৪টি সন্ত্রাসী হামলার খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৫৩টিই ছিল এই দুই প্রদেশে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী সহিংস গোষ্ঠী। ২০২৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিএলএ এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ ঘোষিত বেলুচ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হামলার সংখ্যা ১১৯ শতাংশ বেড়েছে।

সাধারণভাবে বলতে গেলে, গত কয়েক দশকে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন এবং বড় অবকাঠামো প্রকল্প স্থানীয় সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সম্পদের শোষণ নিয়ে ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে বিএলএ হামলার অন্যতম কারণ।

ফলে, খনিজ বিনিয়োগকারীরা বারুদের স্তূপের মধ্যে পা রাখতে যাচ্ছেন, যদি তাঁরা দেশটিতে বিনিয়োগ করেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান খনিজ বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা উদ্বেগ পর্যাপ্তভাবে সমাধান করতে পারেনি, যদিও চীনের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে রক্ষা করার জন্য হাজার হাজার নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য যেসব দেশের খনিজ বিনিয়োগকারীরা পাকিস্তানে সুযোগ খুঁজছেন, তারা হয়তো তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আনার জন্য চাপ দিতে পারেন। এটি পাকিস্তানে অবৈধ। তবে ইসলামাবাদ যদি এতে রাজি হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠবে।

পাকিস্তানে খনিজ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবকাঠামো ও জ্বালানির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শাহবাজ শরিফ বিনিয়োগকারীদের দেশেই খনিজ প্রক্রিয়াকরণের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানে কর্মরত কানাডাভিত্তিক ব্যারিক গোল্ডের কর্মকর্তারা বলছেন দেশটিতে পর্যাপ্ত সস্তা ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ নেই। (ব্যারিক গোল্ড বেলুচিস্তানে সোনা ও তামার খনি উন্নয়নে পাকিস্তানের সঙ্গে অংশীদারত্ব করছে।)

পাকিস্তান দীর্ঘকাল ধরে তথাকথিত রিসোর্স কার্স বা সম্পদের অভিশাপের একটি উদাহরণ হয়ে আছে। বিপুল খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশটি অর্থনৈতিকভাবে সংগ্রাম করছে। নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং অন্যান্য বাধা বিবেচনা করলে, এই অবস্থা থেকে খুব শিগগিরই বেরিয়ে আসা কঠিন হবে।

তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত