Ajker Patrika

গাজার সাংবাদিকের মুখে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ভয়াবহতা

আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৭: ১৬
গাজার সাংবাদিকের মুখে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ভয়াবহতা

গতকাল শনিবার ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এর পরিপ্রেক্ষিতে গাজায় পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের হামলায় ৩১৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গাজায় ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহতা নিয়ে সাংবাদিক মোহাম্মেদ রফিক মোহয়েশ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। 

রফিক মোহয়েশ হামলার ভয়াবহতা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘গাজার আমাদের শান্তির সকাল আগুনের আঁচ ও বিস্ফোরণের মুহুর্মুহু শব্দে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখানকার প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার জীবনাকাশে ভিড় করেছে বেদনা ও ভ্রান্তির কালো মেঘ। যুদ্ধবিমানের আওয়াজ বেড়েই চলছিল। পুরো পরিবার নিয়ে আমি আশ্রয় নেই একটি আবছা আলোকিত ঘরে। হয়তো বোকার মতো আশা করেছি, এটিই বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় আমার স্ত্রী ছিল পাশে। দেখলাম, ওর চওড়া চোখ কাঁপছে। আশ্বাস দেওয়ার জন্য সে বারবার বলছিল যে আমরা নিরাপদ। কিন্তু কণ্ঠের কাঁপন তাঁর উদ্বেগকে লুকোতে পারেনি। 

‘যতই আশার বাণী ছড়াই না কেন, পরিবারের মানুষগুলোর চোখেমুখে ফুটে ওঠা ভয় আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো আতঙ্ককে আমি কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারছি না। আমার মায়ের মুখের বলিরেখাগুলো সারা জীবনই ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের নীরব সাক্ষী। আমার দুই বছরের ছেলে, তাঁর একমাত্র নাতিকে বাইরের বিস্ফোরণ ও যুদ্ধবিমানের গর্জন থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন মা। এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের গগনবিদারী গর্জনে হারিয়ে যাচ্ছিল তাঁর মৃদু আশ্বাসবাণী। 

‘ছোট সেই ঘরে আমরা সবাই জড়ো হয়েছিলাম। আমার বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে ও বোন। সকালে যে কণ্ঠগুলো থাকত হাসি ও কৌতূহলে ভরা, সেসবেই এখন ভর করেছে চাপা কান্না ও নীরব প্রার্থনা। 

‘যেখানে আশ্রয় নিয়েছি তার বাইরে থেকে ধ্বংসের ভুতুড়ে সব ছবি নিয়ে আসছে খবর। আবাসিক ভবনগুলো ভেঙে পড়েছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মতো। ধোঁয়া আর ধুলোর মেঘ চারদিকে। প্রতিটি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে আমাদের পায়ের নিচের মাটি। রাস্তায় মানুষের আর্তনাদ এবং ওপরে যুদ্ধবিমানের গর্জন বাড়িয়ে তুলছে আমাদের উদ্বেগ। 

‘সেই পরাবাস্তব মুহূর্তে আমি কেবল এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছিলাম যে আমার কণ্ঠস্বর কেবল আমার বেঁচে থাকার পথই নয়, বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষারও একটি উপায়। এই কণ্ঠের সাহায্যে অনেকবারই আমাদের সংগ্রামের দিকে মনোযোগ ফেরাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বধিরদের কানে সে আওয়াজ গিয়ে পৌঁছায়নি। একজন সাংবাদিক এবং লেখক হিসেবে যিনি অলৌকিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে পাঁচটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলেন, সেই আমি জানি যে আমার কণ্ঠস্বরই বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার একটি উপায়। এই কণ্ঠস্বরই পারে আমাদের নিরাপত্তার আহ্বান বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে। 

‘সারা দিন ধরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় শহরজুড়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে আমরা ফোন কল আদান-প্রদান করছি। প্রতিবেশীরা যেমন একে অপরের খোঁজ নিয়েছে তেমনি অপরিচিতরাও দেখা হলে উৎসাহ ও সাহস দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে। আমি যখন এসব লিখছি তখনো নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। তবে ভেতরে-ভেতরে জানি, যেকোনো মুহূর্তেই শত্রুর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারি আমরা। 

‘সাহসিকতা দেখিয়ে যাওয়ার পরও যখন সহ্য করে গেছি দিনব্যাপী সংঘর্ষের আতঙ্ক, মনের মধ্যে স্থায়ী হয়ে বসে যাওয়া মানসিক ক্লান্তিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারই না। সংঘর্ষের শুরুটা যারা দেখেছে, যারা শুনেছে বিস্ফোরণের একের পর এক প্রতিধ্বনি তাদের চোখে এখনো রয়ে গেছে ভয়। প্রতিটি মুহূর্ত এখন বেদনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটছে। অনিশ্চয়তার ভার আমাদের কাঁধে প্রচণ্ড শক্তভাবে চেপে বসেছে। 

‘তবুও গাজায় এখন একতা ও প্রতিরোধের চেতনাই হয়ে উঠেছে মানুষের একমাত্র সান্ত্বনা। যখন রাত্রি নামে, ভয় ও ধ্বংসের মধ্যে আশা এবং সংকল্পের স্বরই ফিসফিস করে। এই স্বর ফিলিস্তিনের মানুষের অটল চেতনার প্রমাণ—যারা দখলকৃত অঞ্চলজুড়ে দখলদারের আক্রমণের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ 

প্রসঙ্গত, ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলায় নিহত বেড়ে ৩০০ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে হামাসের হামলার পর গাজায় পাল্টা বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

এত বড় হামলা চালানোর জন্য ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির এক উপদেষ্টা। 

সৌদি আরব ও মিসর দ্রুত এই যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে সৌদি আরব দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

এদিকে, হামাসের এই হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে প্রতিরক্ষা সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণের সঙ্গে আছি। এই হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাণ হারানোর জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি।’ 

হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জাচি হানেগবির সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জেক সুলিভান। 

ন্যাটোর মুখপাত্র ডিলান হোয়াইট বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আছি। মুক্ত সমাজ গঠনে সন্ত্রাসবাদ প্রধান হুমকি। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।’ 

ইসরায়েলে হামাসের এই হামলায় ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারত নিন্দা জানিয়েছে বলে এএফপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূত্র: আল জাজিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত