Ajker Patrika

পাঁচ রাজ্যের জনমত কংগ্রেস–বিজেপির বিপক্ষে

প্রতিনিধি
পাঁচ রাজ্যের জনমত কংগ্রেস–বিজেপির বিপক্ষে

কলকাতা: কোভিডকালে ভারতের পাঁচ রাজ্য এবং ইউনিয়ন টেরিটোরি পডুচেরির ভোটে প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছে না বিজেপি বা কংগ্রেস কেউই। বুথফেরত জরিপে এই বৃহৎ দুই দলের কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য চূড়ান্ত ফল জানতে রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বুথফেরত জরিপে স্পষ্ট ইঙ্গিত, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, তামিলনাডুতে এমকে স্টালিনের ডিএমকে এবং কেরালায় পিনারাই বিজয়নের হাত ধরে বামেদের পক্ষেই রয়েছে জনমত।

এছাড়া কোভিডকালে ভোট আয়োজনে পাঁচ মাস আগে বিহারে ভারতের নির্বাচন কমিশন সাফল্য পেলেও এবারের ভোটে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অভিযোগে আঙ্গুল উঠছে তাদের দিকেই। কয়েক দফায় ভোটগ্রহণ এবং প্রধানমন্ত্রীসহ শাসক দলের ইচ্ছেমতো জনসমাবেশ করতে দেওয়ার কারণে কমিশনের বিরুদ্ধে সংক্রমণের পরিবেশ তৈরি করার পাশাপাশি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও তুলছেন অনেকে।

২০১৯ সালে প্রবল বিক্রমে নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে বিজেপির। মোদিকে সামনে রেখেই বিভিন্ন রাজ্যে ভোটে লড়ছে বিজেপি। কিন্তু দ্বিতীয় দফার মোদি সরকারের নয়া কৃষি আইন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, ক্ষমতায় এসেই কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপির শাসনে একাধিক সমালোচিত ঘটনা– শাসক দলকে বারবার প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে কংগ্রেস সরকারবিরোধী আবেগকে ভোটে রূপান্তরিত করতে পারেনি। মাত্র পাঁচ মাস আগে 'মহাগাঁট বন্ধন' করেও বিহারে হারানো যায়নি বিজেপির জোটকে। কারণ সেই কংগ্রেস। শরিক দলগুলো ভালো ফল করলেও কংগ্রেস প্রার্থীরা ভোটারদের মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হন। বিহার-ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর অসুস্থতার পাশাপাশি রাহুল গান্ধী ও তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর লাগাতার কর্মসূচির অভাবকেও অনেকে দায়ী করেন।

কারণ যাইহোক জরিপে নিশ্চিত, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারবে না। পুরোনো শত্রু বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়েও কোনও লাভ যে হচ্ছে না, সেটি কংগ্রেস নেতারা একান্তে স্বীকারও করছেন। পশ্চিমবঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে বামেরাও। এবারের লড়াই মোদি বনাম মমতার। পশ্চিমবঙ্গ জিততে মরিয়া মোদি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রচারে। মমতার পাল্টা কোনও রাজ্য নেতাকে সামনে না রেখে, মোদির ইমেজকেই বাজি ধরেন বিজেপি নেতারা। কোভিডকালেও দিল্লির বিজেপি নেতারা বিমানে 'ডেলি-প্যাসেঞ্জারি' করেন। তৃণমূলের একঝাঁক নেতা-মন্ত্রী নাম লেখান বিজেপিতে। প্রশ্ন ওঠে, 'কোথায় বিজেপি! প্রার্থীরা তো অনেকেই তৃণমূলের ঘরের লোক!'

তৃণমূলের বহু নেতা এবার ছিলেন বিজেপির প্রার্থী। দলে মমতার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মুকুল রায় আগেই বিজেপিতে ভিড়েছেন। ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মফুলে আরও অনেক হেভিওয়েট।

একদিকে, ভারতের শাসক দলের প্রধানমন্ত্রীসহ একঝাঁক তারকা মন্ত্রী, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো জনপ্রিয় অভিনেতা, সঙ্গে আবার দলছুট তৃণমূল নেতা-নেত্রী। অন্যদিকে, মমতা একা। একার গ্ল্যামারকে পুঁজি করে লড়েছেন গদি রক্ষায়। বেশিরভাগ জরিপের আভাস, তিনিই থাকছেন। থাকুন বা না থাকুন, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে একা যেভাবে ভোটকে হাড্ডাহাড্ডি পর্যায়ে তুলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, সেটাও কম নয়। ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করছেন বিজেপিরই নেতারা।

জরিপ বলছে, এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ) এবং সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) নিয়ে বিতর্কের মধ্যেও আসামে ক্ষমতায় ফিরতে পারে বিজেপির জোট। কিন্তু এই জরিপেই দেখাচ্ছে বিজেপির মিত্রজোটের থেকে কংগ্রেসের মহাজোট অন্তত ৫ শতাংশ ভোট বেশি পাচ্ছে। আর এটা পাচ্ছে, মহাজোটের বাকি নয় শরিকের হাত ধরে। ১২৬টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস একাই প্রার্থী দিয়েছে ৮০টিতে। বাকিরা ৪৬। জরিপের ইঙ্গিত, শরিকরা ভালো ফল করবে, কংগ্রেস নয়। কারণ? নেতৃত্বের দুর্বলতা।

আবার বিজেপির জোট ক্ষমতায় এলেও ভোট কমবে তাঁদের। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি নেতারা গোটা আসামও চষে বেড়ান। তবু ভোট কম। মোদি-ম্যাজিক উধাও জরিপে। অথচ, রাজ্যে নিজেদের সরকার থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের বদলে মোদি-মডেল সামনে রেখে ভোট করে বিজেপি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে। তবু 'হাড্ডাহাড্ডি' লড়াই মোটেই স্বস্তি দিচ্ছে না বিজেপিকে।

আসামে তবু ক্ষমতায় ফেরার চান্স আছে। কিন্তু ভারতের দাক্ষিণাত্যে কর্নাটক ছাড়া 'পদ্ম-চাষ'-এর সম্ভাবনা এখনও অধরা। কেরালা এখন দেশের একমাত্র বামশাসিত রাজ্য। রাহুল গান্ধী এখান থেকেই জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য। প্রতি পাঁচ বছর পর সরকার পরিবর্তন এখানকার নিয়ম।। সেই হিসাবে বামেদের হটিয়ে কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার কথা। বিজেপিও সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপায়। কিন্তু জরিপ বলছে, কেরালায় ফের ফিরছে বামেরা। কংগ্রেস ও বিজেপি পরাস্ত ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত রাজ্যটিতে। জরিপ মতে, প্রবীণ সিপিএম নেতা মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের কোভিড ম্যানেজমেন্টই রক্ষা করেছে দেশের একমাত্র লালদুর্গ। এখানকার মহামারি ব্যবস্থা গোটা দুনিয়াতেই প্রশংসিত। তাই শিক্ষিত রাজ্যবাসী ভুল করেননি সফল সরকারকে যোগ্য মর্যাদা দিতে।

কংগ্রেসের একমাত্র 'ললিপপ' তামিলনাড়ু। ডিএমকের হাত ধরে তাঁরা ক্ষমতায় ফিরতে পারে। সব বুথফেরত জরিপই এমন বলছে। হারছে বিজেপি-এআইডিএমকে। কিন্তু এই জয়ে কংগ্রেসের ভূমিকা অতি সামান্য। কারণ রাজ্যের ২৩৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস লড়েছেই ২৫টিতে। জিতছে ডিএমকে একাই। জয়ে সঙ্গে রয়েছে কংগ্রেস। ছোট্ট রাজ্য পডুচেরিতে গতবার জিতেছিল কংগ্রেস। কিন্তু ভোটের ক'দিন আগে দলবদলে কংগ্রেস তছনছ। দলছুটদের ভরসায় সেখানে ক্ষমতায় আসতে পারে বিজেপির জোট।

সবই সমীক্ষার ইঙ্গিত। আসল ছবি জানা যাবে রোববার। পাঁচ রাজ্যের ভোটগণনা। তবু, জরিপের আভাস কংগ্রেস ও বিজেপির জন্য খুব একটা স্বস্তির হচ্ছে না। বড়জোড় দুয়েক রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারেন তাঁরা। লোকসভার সেই ইমেজ নেই বিজেপির। কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানো এখনও বিশবাঁও জলে! ফের জোট রাজনীতিই ভারতের ভবিতব্য কিনা সেটি অবশ্য বলার সময় এখনো আসেনি। যদিও আভাস মিলতে পারে ২০২২-এর শুরুতেই। আগামী বছরের শেষ নাগাদ ভোট রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, মণিপুর ও উত্তরাখণ্ডে এবং বছর শেষে গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশ। ২০২৪-এর শুরুতে ভারতে সাধারণ নির্বাচন। তাই মোদির গদি এখন সুরক্ষিত, কিন্তু ইমেজ ধরে টান দিয়েছে জরিপের ফলাফল।

কংগ্রেস ও বিজেপি ছাড়াও কোভিডকালের এই ভোট ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছেও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কলকাতা ও মাদ্রাজ হাইকোর্ট যেভাবে কমিশনকে ভর্ৎসনা করেছেন সেটা অভূতপূর্ব। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও কমিশনের ভূমিকায় মোটেই সন্তুষ্ট নন। কারণ অতিমারির সময় নেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ব্যর্থ কমিশন। তাই, মাদ্রাজ হাইকোর্ট কমিশনের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন। কলকাতা হাইকোর্ট ভারতের সাবেক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষণের উদাহরণ টেনে বর্তমান কর্মকতাদের ব্যর্থতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বেড়েছে পক্ষপাতের অভিযোগও। সবমিলিয়ে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি প্রশ্ন চিহ্নের সামনে ভারতের নির্বাচন কমিশনও।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত