Ajker Patrika

ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুর উপবাসে মৃত্যু, জৈন ধর্মের রীতি নিয়ে আইনি বিতর্ক তুঙ্গে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৪ মে ২০২৫, ১২: ৪৩
বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট্ট শিশু ভিয়ানা। ছবি: এনডিটিভি
বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট্ট শিশু ভিয়ানা। ছবি: এনডিটিভি

মরণব্যাধি টিউমার বাসা বেঁধেছিল ভারতের ইন্দোরের তিন বছর বয়সী ভিয়ানা জৈনের মস্তিষ্কে। গত ডিসেম্বরে টিউমার ধরা পড়ার পর চলছিল চিকিৎসা। শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় পারিবারিক ধর্মগুরুর পরামর্শ মেনে ভিয়ানাকে এমন এক ধর্মীয় প্রথা মানতে হলো, যার পরিণতিতে মৃত্যু সঙ্গী হলো তার।

জৈন ধর্মের একটি প্রথা ‘সান্তারা’ বা ‘সালেখনা’। শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রথা অনুযায়ী স্বেচ্ছায় উপবাস অর্থাৎ পানি-খাবার গ্রহণ বন্ধ রাখার মাধ্যমে মৃত্যুকে বেছে নেওয়া হয়। এই প্রথা জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র প্রস্থানের পথ। যখন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয় এবং শরীর আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য আর উপযুক্ত থাকে না, তখন সচেতনভাবে এই আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আইটি পেশাজীবী পীযূষ ও বর্ষা জৈনের একমাত্র সন্তান ভিয়ানার এত কঠিন বিষয়টি বোঝার বয়সও হয়নি। কিন্তু এ বয়সে এই প্রথা অনুসরণ করে বেছে নিতে হয়েছে মৃত্যুকে। গত ২১ মার্চ এই ঘটনা ঘটলেও সম্প্রতি ‘গোল্ডেন বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ সবচেয়ে কম বয়সে ‘সান্তারা’ গ্রহণের রেকর্ডের তালিকায় ভিয়ানার নাম যুক্ত হলে তখন এই বিষয়টি সামনে আসে।

ইন্দোরে আধ্যাত্মিক গুরু রাজেশ মুনি মহারাজের কাছে ভিয়ানাকে ‘সান্তারা’ গ্রহণ করানো হয়। এই গুরুর কাছে এর আগে প্রায় ১০০ জন সান্তারা গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়।

শিশুটির মা বর্ষা জৈন বলেন, ‘গুরুদেব আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। সবকিছু বুঝিয়ে বলেছেন। আমাদের সম্মতিতে সান্তারা করানো হয়। মাত্র ১০ মিনিট পর ভিয়ানা মারা যায়।’

বাবা পীযূষ জৈন বলেন, ‘আমরা ওকে সান্তারা করানোর উদ্দেশ্যে সেখানে যাইনি, কিন্তু গুরুজি বলেছিলেন ওর অবস্থা খুবই সংকটজনক। তাই তিনি এটির পরামর্শ দেন। পরিবারের সবাই তাতে একমত হয়।’

এই স্বেচ্ছামৃত্যু প্রথায় শিশুর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসার পর বিভিন্ন প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিন বছরের একটি শিশু কি সত্যিই মৃত্যুর অর্থ বুঝতে পারে? আর যদি না-ই পারে, তাহলে তার হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কার?

আধ্যাত্মিক গুরু রাজেশ মুনি মহারাজ দাবি করেন, ভিয়ানার ‘ধর্মীয় জ্ঞান’ ছিল ৫০ বছর বয়সী মানুষের সমান।

ভিয়ানার এই মৃত্যুর বিষয়টি সম্পর্কে কিছু জানা নেই বলে দাবি করেছে ইন্দোর পুলিশ। ইন্দোরের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রাজেশ দন্ডোতিয়া বলেন, “আমাদের কাছে ‘সান্তারা’ সংক্রান্ত কোনো রেকর্ড নেই। স্থানীয় থানায় বা প্রশাসনে কেউ কোনো তথ্য দেয়নি।”

এদিকে ভিয়ানার মৃত্যু সান্তারা প্রথা নিয়ে আইনি বিতর্ককে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।

২০১৫ সালের আগস্টে রাজস্থান হাইকোর্ট ‘সান্তারা’কে আত্মহত্যার সমতুল্য বলে রায় দেয় এবং এটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার অধীনে অবৈধ ঘোষণা করে। তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জৈন সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের পর, পরবর্তী মাসেই সুপ্রিম কোর্ট ওই আদেশে স্থগিতাদেশ জারি করে। তবে এসব রায়ের কোনোটিই অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কোনো শিশুর ‘সান্তারা’ গ্রহণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বিবেচনা করেনি।

এই বিতর্কিত প্রথা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ঋতেশ আগারওয়াল বলেন, “একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর জীবন ও মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এমনকি তার বাবা-মায়েরও নেই। এটি একটি গুরুতর আইনি ও সংবিধানিক প্রশ্ন তোলে—কোনো শিশুকে, যে আইনি বা মানসিকভাবে মৃত্যুর ধারণা বুঝতে সক্ষম নয়, তার ক্ষেত্রে কি ‘সান্তারা’ দেওয়া যায়? ”

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়, কিন্তু সেটি আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এমনকি ধর্মীয় আচারও একজন অপ্রাপ্তবয়স্কের আইনি জীবনাধিকারের চেয়ে বড় হতে পারে না।’

ভারতের আইন শুধু আদালতের অনুমোদন, স্পষ্ট চিকিৎসা প্রমাণ এবং প্রাপ্তবয়স্কের সম্মতিতে প্যাসিভ ইউথেনেশিয়াকে (নিষ্ক্রিয় মৃত্যুদান) নির্দিষ্ট ও কঠোর নিয়মের আওতায় অনুমতি দেয়। এ প্রেক্ষাপটে, তিন বছর বয়সী ভিয়ানার ‘সান্তারা’ গ্রহণ নিয়ে আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন আরও গভীর হয়ে উঠছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত