Ajker Patrika

ভ্যাটিকানের মতো একটি ক্ষুদ্র মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে জোর জল্পনা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৫০
কসোভোতে ‘নওরোজ’ উপলক্ষে বক্তাশি মুসলিমদের একটি সম্মিলন। ছবি: ওয়াশিংটন এক্সামিনার
কসোভোতে ‘নওরোজ’ উপলক্ষে বক্তাশি মুসলিমদের একটি সম্মিলন। ছবি: ওয়াশিংটন এক্সামিনার

একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনায় বিশ্বের ২০০ কোটিরও বেশি মুসলিমের মাঝে ‘বক্তাশি’ নামে একটি ক্ষুদ্র সুফি সম্প্রদায় সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন এক্সামিনার দাবি করেছে, আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় বক্তাশিদের আধ্যাত্মিক সদর দপ্তরকে কেন্দ্র করে ওই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ও প্রথম ইসলামি ভ্যাটিকান হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে।

বক্তাশিরা মূলত একটি সুফি তরিকা, যাদের প্রতিষ্ঠাতা হাছি বক্তাশ বেলি। হাছি ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের একজন সুফি সাধক। বক্তাশিদের ধর্মীয় বিশ্বাস শিয়া ইসলামের ছায়ায় গড়ে উঠলেও এতে খ্রিষ্টধর্ম ও প্রাচীন আনাতোলীয় উপাদানেরও প্রভাব রয়েছে। বক্তাশিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মীয় সহনশীলতা, মানবতাবাদ এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বা শরিয়াহর প্রতি শৈথিল্য।

ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অভিজাত বাহিনী জানিসারি বাহিনীর ধর্ম হিসেবে বক্তাশিবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বহু আলবেনীয় তখন বক্তাশি হয়ে ওঠেন। তবে ১৮২৬ সালে জানিসারি বাহিনী ভেঙে দিলে দ্বিতীয় সুলতান মাহমুদ বক্তাশিদের ওপর দমন-পীড়ন চালান। পরবর্তী সময়ে ১৯২৫ সালে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির আওতায় বক্তাশিবাদ তুরস্কে নিষিদ্ধ হলে তাঁদের সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হয় আলবেনিয়ায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট শাসনামলে দেশটিতে সকল ধর্ম নিষিদ্ধ হলে বক্তাশিরা আবার পরিচয় লুকিয়ে গোপনে টিকে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে সমাজতন্ত্রের পতনের পর বক্তাশিবাদ নতুন করে জনসমক্ষে আবির্ভূত হয়।

বর্তমানে বক্তাশিদের প্রকৃত সংখ্যা ৭০ লাখ থেকে ২ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে অনেকেই দ্বিধান্বিত। আলবেনিয়ায় বক্তাশিরা সংখ্যালঘু হলেও তাঁরা ধর্মীয় সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত। তাঁদের বর্তমান ধর্মীয় নেতা বাবা মন্ডি দাবি করেন—আলবেনিয়ার অর্ধেক মানুষই বক্তাশি—যদিও প্রকৃত সংখ্যা ৫ শতাংশের কাছাকাছি।

বক্তাশিদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত উদার। বক্তাশিরা মদ্যপানকে নিষিদ্ধ করে না, তাঁরা সহিংসতার বিরোধী এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। অন্য ধর্মের প্রতিও তাঁরা শ্রদ্ধাশীল মনোভাব দেখায়।

২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা বক্তাশিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘বক্তাশিদের বৈশ্বিক কেন্দ্রকে তিরানার ভেতরে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরের মাধ্যমে আমরা একটি নতুন শান্তির কেন্দ্র তৈরি করতে চাই।’

তবে সেই সময় অনেকেই এই বক্তব্যটিকে রামার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নয়নের কৌশল হিসেবে দেখছেন।

নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যদিও আলবেনিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভূমি দিচ্ছে, তবু জাতিসংঘে স্বীকৃতি পেতে মুসলিম বিশ্ব এবং শক্তিধর দেশগুলোর সমর্থন প্রয়োজন।

বিশ্লেষক মাইকেল স্যান্টো বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বক্তাশিদের ভালো বন্ধু হিসেবে দেখে, তাই তারা সম্ভবত সমর্থন দেবে। তবে সৌদি আরব, ইরান কিংবা পাকিস্তানের মতো মুসলিম শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

এ ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকাও অনিশ্চিত। দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সুন্নি মতাবলম্বী হলেও তিনি তুরস্কে বক্তাশিদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীলতা দেখিয়েছেন। তবে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বক্তাশিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেভিদের প্রতি বৈরিতার নজির রয়েছে।

স্বীকৃতি পেলেই বক্তাশি রাষ্ট্র কেবল ধর্মীয় নয়, মানবিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়েও ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ধর্মীয় সহনশীলতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে এবং নিপীড়িত গোষ্ঠীর হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে কথা বলার সুযোগও পাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, বক্তাশিদের সম্ভাব্য রাষ্ট্র হতে পারে এক অনন্য শান্তির কেন্দ্র—ধর্ম, সংস্কৃতি এবং মানবতার মিলনস্থল, যার প্রভাব তাঁদের সদস্যসংখ্যার চাইতেও অনেক গভীর হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত