Ajker Patrika

কৃষ্ণাঙ্গ পোপের আশায় আফ্রিকানরা, কে হচ্ছেন ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি

অনলাইন ডেস্ক
সবসময় পোপ ফ্রান্সিসের সমর্থন ছিল আফ্রিকার প্রতি। ছবি: ভ্যাটিকান নিউজ।
সবসময় পোপ ফ্রান্সিসের সমর্থন ছিল আফ্রিকার প্রতি। ছবি: ভ্যাটিকান নিউজ।

ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের নতুন ধর্মগুরু কে হতে যাচ্ছেন, বিশ্বজুড়ে এখন এই প্রশ্ন। পোপ ফ্রান্সিসের রেখে যাওয়া দায়িত্বভার নেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি কে হতে পারেন সে তালিকায় অনেক নাম আসলেও কারও ব্যাপারেই শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে এবার এ তালিকায় এগিয়ে আছেন কৃষ্ণাঙ্গরা। আফ্রিকা মহাদেশের মানুষও আশাবাদী তাদেরই কেউ হবেন নতুন ধর্মগুরু। আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান খ্রিষ্টান সমাজ স্বপ্ন দেখছে, পোপ ফ্রান্সিসের উন্নয়নশীল বিশ্বে কথা বলার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরবেন কৃষ্ণাঙ্গ কেউ।

অবশ্য কে পোপ হবেন তা আগেভাগে বলা বরাবরই কঠিন। তাছাড়া গত কয়েক দশকে ভয়াবহ কেলেঙ্কারি ও সমালোচনার মুখে পড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভ্যাটিকান এ বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল। তবে গত সোমবার পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা আফ্রিকার অনেক ক্যাথলিক বিশ্বাসী বলেছেন, একজন কৃষ্ণাঙ্গ পোপ হওয়া অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।

খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে উত্তর আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী বা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কয়েকজন পোপ ছিলেন। যদিও এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য খুব বেশি নেই। তবে সে সময় একজন বা একাধিক পোপ কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন বলেও ধারণা করা হয়।

গত মাসে প্রকাশিত ভ্যাটিকান-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আফ্রিকা মহাদেশে যেখানে ধর্ম ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে গভীরভাবে জড়িত, সেখানে ক্যাথলিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ২০২৩ সালে এক হিসাবে দেখা যায় বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ ক্যাথলিক আফ্রিকার এবং তার আগের বছর নতুন করে ৯ মিলিয়ন যুক্ত হয়েছেন।

আইভরি কোস্টের বাণিজ্যিক শহর আবিজানের এক ক্যাথলিক পাদ্রী চার্লস ইয়াপি বলেন, ‘একজন কৃষ্ণাঙ্গ পোপ হলে তা আফ্রিকায় খ্রিষ্টান ধর্মের বিশ্বাসকে নতুন করে জাগিয়ে তুলবে এবং মানুষের আফ্রিকাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাবে। এতে প্রমাণ হবে, একজন আফ্রিকানও এই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেন।’

সম্ভাব্য পোপের নামের তালিকায় কয়েকজন আফ্রিকান প্রার্থীর নাম থাকলেও তাদের কারও পোপ হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা আছে কিনা—এ নিয়ে ভ্যাটিকানের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো সন্দেহ প্রকাশ করছে। এর একটি কারণ হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর অধিকাংশ কার্ডিনালের মতো আফ্রিকান কার্ডিনালরা জনসম্মুখে তেমনভাবে যাচাইয়ের মুখোমুখি হননি।

যেসব আফ্রিকান যাজকের নাম সম্ভাব্য পোপ হিসেবে আলোচনায় আছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন—ঘানার কার্ডিনাল ৭৬ বছর বয়সী পিটার কোদও আপ্পিয়া টার্কসন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কিনশাসার আর্চবিশপ ৬৫ বছর বয়সী কার্ডিনাল ফ্রিদোলিন আমবঙ্গো বেসুংগু এবং আইভরি কোস্টের কার্ডিনাল ৬৩ বছর বয়সী ইগ্নাস বেসি ডগবো।

কার্ডিনাল টার্কসন, আমবঙ্গো ও ডগবো। ছবি: উইকিকমনস।
কার্ডিনাল টার্কসন, আমবঙ্গো ও ডগবো। ছবি: উইকিকমনস।

প্রায় এক দশক ধরে সম্ভাব্য পোপ হিসেবে কার্ডিনাল টার্কসনের নাম আলোচনায় আছে। তিনি ঘানার একটি খনিশিল্প অধ্যুষিত শহরে ১০ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান হিসেবে সাদাসিধে পরিবেশে বড় হয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ঘানায় যাজক হিসেবে কাজ করেছেন এবং পরে ভ্যাটিকানের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের নেতৃত্ব দিয়েছেন—বিশেষ করে সেই দপ্তরগুলোর, যেগুলো সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং বৈশ্বিক শান্তি নিয়ে কাজ করে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্যের মতো বিষয়েও পোপ ফ্রান্সিসের মতোই আগ্রহী।

তবে, ২০১৩ সালে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি যাজকদের যৌন কেলেঙ্কারির সঙ্গে সমকামিতার যোগসূত্র টানেন এবং বলেন, আফ্রিকায় এমন কেলেঙ্কারির সম্ভাবনা কম। এ মন্তব্যের পর তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।

সম্প্রতি কার্ডিনাল টার্কসন তাঁর আগের অবস্থান কিছুটা নরম করেছেন। ২০২৩ সালে বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সমকামিতা নিয়ে এখন আরও জ্ঞান আহরণের সময় এসেছে।’ তিনি ইঙ্গিত দেন, এটি ঘানার সমাজে পুরোপুরি অচেনা নয়।

ঘানার আর্চবিশপ জন বোনাভেনচার কোফি ১৯৭০-এর দশক থেকে কার্ডিনাল টার্কসনকে চেনেন। টার্কসনের হাতেই বিশপ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন কোফি। রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কোফি জানান, টার্কসনকে পোপ হিসেবে নির্বাচন করলে তা আফ্রিকায় ক্যাথলিক ধর্মের এই অগ্রগতির যথাযথ স্বীকৃতি হবে এবং আফ্রিকান ধর্মগুরুরাও এতে অনুপ্রাণিত হবেন।

আর্চবিশপ কোফি বলেন, ‘যদিও এটা নিয়ে আমি জোর দিয়ে কিছু বলতে পারি না, কারণ যাঁরা পোপ নির্বাচন করবেন—সেই কার্ডিনালরা পবিত্র আত্মার পথনির্দেশেই চলবেন। তবে, যদি উনিই পরবর্তী পোপ হন, তাহলে তা পুরো মহাদেশের বিশপদের জন্য উৎসাহজনক হবে।’

পোপ হওয়ার তালিকায় আরেক নাম কঙ্গোর কার্ডিনাল আমবঙ্গো। যুদ্ধ ও বিদ্রোহে জর্জরিত দেশে শান্তির পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত আমবঙ্গো ২০১৯ সালে পোপ ফ্রান্সিসের হাতে কার্ডিনাল পদে উন্নীত হন। পরে ২০২০ সালে ফ্রান্সিস তাঁকে ‘কাউন্সিল অব কার্ডিনালস’-এ অন্তর্ভুক্ত করেন।

তবে, ২০২৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস সমলিঙ্গ দম্পতিদের আশীর্বাদ অনুমোদন করার পর, আমবঙ্গো তাঁর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, এতে গির্জা নানা কেলেঙ্কারির ঝুঁকিতে পড়বে।

তালিকার আরেক কৃষ্ণাঙ্গ আবিজানের আর্চবিশপ আইভরি কোস্টের কার্ডিনাল ডগবো ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কার্ডিনাল পদে উন্নীত হন। বর্তমানে তাঁর পরিচিতিও অনেক বেড়েছে। কার্ডিনাল হয়ে ডগবো রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে কার্ডিনাল থাকলে তা গির্জার সর্বজনীনতা বাস্তবেই প্রতিফলিত করে।’

তবে কিছু যাজক মনে করেন, পোপের দেশ বা জাতি নয়, তাঁর নীতি ও বিশ্বাসই আসল।

কিনশাসায় পোপ ফ্রান্সিসের জন্য আয়োজিত এক প্রার্থনাসভায় কঙ্গোর পাদ্রী যোশুয়ে-মিসায়েল মোবাতিলা কুইলু বলেন, ‘পোপ আফ্রিকা থেকে হবেন, না অন্য কোনো মহাদেশ থেকে—এটা আমাদের হাতে নেই। তবে আমরা প্রার্থনা করি, পবিত্র আত্মা যেন গির্জাকে একজন উত্তম পথ প্রদর্শক দেন, যিনি গির্জাকে সত্যিকারের ঈশ্বরের পথে পরিচালিত করবেন।’

একজন আফ্রিকান কার্ডিনাল পোপ হলে, তা অনেকের কাছেই পোপ ফ্রান্সিসের দরিদ্র, নিপীড়িত, শরণার্থী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত নাগরিকদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা হবে।

কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি ২০২৩ সালে কঙ্গো সফরের সময় পোপ ফ্রান্সিসের বলা কথা তুলে ধরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পোপ বলেছিলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর ওপর থেকে তোমাদের হাত সরাও। আফ্রিকার ওপর থেকে হাত সরাও! আফ্রিকাকে দমিয়ে রেখো না: এটি লুটের জন্য কোনো খনি নয়, নয় দখল করার জমি।’

শিসেকেদি বলেন, এই কথাগুলো ‘কঙ্গোর মানুষের সম্মিলিত স্মৃতিতে চিরকাল খোদাই হয়ে থাকবে।’

তবে, একজন আফ্রিকান পোপ হলেও ফ্রান্সিসের মতো সমাজে অগ্রসরধারার অবস্থান—যেমন, সমকামী দম্পতিদের আশীর্বাদ দেওয়ার বিষয়টি সব সময় অনুসরণ করবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ আফ্রিকার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিক গোঁড়া ধারার।

আইভরি কোস্টের পাদ্রী চার্লস ইয়াপি বলেন, “একজন আফ্রিকান পোপ স্পষ্ট জানিয়ে দেবেন, সমলিঙ্গ সম্পর্ক ‘আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়’ এবং তিনি কখনোই এ ব্যাপারে প্রভাবিত হবেন না।”

তবে এ বিষয়ে দোটানা থেকেই যায়, কারণ পরবর্তী পোপ নির্বাচনের জন্য যেসব কার্ডিনাল ভোট দেবেন, তাদের অনেকেই এমন কাউকে নির্বাচনে সতর্ক থাকতে পারেন, যার মতামত পোপ ফ্রান্সিসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকটা ভিন্ন।

আরও পড়ুন—

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত