Ajker Patrika

যন্ত্রগুলোই যেন যন্ত্রণার সাক্ষী

আজাদুল আদনান, ঢাকা
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২২, ১২: ৩৬
যন্ত্রগুলোই যেন যন্ত্রণার সাক্ষী

মাদারীপুর সদর উপজেলার তুলি আক্তারের স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয় গত ২ অক্টোবর ফরিদপুর শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অস্ত্রোপচার শেষ রেডিওথেরাপির জন্য পাঠানো হয় ঢাকায় জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ)। কিন্তু রেডিওথেরাপির জন্য তাঁকে আগামী বছরের মার্চে আসতে বলেন চিকিৎসকেরা।

জরায়ু ক্যানসার নিয়ে নরসিংদীর বেলাব থেকে আসা জাহান আরা বেগম (৪২) বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখাতে পারলেও থেরাপির জন্য তারিখ পাচ্ছেন না। ২ নভেম্বর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগের এক পাশে কপালে হাত দিয়ে বিমর্ষ অবস্থায় বসে আছেন তাঁর স্বামী ফরিদ হোসেন। কারণ জানতে চাইলে স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারার কথা বলে কান্না জুড়ে দেন।

তিনি বলেন, ‘এ দেশে গরিবদের অসুখ অইতে নাই।’

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন কয়েক শ রোগী এলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না দেশের একমাত্র বিশেষায়িত এই সরকারি প্রতিষ্ঠান। থেরাপির তারিখ পাওয়ার আশায় মেঝে ও সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখা যায় অনেক রোগীকে। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বছরখানেক ধরে একটিমাত্র যন্ত্র দিয়ে রেডিওথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। গত বছরের শেষ নাগাদও দুটি যন্ত্র সচল ছিল।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আগে এ হাসপাতালে ক্যানসারের অধিকাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো। কিন্তু রোগনির্ণয় ও থেরাপির দুই-তৃতীয়াংশ যন্ত্রই অকেজো দীর্ঘদিন ধরে। দু-একটি যন্ত্র সম্প্রতি নষ্ট হলেও মেরামতের উদ্যোগ নেই।

অচল যন্ত্রের ছড়াছড়ি
রেডিওথেরাপির জন্য নব্বই দশক থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে চারটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর ও দুটি কোবাল্ট এক্সিলারেটর কেনা হয়। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় চারটি যন্ত্র বাতিল ঘোষণা করা হয় ২০১০ সালের আগেই।

একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর সম্প্রতি নষ্ট হয়েছে। এখন একটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর দিয়েই চলছে সেবা।

দেড় যুগ আগে একটি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) যন্ত্র যুক্ত করা হয়েছিল। দেড়-দুই বছর চলার পরই যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়লেও সেটি সারানো কিংবা নতুন যন্ত্র কেনা হয়নি।

দুটি এক্স-রে যন্ত্রের একটি অনেক আগে থেকেই বিকল, অন্যটিও এক বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট। ফলে এক বছর ধরে হচ্ছে না এক্স-রে। দুটি সিটি স্ক্যান যন্ত্রের একটিও নষ্ট বছরখানেক ধরে।

এন্ডোস্কোপির দুটি যন্ত্রের মধ্যেও একটি নষ্ট হয়েছিল কয়েক বছর আগে, অন্যটিও সম্প্রতি নষ্ট হয়েছে। ফলে এন্ডোস্কোপিও বন্ধ। কোলনোস্কোপির একটি যন্ত্র কয়েক বছর ধরে অকেজো, আরেকটি নষ্ট হয়েছে মাস ছয়েক আগে।

একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স জানান, দুই বছর আগেও তিন হাজারের মতো রোগীকে রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া যেত, এখন সেটি অর্ধেকে নেমেছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেক মানুষকে এক থেকে ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।

এনআইসিআরএইচে জরুরি যন্ত্রপাতি অকেজো থাকার বিষয়ে পরিচালকের দায় আছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব হাসপাতালের পরিচালকের। মেশিন নষ্টের বিষয়টি তো নতুন নয়। সময় থাকতে যন্ত্রগুলো কেনার প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার ছিল। এখন বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে চাইলেও সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে না।

পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে
সরকারি এই হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা না থাকা বা কম থাকার ফায়দা নিচ্ছে আশপাশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে হাসপাতালের কয়েক শ মিটার দূরে অবস্থিত লাইফ কেয়ার মেডিকেল সেন্টার এবং বাড্ডার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে এ হাসপাতালে আসা বেশির ভাগ রোগীকে। এনআইসিআরএইচের অনেক চিকিৎসক পরীক্ষার জন্য নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানের নামও বলে দেন রোগীদের। অভিযোগ আছে, রোগী পাঠানোর বিনিময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে লোভনীয় কমিশন পান সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।

জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ব্লাড ক্যানসারের রোগীদের জন্য নির্ধারিত বিনা মূল্যের শয্যা সাতটি। একটিতে ভর্তি নরসিংদীর তাসলিমা আক্তার গত রোববার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৩০টির বেশি পরীক্ষা করিয়েছি, যার ২২টিই বেসরকারি হাসপাতালে। পরীক্ষার জন্য এখানকার ডাক্তাররাই পপুলার, লাইফ কেয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠান, বিশেষ করে পপুলারে। শুনেছি, এখানকার ডাক্তাররা কমিশন পান।’

অনেক রোগী ও জনস্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের একাধিক সংগঠকের অভিযোগ, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এর মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালে জরুরি যন্ত্রপাতি সচল রাখতে তেমন উদ্যোগী হন না। এনআইসিআরএইচের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও এর সত্যতা স্বীকার করেন। তবে পরিচয় প্রকাশ করে কিছু বলতে তিনি রাজি হননি। তাঁর দাবি, অসাধু পথে না চলার খেসারত এমনিতেই তাঁকে দিতে হচ্ছে বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিত থেকে। তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে কম যন্ত্রপাতি দিয়েও সেবা অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব হাসপাতালে আরেকটি শিফট চালু করে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন নির্দেশনাও ছিল বেশ কয়েক বছর আগে। চিকিৎসক ও কর্মীদের লাভে টান পড়বে বলেই সে নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।’

হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুশতাক আহমেদ জালালি অবশ্য বলেন, ‘যন্ত্র কেনার জটিলতা কাটাতে না পারার সুযোগে হয়তো দু-একজন রোগী বাইরে পাঠিয়ে সুবিধা নিয়ে থাকতে পারে, সবাই নন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি হয়তো পুরোপুরি নয়; তবে হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা লেগেই থাকে। প্রয়োজনীয় যন্ত্র কিনতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এই সুযোগে অনেক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে রোগী পাঠান।’

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ২ নভেম্বর হাসপাতালের তখনকার পরিচালক অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যালয়ে গেলে তিনি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।

ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজের স্বার্থের জন্য অন্যত্র রোগী পাঠানো অনৈতিক। সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালেই করতে হবে। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নিজামুল হক গত রোববার হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন। পরে মঙ্গলবার রাতে তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র দায়িত্ব নিলাম। উদ্যোগ নিয়েছি, কীভাবে দ্রুত যন্ত্রগুলো কেনা ও সচল করা যায়, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত