Ajker Patrika

পাহাড়ে পথে পথে চাঁদাবাজি

আবু বকর ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২২, ১৭: ৩১
পাহাড়ে পথে পথে চাঁদাবাজি

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ২৬টি উপজেলায় পথে পথে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। দুর্গম গ্রাম থেকে শহরতলির বাসিন্দা, কারও যেন এর থেকে রেহাই নেই। আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কথামতো চাঁদা না দিলেই নেমে আসে হত্যা, অপহরণসহ নানা অত্যাচারের খড়্গ।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে চাঁদাবাজি চলে সময়ভেদে। দৈনিক, মাসিক ও বার্ষিক তো আছেই; মৌসুম অনুযায়ী টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা নেওয়া হয়। চাঁদা আদায়কারীদের নিয়ে টুঁ শব্দ করবেন, সে সাহসও যেন কারও কুলায় না। ব্যবসায়ী, বাগানমালিক, ঠিকাদার, পরিবহন, বোট, ট্রলার, কৃষিপণ্য, সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, জমি বেচাকেনা—চাঁদার আওতামুক্ত কিছু নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক চাঁদাবাজির কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুই বছরে দফায় দফায় রাঙামাটিতে বৈঠক করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চুক্তির আলোকে পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পে আর্মড পুলিশ মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়। সে হিসাবে তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। 

চাঁদার শিকার ব্যক্তিদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোথাও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), কোথাও পার্বত্য চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক  ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), কোথাও জেএসএস (সংস্কার), আবার কোথাও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)—এসব আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র বিভাগের নামেই চাঁদা তোলা হয়। যদিও সংগঠনগুলো অভিযোগ অস্বীকার করছে।

চাঁদাবাজির ভয়াবহতা তুলে ধরে ভুক্তভোগীরা জানান, ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে চাঁদা না দেওয়ায় চালবোঝাই একটি ট্রাক জ্বালিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এর আগে ২০০৯ সালে খাগড়াছড়ির এক প্রভাবশালী ঠিকাদারকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। পরে অবশ্য মোটা অঙ্কের মুক্তিপণে ছাড়া পান তিনি। সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই চাঁদা না দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার গচ্ছাবিল এলাকার আবুল হাসেমের বাগানের প্রায় ৫০০ ফলদ গাছ কেটে ফেলে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিবদমান সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের কর্তৃত্বাধীন এলাকায় নিজেদের সংগ্রাহক (কালেকটর), সহকারী সংগ্রাহক বসিয়ে পুরো পার্বত্য এলাকায় চাঁদাবাজি চালাচ্ছে।
প্রশাসনের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বছরে চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো অন্তত ৪০০ কোটি টাকার চাঁদা তোলে। বেপরোয়া চাঁদাবাজি কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের

জনজীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই চাঁদাবাজি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে করে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। 
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির (এমএন লারমা বা সংস্কার) গবেষণা, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দিবাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা চাঁদা নেই না। তবে পার্টি পরিচালনা করতে কিছু সহযোগিতা নিয়ে থাকি। এটাকে আমরা চাঁদা বলি না। অন্যরা কে, কী করে, আমি তা বলতে পারি না।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার চাঁদাবাজি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

বাংলাদেশ খাদ্য পরিবহন সমিতির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল হাই বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো এত বেশি বাড়াবাড়ি করেছে, যা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়, ইনভয়েসসহ কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া, চালকদের মারধর করার কারণে খাদ্য সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফলে গত বছরের ১৯ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ খাদ্য পরিবহন বন্ধ করে দিই। অবশ্য পরে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার পর নিরাপত্তার আশ্বাসে পুনরায় খাদ্য পরিবহন শুরু করি।’

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘চাঁদাবাজির কারণে জেলার কয়েকটি গুদামে খাদ্য পরিবহনে সমস্যা হয়েছিল। আমরা তা আলোচনা করে সমাধান করেছি। এখন আর খাদ্য পরিবহনে সমস্যা নেই।’

খাগড়াছড়ি চেম্বারের পরিচালক স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো মানুষ চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ী, কৃষক, চাকরিজীবী—সবাইকে চাঁদাবাজদের নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এই অঞ্চলের বিবদমান চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো নিয়মিত স্পট, মাসিক, ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক চাঁদা আদায় করে চলেছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত