Ajker Patrika

অন্তরালের শহীদের বীরত্বগাথা

মাদারীপুর প্রতিনিধি
Thumbnail image

মাদারীপুর রাজৈর উপজেলা খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ১৯ মে এখানেই সংঘটিত হয়েছিল নারকীয় গণহত্যা। এদিন ১২৬ জন মুক্তিকামী নর-নারীকে স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই ইতিহাস ঢাকা পড়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে। অনেকেই জানেন না মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগের সেই কাহিনি।

ঘটনার দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরা শচিন বারিকদার জানান, সেনদিয়ার হত্যাকাণ্ডে শহীদের তালিকায় নাম না জানা আরও অনেকে রয়েছেন। তেমনি একজন অমূল্য কুণ্ড।

চোখের সামনেই তিনি (অমূল্য কুণ্ড) দেখেছেন মায়ের করুণ মৃত্যু। পরে খোঁজ মেলেনি অমূল্যেরও। শহীদদের তালিকায় অমূল্যের নাম থাকলেও মায়ের নাম না জানায় নেই তাঁর নাম। ধারণা করা হয়, সেই দিন অমূল্যকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

সেদিন এই বেদনাদায়ক ঘটনার পর ঘটে আরেক মর্মস্পর্শী ঘটনা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে সেনদিয়ায় লাশের ওপর লাশ পড়ে থাকে। ঠিক সেই সময়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া ৪ মাসের শিশু প্রভাষ রক্তাক্ত উঠানে হামাগুড়ি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত তার মাকে খুঁজে বের করে দুধ খাওয়ার সেই দৃশ্য আজও বেঁচে যাওয়া সেনদিয়ার প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের মুখে মুখে।

১৯৭১ সালের ১৯ মে এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রাম। ১২৬ জন মুক্তিকামী নর-নারীকে স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।

এ ব্যাপারে একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট বন্দরে সেনাক্যাম্প স্থাপন করেছিল। সে সময় রাজৈর অঞ্চলে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। হানাদার বাহিনী লঞ্চে গোপালগঞ্জের ভেন্নাবাড়ী ঘাটে নেমে চরমাচটা এলাকা থেকে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এরপর তারা সুকৌশলে রাজৈরের সেনদিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। তখন সেনদিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধরাও বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে।

অনেকেই জীবন বাঁচানোর জন্য কোনো উপায় না পেয়ে পশ্চিম সেনদিয়া গ্রামের একটি আখখেতে আশ্রয় নেন। ততক্ষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনারা অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে নির্বিচারে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পশ্চিম সেনদিয়া ফকিরবাড়ির ভিটায়, সেনদিয়া বাওয়ালী ভিটায়, বারিকদার বাড়ির উত্তর বাঁশবাগানে, শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিণ খালপাড় এবং ছাতিয়ানবাড়ির পুকুর পাড়ে। কারও চোখ বেঁধে, হাত-পা বেঁধে, বাবা-মায়ের সামনে সন্তানকে, সন্তানের সামনে বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আবার কাউকে বুটজুতা দিয়ে লাথি মেরে ক্ষতবিক্ষত করে আগুনে পুড়িয়ে বা গুলি করে হত্যা করে।

দীর্ঘ সময় এই হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ফেরার উদ্দেশ্যে পশ্চিম সেনদিয়া গ্রাম দিয়ে যেতেই আখখেতে মানুষের শব্দ পেয়ে ব্রাশফায়ার করে হানাদার বাহিনী। নিমেষেই প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধ শেষে গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরের মিশনারি ফাদার মারিনো রিগন বেঁচে যাওয়া ৪ মাসের শিশু প্রভাষকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। পরে ফাদার মারিনো রিগনের সঙ্গে প্রভাষ আমেরিকা চলে যায়। বর্তমানে তিনি আমেরিকার প্রবাসী এবং মোশী বাড়ৈ নামে পরিচিত।

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, দীর্ঘ সময় পাড় হলেও সেনদিয়া গণহত্যার ঘটনা নিয়ে কোনো ইতিহাস গবেষক গবেষণা করেননি বা তেমন লেখালেখিও হয়নি। তবে ২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল মোশী বাড়ৈয়ের সার্বিক প্রচেষ্টায় ও বানিয়ারচরের মাইকেল বাড়ৈয়ের তত্ত্বাবধানে সেনদিয়া গ্রামে একটি শহীদ স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। এই স্মৃতিফলকে ১২৬ জনের নাম লেখা হয়। শুধু অমূল্য কুণ্ডের মা যাঁকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তাঁর নাম না জানার কারণে লেখা সম্ভব হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুরের সেনদিয়ার গণহত্যার কথা জেলার মানুষ আজও ভোলেনি। তবে এই গণহত্যার ঘটনাগুলো তেমন প্রচার হয়নি। তাই নতুন প্রজন্ম অনেকেই এই গণহত্যার কথা জানেন না। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত