Ajker Patrika

অকেজো রাবার ড্যামে ফিকে কৃষকের হাসি

হোসেন রায়হান, পঞ্চগড়
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২১, ১৫: ৫৯
অকেজো রাবার ড্যামে ফিকে কৃষকের হাসি

নদী তীরবর্তী ১৯ গ্রামের কৃষকদের সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য পঞ্চগড়ের তালমা নদীতে নির্মাণ করা হয় একটি রাবার ড্যাম। এই রাবার ড্যাম চালুর পরের বছর থেকে স্বল্প খরচে সেচ সুবিধা পেতে শুরু করেন ওই এলাকায় কৃষকেরা। হাসি ফুটে তাঁদের মুখে। নতুন দিগন্তের সূচনা হয় বোরোসহ রবি শস্য চাষে। কিন্তু কৃষকের সেই হাসি ফিকে হতেও সময় লাগেনি। বড় ধরনের ত্রুটি দেখা যাওয়ার ২০১৪ সাল থেকে রাবার ড্যামটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে অকেজো পড়ে আছে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ড্যামটি।

ড্যাম অকেজো হয়ে পড়ায় প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা ক্যানেলগুলো যেমন ভরাট হতে চলেছে, তেমনি কৃষকেরা বোরো মৌসুমে সেচের অভাবে বোরো বাদ দিয়ে অন্য আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। নদী প্রায় শুকিয়ে থাকায় রাবার ড্যামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রটিও এখন পর্যটকশূন্য।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) পঞ্চগড় সূত্রে জানা যায়, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি নদীতে ১০টি রাবার ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে পঞ্চগড় সদর উপজেলার তালমা নদীতে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রাবার ড্যামটি নির্মাণ করা হয়। একই সঙ্গে ওই নদীসংলগ্ন হাফিজাবাদ ও কামাত কাজলদিঘী ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় সেচ সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় পানিপ্রবাহের নালা বা ক্যানেল। এতে ১৯টি গ্রামের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসার কথা। তবে রাবার ড্যামটি চালুর পরের বছর থেকে স্বল্প খরচে সেচ সুবিধা পান প্রায় ১০ গ্রামের কয়েক শ কৃষক।

শুরুতে তালমা রাবার ড্যাম থেকে পূর্বদিকে মামা-ভাগিনা ব্রিজ হয়ে উত্তরে বিশমনি পর্যন্ত এবং দক্ষিণে কুচিয়া মোড় পর্যন্ত কৃষকেরা সেচ সুবিধা পেতেন। এ ছাড়া জালাসী, তালমা, চছপাড়া, বামনপাড়া, খোংগাপাড়া, ডিয়াবাড়ি, টেংনাপাড়া, বড়দহ, ঠুটাপাকুরী, পাথরডোবাসহ প্রায় ১০টি গ্রামের কৃষকেরা বোরো চাষ করতেন এই ড্যামের পানি দিয়েই। এতে বোরোসহ রবি শস্য চাষে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ড্যামের রাবার ব্যাগে বাতাস ঢুকিয়ে প্রায় ১২ ফুটের মতো ফোলানোর ফলে নদীর পানি ক্যানেল দিয়ে চলে যেত বহুদূর পর্যন্ত। রাবার ড্যামটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতিও গঠন করা হয়। এই সমিতির সদস্য সংখ্যাও কম নয়, ৪৬৫ জন।

রাবার ড্যামটি নির্মাণের পর প্রথম এক বছর পুরোদমে সুবিধা পেলেও পরবর্তী বছরগুলোয় স্বল্প পরিসরে সেচ সুবিধা পাচ্ছিলেন কৃষকেরা। বড় ধরনের ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে রাবার ড্যামটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া ২০১৭ সালের বন্যায় ড্যামের পানিপ্রবাহের নালাটির বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২০১৮ সালে সমিতির সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর রাবার ড্যামটির পূর্ব অংশের রাবার ব্যাগের ৮ ইঞ্চি ফেটে যাওয়া অংশ সংস্কারকাজ করে পুনরায় চালু করে দেয়। কিন্তু রাবার ব্যাগ ৪-৫ ফুটের ওপর ফোলাতে না পারার কারণে নদীতে বেশি পানি ধারণ করতে না পারায় কৃষকেরা এতে করে সুবিধা পাননি। বিশেষ করে ক্যানেলে পানি নিতে না পারার কারণে প্রকল্পের প্রায় সব জমি আগের মতোই সেচমুক্ত থাকে। তবে নদীর উজানে কৃষকেরা বোরো চাষ করায় ওই মৌসুমে রাবার ড্যামটি পুরোপুরি ফোলানো সম্ভব হয়নি বলে জানান সমিতির নেতারা। চলতি বছর ড্যামের রাবার ব্যাগ ফোলাতে গিয়ে পূর্বে সংস্কার করা অংশে আবারও এক মিটার ফেটে যায়। এতে করে পুনরায় সংস্কারকাজ করতে না পারায় পরবর্তী সময়ে দেখা যায় কে বা কারা এক মিটার ফাটা অংশে তিন মিটার জুড়ে কেটে দিয়েছে। কিছুদিন আগে এলজিইডি ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ড্যামের উজানে নদী থেকে পাথর-বালি ও মাটি ব্যবসায়ীরা শুরু থেকে চাচ্ছিলেন না রাবার ড্যামটি সচল থাকুক। কারণ ড্যামের রাবার ব্যাগে পুরো বাতাস ঢুকালে নদীর উজানে পানির উচ্চতা ১২ ফুট বেড়ে যায়। এতে করে তাদের প্রায় ৬ মাস বসে থাকতে হয়। তাই এসব অসৎ ব্যবসায়ী বিভিন্নভাবে পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির ওপর নাখোস। ফলে রাবার ব্যাগের তিন মিটার কেটে দেওয়ার বিষয়টিকে নাশকতা হিসেবে দেখছে রাবার ড্যাম পানি ব্যবস্থাপনা কমিটি। এ নিয়ে ৭ জনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি অভিযোগ দাখিল করেছেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেন।

তালমা রাবার ড্যাম পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেন বলেন, এলজিইডি কর্তৃপক্ষ আবারও রাবার ড্যামের ব্যাগ সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ড্যামের আশপাশের কিছু মানুষ আমাদের কমিটির লোকজনের হুমকি দিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘আগে তিন মিটার ফাটিয়েছি। আবারও সংস্কারের উদ্যোগ নিলে গোটা রাবার ব্যাগ নষ্ট করে দেব। এতে কেউ বাধা দিলে পায়ের রগ কেটে দেব।’ তিনি বলেন, এই ঘটনার পর থেকে আমরা পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সব সদস্য শঙ্কার মধ্যে আছি। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানিয়েছি।

পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, কৃষকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে তালমা নদীতে রাবার ড্যামটি স্থাপন করা হয়। এই পানি আয়রনমুক্ত হওয়ায় এবং প্রচুর পলি থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির চেয়ে বেশি উপকারী। তবে রাবার ড্যামটি ফুটো হয়ে যাওয়ায় কারণে এখন বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি এলজিইডি কর্তৃপক্ষ দ্রুত সমাধান করবেন বলে আশা করছি।

পঞ্চগড় এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ফুটো হয়ে যাওয়ার কারণে রাবার ড্যামটি অচল হয়ে আছে। গত বছর সংস্কার করা হলেও এবার রাবার ব্যাগের গোড়ায় তিন মিটারের বেশি ফেটে রয়েছে, যা স্থানীয় জনবল দিয়ে সংস্কার করা সম্ভব নয়। চলতি মৌসুম শেষ। তাই আমি চেষ্টা করছি আগামী মৌসুম আসার আগেই ড্যামটি সংস্কার করার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত