Ajker Patrika

দাঙ্গার বিলে বালু লুটের হাঙ্গামা

মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ৫০
দাঙ্গার বিলে বালু লুটের হাঙ্গামা

কোথাও ১৫ ফুট, কোথাও ২০, আবার কোথাও ৩০ ফুট গভীর করে কেটে নেওয়া হয়েছে মাটি। এখন শ্যালো মেশিন দিয়ে আরও গভীর থেকে তোলা হচ্ছে বালু। গত এক বছর চলছে এভাবে মাটি ও বালু লুটের ঘটনা। ভূমিতে এমন ধ্বংসযজ্ঞের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বিলের এক পাশের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক এবং অন্য দুই পাশের পাহাড়ি টিলার গ্রাম। এরই মধ্যে হেলে পড়েছে সাফারি পার্কের নিরাপত্তা দেয়াল। যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে আশপাশের পাহাড়।

মাটি ও বালু লুটের এই দৃশ্য কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের দাঙ্গার বিলে। বিশাল এ বিলের কিছু জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত বলে জায়গাটি ‘দাঙ্গার বিল’ নামে পরিচিতি পায়। জমির মালিকানা নিয়ে সম্প্রতি কোনো দাঙ্গা না ঘটলেও বর্তমানে এই বিলে নতুন হাঙ্গামা বা উৎপাত শুরু হয়েছে বালু তোলা নিয়ে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র এই বিল ও আশপাশের সরকারি বনভূমিতে এক্সকাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) ও শ্যালো মেশিন দিয়ে মাটি ও বালু লুট করে চলেছে। পরিবেশবিধ্বংসী এমন উৎপাতে বিস্ময় প্রকাশ করলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মাঝেমধ্যে প্রশাসনের লোকজন অভিযান চালালেও তাঁরা চলে যাওয়ার পরক্ষণে আবারও শুরু হয় অবৈধভাবে বালু তোলা। কাউকে তোয়াক্কা না করেই রাত-দিন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় মোহাম্মদ সজিব, সাইফুল এহেসান, মিনহাজ উদ্দিন জিকু, মাইনুল এহেসান চৌধুরী, রেজাউল ওরফে সোনা মিয়া, নেজাম উদ্দিন, বদিউল আলম, জিয়াউল করিম, নজরুল কোম্পানী, আবদুল হামিদ, আরমানুল হক চৌধুরীসহ ৪৫-৫০ জনের একটি চক্র।

দাঙ্গার বিলে ২০ একরের মতো জমি রয়েছে স্থানীয় রেজাউল করিম চৌধুরীর। তিনি গত বছর থেকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে মাটি ও বালু লুটের অভিযোগ করে আসছেন। কিন্তু এসব দপ্তর কড়া কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ এই ভূমিমালিক বলেন, ‘মাটি ও বালু লুটের অভিযোগ করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কেউ কথা শুনছে না। ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে এ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বালুদস্যুরা।’

সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে পূর্বদিকে গেলেই উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলার রংমহল গ্রাম। এ গ্রামের হিন্দুপাড়ার উত্তরে লাগোয়া দাঙ্গার বিল। এ বিলের উত্তর দিকে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পশ্চিম পাশে ধানিজমি ও বাড়িঘর। পূর্ব পাশেও খাল, পাহাড় ও ধানিজমি। এর মাঝখানের বিশাল বিলজুড়ে চলছে মাটি ও বালু লুটের ঘটনা। পাহাড়ি টিলা, গাছগাছালি, ছড়া ও খালের মেলবন্ধনের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এই রংমহল গ্রামের রং এখন ধুলোয় ধূসর। পাল্টে গেছে গ্রামের সবুজ প্রকৃতি।

রংমহল হিন্দুপাড়া থেকে ওই বিলে ঢুকতে একটি তল্লাশি চৌকিও বসানো হয়েছে। এই চৌকির সামনে আধা ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা যায় ২৫টি ডাম্পট্রাক ও মিনিট্রাক ঢুকেছে। আশপাশের পাড়া ও রাস্তায় মজুত করে রাখা হয়েছে বিশালাকৃতির কাদা-বালুর স্তূপ। সেখান থেকে ২০-২২ মেট্রিক টনের বড় ট্রাক ভর্তি করা হচ্ছে।

অভিযুক্তদের একজন মোহাম্মদ সজিব এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা জমির মালিকদের খাজনা দিয়ে বালু ও মাটি কাটছি।’ বালু তোলার কোনো অনুমোদন আছে কি না জানতে চাইলে সজিব বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা দিচ্ছে, তা আইনিভাবে মোকাবিলা করব, জরিমানা দেব।’

সম্প্রতি বালু ও মাটি লুট বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান বন সংরক্ষক, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনকে আইনি নোটিশ দিয়েছে

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)।

ইয়েসের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহীম খলীল মামুন বলেন, যেভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে বালু উত্তোলন করছে, তাতে সেখানে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

নিরাপত্তা দেওয়ালের পাশ থেকে বালু ও মাটি কেটে ফেলায় পার্কটিও এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। অন্যদিকে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় ২৬ জনকে নোটিশ করা হয়েছে। জনবলসংকটে পর্যাপ্ত অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

জেলা প্রশাসনের বালুমহাল ইজারার তথ্যে জানা গেছে, ডুলাহাজারা-২ বালুমহালটি শর্তসাপেক্ষে ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। ইজারাদারের বালুমহালের সীমানা বগাচতর মৌজার ছড়ায় ৮ দশমিক ৬ একর এলাকা হলেও প্রায় ছড়ার আশপাশের অন্তত ১০০ একর ফসলি জমি ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গা থেকে বালু-মাটি তোলা হচ্ছে।

বালুমহালটি ইজারা নিয়েছেন মেসার্স রাফি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. কাউছার উদ্দিন কছির। তিনি চকরিয়া উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। জানতে চাইলে মো. কাউছার উদ্দিন কছির বালু লুটের ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার লাইসেন্সে ইজারা নেওয়া হলেও সেখানে অন্তত ১০০ জনের মতো জড়িত।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত