Ajker Patrika

ধনীর হস্তে চুরি অন্ধের জমি

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল, ঢাকা
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৩, ১২: ৩৭
ধনীর হস্তে চুরি অন্ধের জমি

মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের সনি সিনেমা হল আর মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স, মাঝে এক বিশাল বাণিজ্যিক ভবন—মিরপুর নিউমার্কেট। তিন বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা ১৫ তলা ভবনটি আদতে অন্ধ কল্যাণ সমিতির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কিন্তু সেই সমিতির কেউই আর নেই সেখানে। তাদের বদলে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি সবই দখল করে নিয়েছেন। তিনি সেখানে ভবন বানিয়ে বিক্রি করে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন সবার চোখের সামনে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু ‘কাঙালের ধন চুরি’ করা রাজার কাছে তাঁরা আর টিকতে পারেননি। সাড়ে ৪ লাখ বর্গফুটের ভবনে তাঁদের ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ৫ হাজার বর্গফুটের জায়গা।

সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বা যাঁদের এসব দেখভাল করার দায়িত্ব, তাঁরা সবই জানেন। কিন্তু কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেন না। অনেকটা ভাশুরের নাম মুখে না নেওয়ার মতো।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বা জাগৃকের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) জোর্য়াদার তাবেদুন নবী বলছেন, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কিছু বিষয়ে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। ফাইল পর্যালোচনা করে দেখা গেল, প্লটটি নকশায় প্রাতিষ্ঠানিক প্লট, যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভবনের তলাগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, আইন অনুযায়ী যা করার কোনো সুযোগই নেই।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কী করে সেই সুযোগ পেল? এর সহজ উত্তর, টাকার কাছে সবই বিক্রি হয়ে গেছে। আর সেই সুযোগে অসহায় মানুষের সম্পদ গ্রাস করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা।

যে ভবন ঘিরে এত কথা, তার একটি ইতিহাসও আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য ৬০ কাঠার এই জায়গা বরাদ্দ দেন। একসময় সেখানে বসে নানা ধরনের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ নিতেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। কিন্তু এত দামি জমি কত দিন আর এভাবে পড়ে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই চোখ পড়ে চক্ষুষ্মাণ প্রভাবশালীদের। তারা পরিকল্পনা করে উঁচু ভবন নির্মাণের পর তা বিক্রির।

কিন্তু গোল বাধল প্লটটির শ্রেণি নিয়ে। এটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) আওতাধীন একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট। এটা কোনোভাবেই বাণিজ্যিক হতে পারে না। চিন্তা কি! উদ্ধারে এবার মাঠে এলেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁদের পাত্রে ঘি ঢালল মল্লিক এন্টারপ্রাইজ নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বলতে গেলে তারাই এখন এই ভবনের মালিক। 

যেভাবে বরাদ্দ হলো
‘প্রাতিষ্ঠানিক’ শ্রেণির প্লটটি বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির নামে বরাদ্দ হয় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন। এটা দেখভাল করার জন্য ১৯৭৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানকে। কারণ, তিনি এ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ২০০১ সাল পর্যন্ত আইভি রহমান দেখভালও করেছেন। সে সময় বলা হতো, বঙ্গবন্ধুর হাতে বরাদ্দ দেওয়া এটি রাজধানীর সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা।

ক্ষমতার হাতবদল
বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালে অন্ধ কল্যাণ সমিতির নেতৃত্ব থেকে আইভি রহমানকে সরিয়ে দায়িত্ব নেন বিএনপির নেতা আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। খন্দকার মাহবুব দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ প্লটের কর্তৃত্ব চলে যায় তৃতীয় পক্ষের হাতে। একপর্যায়ে সেখান থেকে সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উৎখাত করা হয়। এরপর ২০০৮ সালের দিকে বহুতল মার্কেট নির্মাণকাজ শুরু হয়। অল্প দিনের মাথায় ভবনও উঠতে থাকে।

প্রায় ১৮ বছর এই ভোকেশনাল সেন্টারে কাজ করেছেন নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বাসিন্দা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শামসুল শেখ। আজকের পত্রিকা’কে তিনি বলেন, এখানে একসময় বাচ্চাদের চক, হাতের ব্যান্ডেজের জন্য তোয়ালে, বসার মোড়াসহ নানা জিনিস তৈরি হতো। একদিন এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সবার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বের করে দেন। শামসুল বলেন, ‘আমি এখন নিউমার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটের সামনে ভিক্ষা করি।’ অন্ধ কল্যাণ সমিতির আরেকজন সদস্য শিহাব উদ্দিন। তিনি বললেন, দীর্ঘ সময় এখানে ছিলাম। এখন আর আমাদের কিছুই নেই।’

ফাইল ঘিরে সন্দেহ
এই ভবন বিষয়ে আজকের পত্রিকার হাতে কিছু নথি এসেছে। সেগুলোতে দেখা গেল, ভবনটি নির্মাণের জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মল্লিক এন্টারপ্রাইজ একেক স্থানে একেক রকম তথ্য দিয়েছে। তথ্যের কোনো মিল বা ধারাবাহিকতা নেই। এমনকি নথির গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠা ও নোটের অনুচ্ছেদের ক্রমিক নম্বরেও ঘষামাজা করা হয়েছে। দেখা গেছে, একই ক্রমিক নম্বরে একাধিক পাতা রয়েছে। আবার একেক পাতায় লেখার ধরন ও ব্যবহার একেক রকম, কালিও ভিন্ন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেছেন, কয়েক বছরে গৃহায়ণের সম্পত্তি বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা মিলে পুরোনো পাতায় অবিকল লেখার জন্য দুষ্প্রাপ্য কালি সংগ্রহ করেছেন, যা দিয়ে নতুন করে লেখা হয়েছে। সমিতির একটি চিঠিতে দেখা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক প্লটে আমমোক্তার নিয়োগসংক্রান্ত অভিযোগের পর সমিতির সংশ্লিষ্ট ইজারা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কাউকে আমমোক্তার দেওয়া যাবে না বা দেননি মর্মে অঙ্গীকার করা হয়েছে। কিন্তু আরেকটি অংশে দেখা যায়, একটি পক্ষ কাগজপত্র তৈরি করে ডেভেলপার নিয়োগের কথা বলেছে। এই প্লট সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশের পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সে কারণে আইন অনুসারে সমিতির পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আমমোক্তারনামা দিতে হলেও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি লাগবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাগড়া
নথিপত্রে দেখা যায়, এ প্লট নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশ রয়েছে। ২০০৩ সালের ১৭ মে স্বাক্ষরিত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব কামার জাহানের পত্রে বলা হয়, ‘মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের মেইন রোডের ৪ নম্বর প্লটটি বাংলাদেশ ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইন্ড (বিএনএসবি) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। সম্প্রতি জানা যায়, উক্ত ট্রাস্টের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বহুতলবিশিষ্ট সুপারমার্কেট নির্মাণের জন্য ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা বিধিবহির্ভূত।

সরকারের বরাদ্দসংক্রান্ত নির্দেশিকা-২০০৮ অনুসারে, প্রাতিষ্ঠানিক প্লটকে বাণিজ্যিক হিসেবে সম্পূর্ণ/আংশিক ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক প্লটকে আবাসিক হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে না। কাউকে আমমোক্তারনামাও দেওয়া যাবে না। 

সরেজমিনে যা দেখা গেল
এই বিশাল ভবনে এখন রয়েছে শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক, কনভেনশন হল, মোবাইল মার্কেট, ফুড কোর্টসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন অফিসও। বিশাল এই মার্কেটের একটি অংশে অর্থাৎ উত্তর পাশে বেসমেন্টে প্রবেশপথে এখনো একটি সাইনবোর্ড রয়েছে। যেখানে লেখা রয়েছে ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ফর দ্য ব্লাইন্ড’। মার্কেটের দুটি বেসমেন্টে থাকা প্রায় ৮০ হাজার বর্গফুট পার্কিংও যানবাহন রাখার জন্য ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।

সেখানে থাকা লোকজন বললেন, ৬০ কাঠা জমির ওপর দোতলা বেসমেন্ট ছাড়াও ১৩ তলা ভবনের অনেকাংশ বেচাকেনা হয়ে গেছে। এ প্লটে নিচ থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতি ফ্লোরে ৩৯ হাজার ৬০০ বর্গফুট করে মোট ২ লাখ ৩৭ হাজার বর্গফুট জায়গা রয়েছে। ৭ তলা থেকে ১৩ তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় ৩১ হাজার বর্গফুট করে মোট ২ লাখ ১৭ হাজার বর্গফুট জায়গা আছে। সেই হিসাবে মোট জায়গা রয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০ বর্গফুট।

ভবন নির্মাণকারীদের থেকে কিনেছেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গড়ে ৪০ হাজার টাকায় প্রতি বর্গফুট বিক্রি ধরা হলে সর্বমোট ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০ বর্গফুট জায়গার বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মূল প্লটের বাইরেও ২২ কাঠা সরকারি জমি রয়েছে। এই জমির মূল্য কমপক্ষে ৮০ কোটি টাকা। এ জমিটুকুও ভবন নির্মাণে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি ফ্লোরে নামমাত্র ৫ হাজার বর্গফুটের মতো জায়গা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের জন্য রাখা হয়েছে।

নিচতলায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে একটি দোকানের জন্য জায়গা কিনেছেন মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি ৯ বছর আগে যখন ভবনের কাজ শুরু হয়, তখনই ৫০ হাজার টাকা বর্গফুটের একটি দোকানের পজেশন কিনেছি। তখন প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে তারা বিক্রি করেছে। অনেকেই তা কিনেছেন। কিন্তু কেউ জানতেন না যে এখানে আইনি জটিলতা আছে। এখন রেজিস্ট্রেশন করার জন্য চাপ দিলেই তারা ঘোরাচ্ছে। 

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মল্লিক এন্টারপ্রাইজ
মল্লিক এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান মল্লিকের নাম আলোচনায় আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মাণের সময় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে দরপত্রের অর্থ ভাগাভাগির ঘটনায়।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জমিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা করে কীভাবে বিক্রি করছেন—এমন এক প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এখানে অন্ধদের ট্রেনিং সেন্টারের জায়গা রাখা হয়েছে। বাকি জায়গা আমরা পজেশন হস্তান্তর করছি। এগুলো বিক্রি বলা যাবে না।’ এর বেশি কথা বলবেন না বলে জানান তিনি।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মুনিম হাসান। সবকিছু শুনে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ জালিয়াতির জন্য ডেভেলপার কোম্পানিকে যেমন আইনের আওতায় আনা দরকার, তেমনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যে দপ্তর মাঠপর্যায়ে এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া কোনোভাবেই এ কাজ করা সম্ভব হতো না। পাশাপাশি রাজউকও যে নামমাত্র একটি অনাপত্তি নিয়ে এখানে নকশা অনুমোদন দিল, তারা পুরো যাচাই-বাছাই কেন করল না, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের আইনের জালে আবদ্ধ না করলে সরকারি ভূমি আত্মসাৎ হতেই থাকবে।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত